তোমার জয়ে আমাদের জয়
অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান
আচ্ছা ‘বাংলাদেশ’ যদি একজন মানুষ হত, কেমন হত সেই কর্মোদ্দীপ্ত তরুণটি, মাঝে মাঝে আমি ভাবি। আমার কেন জানি মনে হয়, তরুণটি হত সজীব ওয়েজেদ জয়ের মতো। ঠিক বাংলাদেশের সমবয়সী একজন মানুষ। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে। ধানমণ্ডির এক অবরুদ্ধ গৃহে। যুদ্ধক্ষুব্ধ দেশেই কেটেছে জীবনের প্রথম ৫ টি মাস। ১৭ ডিসেম্বর অলৌকিকভাবে দখলদার বাহিনির হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যান।
পরের দিন সারা বাংলাদেশ জানতে পারে বঙ্গবন্ধুর প্রথম নাতি জন্মাবার খবর। কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা এভাবেই সে খবর ছাপায়- ‘... কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেগম মুজিবরের সারা মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল ভারী। ভরা গলায় তিনি বলেছেন, শেখ সাহেবকে ওরা কোথায় রেখেছে আমি জানি নে। কেমন আছেন তাও না। বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে ¤øান হাসি হেসে বললেন, তাদের আজকার মুক্তির দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি নাতির (বড় মেয়ের ছেলের) নাম রেখেছেন- ‘জয়’। জয় জন্মেছে ঢাকাতেই গত জুলাই মাসের ২৭ই।’ (সূত্র: বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জয়- জয়দীপ দে) পাঁচমাসের ‘জয়’ হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জয়ের প্রতীক।
অনেক হারানোর বেদনার মধ্যে ‘জয়’ যেন অফুরাণ সম্ভাবনার বারতা নিয়ে এসেছিল। আজ আরেক ২৭ জুলাই। বাংলাদেশের সমবয়সী সজীব ওয়াজেদ জয়েরও পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। যে স্বপ্নের উপর ভর দিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল, তা যেন আজ মূর্তমান। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। ধনে-ধান্যে ফুলে-ফলে স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ এখন চোখের সামনে। এই ‘সোনার বাংলা’ তৈরিতে প্রধান কারিগরদের মধ্যে অন্যতম সেদিনের সেই ‘জয়’। নিভৃতচারী এ মানুষটি প্রথম আমাদের চোখের সামনে আসেন ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক অভিনব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রত্যয়। এই ডিজিটাল বাংলাদেশই হবে ধনে-মানে জগৎ-সেরা বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিদ্যুৎ সমস্যা, অবকাঠামোর অপার্যপ্ততা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার নাজুকতা- নিয়ে খুব সমালোচনা হত। তখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ একটা ব্যঙ্গের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১২ বছর পর আজ ভাবতে অবাক লাগে, দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে নিয়ে ব্যঙ্গ তো দূর, এর আশীর্বাদ গ্রহণ না করে একদিন কাটিয়ে দেয়ার উপায় নেই। লাইন ধরে ইউটিলিটি বিল দেয়ার দিন শেষ। হাতের মুঠোয় সব সেবা। ট্রেনের টিকেট, বিমানের টিকেট, ভূমিকর প্রদান- সব মোবাইলের মাধ্যমে। এতে সেবাপ্রাপ্তি যেমন সহজ হয়েছে, সেবাদাতাদেরও কষ্ট লাঘব হয়েছে। তথ্য ব্যবস্থাপনা হয়েছে সহজ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা।
এর ফলাফল দেখা যায় অর্থনীতির সূচকগুলোতে। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসে তখন মাথাপিছু আয় ছিল ৭৫৯ ডলার। এখন সেটা ২,২২৭ ডলার। এক যুগে একটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় তিন গুণ হওয়া এক বিষ্ময়ের ব্যাপার বটে। সারা দুনিয়ার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন বাংলাদেশ। ২০১১ সালে যেখানে বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ ১.১ বিলিয়ন ডলার ছিল, ২০১৮ সালে তা ৩.৬ বিলিয়নে পৌঁছে যায়। করোনার কারণে এই প্রবাহে কিছুটা মন্দা বিরাজ করলেও ২০২০-এ তা ২.৬ বিলিয়ন ডলার ছিল। বৈদেশিক বিনিয়োগ একটা দেশের প্রতি বিদেশীদের আস্থার সূচক হিসেবে ধরা হয়।
এই বিরাট সাফল্যের নেপথ্যের কারিগর সজীব ওয়াজেদ জয়। নিভৃতচারী মানুষটিকে গলাবাজি করতে দেখা যায় না। তার কোন নিজস্ব ভবন-আস্তনা নেই। পদ-পদবির ধারে কাছে নেই। দূর থেকে দেশকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নীরবে। আজ বাংলাদেশের ছেলেরা আউট সোর্সিং করে কোটি কোটি ডলার কামাচ্ছে। এ বিষয়টিকে তিনিই জনপ্রিয় করে তুলেছেন। সেজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। ইউনিয়নে ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্সের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে যাচ্ছে। একটার পর একটা সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। একসময়কার বটমলেস বাংলাদেশের স্যাটেলাইট এখন মহাকাশে! এই দুর্দান্ত অবকাঠামোই অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে বাংলাদেশের তরুণদের। আর এসবই জয়ের ‘ব্রেইন চাইল্ড’।
২০১৯ সালের ১৭ জুলাই আগারগাঁও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এক অনুষ্ঠানে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য আমাদের টার্গেট প্রায় ৯০ শতাংশ সরকারি সেবা মোবাইলে থাকবে। আঙুলের সঙ্গে থাকবে। সাধারণ নাগরিকদের জীবনের সহযোগিতা করে সময় বাঁচানোর কাজ, এটাই হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের মিশন।’ (সূত্র: সারাবাংলা. নেট) সেই মিশনের অনেকটা তিনি করতে সক্ষম হয়েছেন। এই করোনার অতিমারি চলাকালীন সময় এর সুফল আমরা আরো বেশি করে অনুভব করতে পেরেছি। অনলাইন পেমেন্টের বদৌলতে ঘরে বসেই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পণ্য দোরগোরায় পেয়েছি আমরা। দীর্ঘদিন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার পরও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অনেক বিশ^বিদ্যালয় সফলভাবে অনলাইন পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পাদন করতে পেরেছে। মোবাইলের স্কিনে সেরে নেয়া গেছে ব্যাংকিং কার্যক্রম।
রেল স্টেশনের জনসমাগম দূর করতে মোবাইলেই সব টিকেট বিক্রি করা হয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগেও এসব আমাদের কাছে কল্পনার অতীত ছিল। এ সম্ভব হয়েছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের দূরদর্শিতার কারণে। তাই বলি, তোমার জয়ে আমাদের জয়। তোমার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক। শুভ জন্মদিন।
লেখক : অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ এবং হল প্রোভোষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সদস্য, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপকমিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
এইচআর/এএসএম