করোনায় কৃষিই অবলম্বন
সজীব ওয়াফি
দেড় বছর আগে পৃথিবী জুড়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরে। রূপ নেয় মহামারির। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকে নিতে হয় লকডাউন বা শাটডাউনের সিদ্ধান্ত। শুরু হতে থাকে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিলেন কৃষিতে। আহ্বান করলেন এক টুকরা জমিও পতিত নয়। সকলকে কৃষি ফসল উৎপাদনের অনুরোধ করলেন।
বাংলাদেশ কোভিড-১৯ আক্রান্তের পর ২.৫ কোটি মানুষসহ অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। পূর্বে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ। করোনা সংকটে পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে করতে হয়েছে বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞপ্তিও ৮৭ থেকে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। পদের সংখ্যাও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। অর্থাৎ আগে যেখানে ১০০ জন নিয়েছে, এখন সেখানে শতকরা ৪০ জন নিচ্ছে। মোটকথা তুলনামূলক বেকার সমস্যাও বেড়েছে বহুগুণে।
কৃষি কাজ বলতে কেবল কারো জমিতে কাজ করা বুঝায় না। কৃষি কাজ বলতে ফসল উৎপাদন, মাছ চাষ, পশু পালন এবং হাঁস-মুরগীর খামার করাও বুঝায়। এতে প্রয়োজন হয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। আমরা দেখেছি শিক্ষা জীবন শেষ করে কিছু কিছু শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে কৃষিতে সফলতা দেখিয়েছেন। আছে ব্যক্তি স্বাধীনতা। অনেকে আবার চাকরি ছেড়েও নিয়োজিত হয়েছেন এ পেশায়।
সরকার থেকে মূলত করোনায় আটকা পরা মানুষেরা কি খাবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্যই আহ্বান জানানো হয়েছিল। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো অতিক্রম করছে নানান টানাপোড়েন। তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য নানা উদ্যোগ। মুজিব জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে এবং মহামারি সংকট চিন্তা করেই উদ্যোগী তরুণদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সরকারপক্ষ। ব্যবস্থা নিয়েছেন যেন উদ্যোগী তরুণেরা সহজেই বিনা জামানতে ঋণ পায়। দেওয়া হচ্ছে প্রণোদনা সুবিধা।
অনেকেরই জমি নেই। চাষাবাদ করা তাদের জন্য দুরূহ। অল্প কিছু জমিতে অথবা বাড়ির আঙ্গিনায় তারা ঝুঁকতে পারে পশু পালনে অথবা হাঁস-মুরগির খামারে। পশুর মলমূত্রাদি দিয়ে হতে পারে বায়োগ্যাস। হাঁস-মুরগির উৎসৃষ্ট মাছের আদর্শ খাবার। আবার হাঁস-মুরগি খামারে নিচে পুকুরের সাথে যৌথ মাছ চাষের পাশাপাশি ধান উৎপাদনেরও সুযোগ আছে। বাড়ির আঙ্গিনায় বা পুকুর পাড়ে রোপণ করা যায় ফলজ, বনজ এবং ভেষজ জাতীয় বৃক্ষ। বৃক্ষ রোপণে তাৎক্ষণিক হয়তো অর্থ উপার্জন হবে না। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পরে বড় অংকের লাভ যেমন আছে, তেমনি সুযোগ আছে বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাওয়ার। এর জন্য প্রয়োজন শুধু কিছু কৃষি বিষয়ক জ্ঞানের।
আমাদের দেশে ভাবা হয় উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি, সে আর যে কোন কাজে নামতে পারবে না। কৃষি কাজে নামা তার জন্য অস্বাভাবিক। পরিবারেরও সায় মেলে না অনেক সময়। বহু আগে ব্রিটিশ সময়ের কথা; এক জৈনক কর্মকর্তা ভারতবর্ষ শাসন করতেন এখানে, অবসরকালীন সময়ে দেশে ফিরে মুচির কাজ করতেন। ব্রিটিশরা সময়ের মূল্য বোঝে। জাপানসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও নাগরিকদের অবসরের কোন সময় হাতে নেই; যেটা একমাত্র তৃতীয় বিশ্বের বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা যায়। সুতরাং যে কোন কাজে হীনমন্যতা থাকা মোটেই উচিত নয়।
২০০০ সালের আগে খোদ বাংলাদেশই না খেয়ে অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণ করার খবর পত্রিকার পাতায় ভেসে আসতো। দু'হাজার সাল পরবর্তী কৃষি বিপ্লবের ঢেউয়ে বর্তমান শতাব্দীতে যেটা দুর্লভ। উৎপাদন হয়েছে উন্নতজাতের ধান, গম, পাট, চা এবং শস্য জাতীয় খাবার। কৃষক তার ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দিলে বিপাকে পরতে হবে শহুরে জনসংখ্যার। তবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য না থাকায় কৃষক বেশিরভাগ সময়েই হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। লাভবান হয়েছে মধ্যস্থকারবারী।
করোনা পরবর্তী পৃথিবী মুখোমুখি হবে অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিতে। মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ করতে না পারলে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। একবার দুর্ভিক্ষ শুরু হলে করোনার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানবজাতি। এমতাবস্থায় কৃষিতে মনোযোগী হলে একদিকে যেমন খাদ্যের যোগান আসবে, ঠিক অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা হলেও মোকাবিলা সম্ভব। শুধু দরকার প্রচেষ্টা।
প্রতিটি দেশের অর্থনীতির একটা প্রধানতম মাধ্যম থাকে। বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। শিল্পের দিকে ধাবিত হলেও সে পথ অনেক দীর্ঘ। বরঞ্চ কৃষিই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। উর্বর মাটি, বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়।
এইচআর/এমএস