করোনা ও বিবিধ লকডাউন
গত বছর মার্চ মাসে দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর অনেক প্রকারের লকডাউন দেখেছি আমরা। সাধারণ ছুটি, এলাকাভিত্তিক লকডাউন, সারাদেশে কোমল, কঠোর, শিথিল লকডাউন। এসব লকডাউন ৭ দিনের হয়েছে, আবার ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে তো আবার সপ্তাহ খানেক শিথিল করা হয়েছে। এবার এক লকডাউন শুরু হয়েছে গতকাল থেকে যা চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত।
এর আগে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ১৭ দিনের কোমল কঠোর লকডাউন এবং কোরবানির হাটকে জমজমাট করতে যে শিথিলতা দেখানো হল, এর পরিণতি বা প্রভাব বুঝতে আমাদের হয়তো ৭ থেকে ১০ দিন আপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে পালিত লকডাউনে সংক্রমণের হারে খুব একটা প্রভাব না পড়ায় এবারের লকডাউনকে খুব কঠিন সময় হিসাবেই দেখা হচ্ছে।
দেশে করোনা মহামারির চরম সংকট যাচ্ছে বর্তমানে। জুনে এক লাখের কিছু বেশি রোগী শনাক্ত হলেও জুলাইয়ের অর্ধেক সময়ে তা ছাড়িয়ে গেছে। নয় দিন আগে দেশে একদিনে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৭৬৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আর গত ১১ দিনে প্রায় একলাখেরও বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ হাজার করে শনাক্ত হচ্ছেন। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালগুলোও পড়ছে সংকটে। ধীরে ধীরে কমে আসছে খালি শয্যা এবং আইসিইউ বেডের সংখ্যা। তাছাড়া মৃত্যুর হারও আছে ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছেন ২০০ জনের কাছাকাছি।
এখন এবারের লকডাউন কতটা শক্তভাবে করা সম্ভব হবে সে নিয়ে সংশয় আছে। কারণ প্রতিবারই আমরা দেখেছি কোন না কোন একটা গোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করা হয়েছে। তবে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এবার এসব হবেনা। লকডাউন হবে কঠোর। কেমন হবে, কতটা হবে এসব বিতর্কের মাঝে সবচেয়ে বড় সত্য এই যে, করোনা আছে এবং ভয়াবহভাবে তার সংক্রমণ বাড়ছে। আমাদের সবার টিকা দেওয়া হয়নি যে আমরা কিছুটা হলেও ইমিউনিটি পাব।
মনে রাখা দরকার অনেক অপকর্ম আমরা করে ফেলেছি, অন্তত এবারকার লকডাউনটা আমরা সবাই মানি। ফের যদি ঘরের বাইরে বের হই, লকডাউন না মেনে, স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা না করে, তাহলে বাড়ির বাকি সদস্যদের জন্য বড় ঝুঁকি নিয়ে আসব বাইরে থেকে। এর মাঝে ভাইরাসের নিত্য নতুন প্রজাতি, বিশেষ করে এ মুহুর্তে সক্রিয় ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সবচয়ে ভয়ংকর হিসেবে আমাদের সব লড়াই এলোমেল করে দিচ্ছে।
কড়াকড়ি বিধিনিষেধ করেই যেখানে সামাল দেওয়া যায় না মানুষের শ্রোতকে, সেখানে সরকার ঈদের আগে শিথিল করেছিল। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ব্যাপকহারে শুরু হয় নিয়ম ভাঙার পালা। রাস্তায় অজস্র গাড়ি। সকলেই যে খুব জরুরি কোনও প্রয়োজনে বেরোচ্ছেন, এমনটা নয়। বাড়ির পথে লাখ জানতার মিছিল। এই বেপরোয়া মনোভাবই ভয় ধরিয়েছে চিকিৎসক ও সচেতন নাগরিকদের মনে। তাদের বক্তব্য, করোনার সংক্রমণ যখন ঊর্ধমুখী তখন, প্রশাসনিক ছাড়ের সুযোগ নিয়ে মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জেরে ফের তা বেড়ে যাবে। আসলে ঈদকে কেন্দ্র করে একটা সুরক্ষার পরিকল্পনা নেওয়া উচিত ছিল যেটা নিয়েছে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ। এটাই ছিল সতর্ক হওয়ার আসল সময়। কিন্তু আমরা পারিনি।
এখন যেটা শুরু হলো সেটা যেন মাঝ পথে শিথিল হয়ে না যায় কিংবা প্রশাসন যেন হাল ছেড়ে না দেয়। মানুষকে বোঝানো দরকার এবার ভাল করে নিয়মবিধি মেনে চললে আর বিধিনিষেধ জারির প্রয়োজন না-ও হতে পারে। কিন্তু এর অন্যথা হলে বড় বিপর্যয় অনিবার্য। কাজটা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পুলিশ বা প্রশাসন বা সেনাবাহিনীর শুধু নয়। এই সচেতনতা আমাদের সবার।
প্রশ্ন হলো মানুষকে সচেতন করার কাজটা করবে কে? গণমাধ্যম তার কাজটা করার চেষ্টা করেছে। শুরু থেকে করোনার নিউজের পাশাপাশি মানুষকে এই রোগ থেকে বাঁচতে করণীয় সম্পর্কে বহু কথা প্রচার করেছে, লিখেছে। বিশেষ করে মাস্ক পরা ও দূরত্ম বজায় রাখা সম্পর্কে বলেই যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ আছে – গণযোগাযোগ অধিদপ্তর। তার কাজই হল সরকারের কোন কর্মসূচির উদ্দেশ্য বিধেয় মানুষকে জানানো। কোন প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়নি। আছে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত স্থানীয় সরকার কাঠামো, তারাও দৃশ্যমান সফল কোন সক্রিয়তা দেখায়নি। আছে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর, তারাই বা কোন উদ্যোগটি নিল?
এবারের লকডাউনটা যদি খুব কড়াকড়িভাবে করা যায় এর সুফল পাওয়া যাবে। মানুষের উচিত রাষ্ট্রকে, সরকারকে সহায়তা করা। কিন্তু শুধু মানুষের সতর্কতা নয়, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের সতর্কতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। মানুষ সতর্ক কি না, তা বোঝা যাবে, তারা মাস্ক পরছেন কি না বা দূরত্ব-বিধি বজায় রাখছেন কি না, সেটা দেখে। আর রাষ্ট্রের সতর্কতা বোঝা যাবে সে এই লকডাউন বাস্তবায়ন কতটা করতে পারছে তার উপর। রাষ্ট্রকে আরও যেটা করতে হবে তা হলো সংক্রমণের চিত্র বুঝতে করোনার পরীক্ষার হার বাড়ানো।
ছোঁয়াচ এড়ানোর সব রকম চেষ্টা নিতে হবে। ঈদের সময় এবং আগে সুযোগ পেলেই হুড়মুড়িয়ে আমরা গাড্ডায় গিয়ে পড়ছি। এবার সেটার পুনরাবৃত্তি আর হতে দেওয়া যাবে না। অনেকের কাছেই লকডাউনের কড়াকড়ি এক রকমের দমবন্ধ পরিস্থিতি। সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে শ্বাস নেওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করেন। কিন্তু তারা ভুলে যান এ রোগের কারণে বহু রোগী হাসপাতালে শ্বাস নিতে পারছেন না। কোনভাবেই মানুষকে এবার বেপরোয়া ও উদ্দাম হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, করোনা শত্রু এবং তাকে একেবারে রুখে দেওয়ার এটাই সেরা সময়।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস