ঈদ বিনোদন এবং সংস্কৃতির ওলটপালট
বিনোদনের ধরন দিনে দিনে পরিবর্তন হচ্ছে। সংস্কৃতিতে চলছে ওলটপালট অবস্থা। সেটি নিয়ে পণ্ডিতদের রক্ষণশীল মতামত আর কোনোভাবেই টিকছে না। আর এই করোনাকালেতো একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না পুরোনো ধ্যান-ধারণায় আটকে থাকা। পুরো বিশ্ব ঢুকে গেছে ইন্টারনেট জগতে, অন-ডিমান্ড ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস, ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড জগতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে রাখা রক্ষণশীল সমাজের জন্য কঠিনতর কাজ।
আমাদের ছোটবেলায় ঈদের বড় বিনোদন ছিল বিভিন্ন সাপ্তাহিকের ঈদ সংখ্যা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যাওয়া। সবাই যেন সারাবছরের অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকতেন ঈদের জন্য। অপূর্ব সব সমাহারে ভর্তি থাকতো ঈদ সংখ্যা। কাড়াকাড়ি লাগতো তা পড়ার, সংগ্রহে রাখার। বড় বড় লেখকদের উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী থাকতো। থাকতো তারকাদের নিয়ে চমৎকার ফিচার। যারা এই সমস্ত পত্রিকায় লিখতেন তারাও যেন সারাবছর অপেক্ষায় থাকতেন নিজের সেরাটা উপহার দেয়ার জন্য।
এর পরপর ঈদ বিনোদনে যুক্ত হলো অডিও ক্যাসেট। ঈদ উপলক্ষে কণ্ঠশিল্পীরা তাদের সেরা গান নিয়ে আসতেন। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতে থাকলো ব্যান্ডের গানের ক্যাসেট। ঈদ মানেই সিনেমা হলে গিয়ে নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা দেখা। এখানেও বছরের সেরা ছবির জন্য অপেক্ষা। একসঙ্গে একাধিক সিনেমা মুক্তি পেতো আর হাউসফুল সাইনবোর্ড ঝুলতো সিনেমা হলের সামনে। টিকিট কালোবাজারি হতো। ৫-১০ গুণ বেশি দামে তা কিনতে হতো। এই কালোবাজারিদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকতো হলের টিকিট বিক্রেতাদের। ফলে টিকিট পাওয়া কষ্টসাধ্য ছিল।
তারপরও হলে গিয়ে সিনেমা দেখা সেকালের ঈদ বিনোদনের মধ্যে সবার শীর্ষে ছিল বলা যায়। পরিবারের সবাই মিলে দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়ার স্মৃতি আমাদের প্রজন্মের অনেকের রয়েছে। সিনেমার রমরমা বাজার থাকতেই ঈদ বিনোদনে টেলিভিশনের আগমন। টিভি এই স্মৃতিকে আরও মধুময় করে দিয়েছিল। ঘরে বসেই বিনোদন। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত টিভি থেকে চোখ সরানো কঠিন ছিল। তখন একমাত্র ভরসা বিটিভি। সব মেধারও সমাবেশ ছিল সেখানে। ঈদের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকা সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকদের জন্য ছিল মর্যাদার বিষয়।
ঘরে বসে বিনোদন পাওয়ার মধ্যে যোগ হলো ভিসিআর-কালার টিভি। হিন্দি সিনেমার ক্যাসেট ভাড়া দেয়ার দোকান ছিল পাড়ার মোড়ে মোড়ে। নব্বইয়ের মাধামাঝি পর্যন্ত এটাই চলমান ছিল বলা যায়। এরপর আসলো নতুন নতুন দৈনিক, এবার ঈদ সংখ্যা প্রকাশে যোগ দিল পত্রিকাগুলোও। এটা অনেকটা কলকাতার পত্রিকাগুলোর পুজো সংখ্যার অনুকরণ। নিজেদের ঈদ সংখ্যা বের করতে না পারা মর্যাদার ইস্যু হয়ে গেল তাদের জন্য। কোয়ালিটিও ধরে রাখার চেষ্টা ছিল অনেকের।
কিন্তু এই শতাব্দীতে স্যাটেলাইট আর বেসরকারি টিভি যুগে প্রবেশ করে ঈদ সংখ্যার কদর কেন জানি কমতে শুরু করলো। হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আকর্ষণও কমতে থাকলো। তবে সপরিবারে ঈদে সিনেমা দেখার আকর্ষণ কমে গেলেও, ঈদের সিনেমা দেখার জন্য ভিড় কম ছিল না। ক্যাসেটে গান শোনাও কমে গেল। গানের সিডি আসলো। ডিভিডি আসলো। একসময় এসবও উঠে গেল ইউটিউব আসায়।
বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর আগমনের শুরুতে ঈদ বিনোদনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। টানা ৫ থেকে ৭ দিন ঈদের অনুষ্ঠান চলেছে টেলিভিশনের পর্দায়। কয়েকশ নাটক, নানা রকম বিনোদন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় ঈদকে কেন্দ্র করে। পাশাপাশি বিটিভির ওপর থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয়া শুরু করে। যে বিটিভির আনন্দমেলা না দেখলে ঈদ অসম্পূর্ণ মনে হতো তা দেখারও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে দর্শক।
বিদেশি স্যাটেলাইট টিভির আগমন এই শতাব্দীর শুরু থেকে হলেও ঈদ বিনোদনে খুব প্রভাব ফেলতে পারেনি ওই টিভিগুলো। অন্যসময় বাংলাদেশি দর্শক সেখানে বিনোদন খুঁজলেও ঈদে ঘরে ফিরে আসতো। গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি টেলিভিশনগুলো চরমভাবে দর্শকদের হতাশা দিতে শুরু করেছে। ঈদ বিনোদনের নামে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান চালাতে শুরু করলে সিংহভাগ দর্শক বেসরকারি টিভিগুলো দেখা বন্ধ করে দেয়, এমনকি ঈদের সময়ও নারী দর্শকরা তাদের বিদেশি সিরিয়ালে ফিরে যায়।
তরুণরা টিভি দেখার চেয়ে ইউটিউবে বিনোদন খোঁজে। ফলে নাট্যকার এবং টেলিভিশনগুলো নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে নাটক এবং অন্যান্য বিনোদন অনুষ্ঠান প্রচারে বাধ্য হয়। দর্শক ভিউ সেখানে স্পষ্টই দেখা যায়। যেসব টেলিভিশন বিজ্ঞাপন এজেন্সিগুলোর ফাঁদে পড়ে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে বিনোদন অনুষ্ঠান চালাতো তারা দেখতে পাচ্ছে তাদের বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে ইউটিউব, ফেসবুকে। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে নতুন ধরনের কন্টেন্ট। এমনকি হুজুরদের ওয়াজও সেখানে বড় বিনোদন উপাদান।
কিন্তু গত কয়েক বছর ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রভাব, স্মার্টফোন যুগে প্রবেশ- বিনোদনের পুরোনো সব ধারাকেই প্রায় বাতিল করে দিয়েছে। এখন বিনোদন মুঠোফোনে চলে গেছে। মানুষের স্বচ্ছলতা আসায়, কর্মব্যস্ততা বাড়ায় ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে চলে যাওয়া কিংবা দেশের মধ্যে ঘুরে আসার প্রচলনও শুরু হয়েছে। ঈদে বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা নয়, রেস্টুরেন্টে হ্যাংআউট শুরু হয়।
তবে করোনা বিশ্বমারি এসে ঈদ বিনোদন সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দিয়েছে। সিনেমা হল বন্ধ, ভ্রমণ বন্ধ, দেখার মতো টিভিতে কন্টেন্ট নেই- সারাবিশ্বের মানুষের সঙ্গে মোবাইলফোন ভরসার স্থান হয়ে ওঠে বাংলাদেশিদেরও। করোনা বিশ্ববাসীকে এককাতারে এনে দিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ওটিপি প্লাটফর্ম। সিনেমা হলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, টিভি চালুর দরকার নেই, যে যেখানে আছে সেখানেই বিনোদনে বুঁদ হয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ এই ক্ষেত্রে বিপ্লবী ভূমিকা রাখছে। তাদের যার যার নিজস্ব ওয়েব প্লাটফর্মও হয়ে উঠেছে দর্শকদের জন্য একেকটি বিনোদনের খনি। দর্শক তার চাহিদামত শিক্ষা-বিনোদন সব রকমের উপাদান সেখানে পাচ্ছে।
ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড প্লাটফর্ম হিসেবে করোনার আগেই নেটফ্লিক্স পরিচিতি পেতে শুরু করে মানুষের কাছে। নেটফ্লিক্স এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অন-ডিমান্ড ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস। প্রায় সব ধরনের মুভি আর টিভি শো নেটফ্লিক্স এ পাওয়া যায়। নিজেদের প্রডিউস করা প্রোগ্রামগুলোও নেটফ্লিক্স প্লাটফর্মে ব্যাপক জনপ্রিয়। এগুলোকে নেটফ্লিক্স অরিজিনালস বলা হয়। মাসিক একটা সাবস্ক্রিপশন চার্জ দিয়ে বাংলাদেশেও এটি কম জনপ্রিয় নয়। তার দেখা দেখি ভারতসহ নানা দেশে ওটিপি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। অতিসম্প্রতি চরকা নামের একটি ওটিপি প্লাটফর্ম চালু হয়েছে ঘটা করে। বাংলাদেশের বড় নির্মাতা, তারকারাও ওটিপির দিকে ঝুঁকেছে এই করোনাকালে। ২০২০ সালে বেশ কয়েটি ওটিপি কনটেন্ট একই সঙ্গে আলোচিত এবং সমালোচিত হয়। ভারতীয় ওটিপি মাধ্যমে এসেছিল সেইসব কনটেন্ট।
মোবাইল অপারেটরগুলোও নিজস্ব অ্যাপের মাধ্যমে দর্শক চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছে। গ্রামীণের বায়োস্কোপের পর বাংলা লিংক ‘টফি’ চালু করেছে এবং রাতারাতি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। টফিতে বিনা পয়সায় বিদেশি অনেক পে-চ্যানেল দেখাটি সুযোগ রয়েছে, যা অন্য অ্যাপ থেকে তাদের ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
আমার নিজের কথা বললে আমি ওটিপি প্লাটফর্মকে স্বাগত জানাই। এখানে একজন দর্শক তার নিজ বিবেচনায় বিনোদন কিনছে, নির্মাতা অনেকটা স্বাধীনতা নিয়ে তৈরি করছে। তবে দেশীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়া সম্ভব নয় এখানে। অর্থনৈতিকভাবে নির্মাতারা কতটুকু লাভবান হতে পারবেন সে হিসাব আমার জানা নেই। কারণ পাইরেসি একটি বড় বাধা এসব ক্ষেত্রে। সেটি কমানোর জন্য বাংলাদেশি বা বাংলাভাষী দেশি-বিদেশি দর্শকদের টার্গেট করে নির্মিত ওটিপি প্লাটফর্ম আরও কম মূল্যে, বহুল উপায়ে দর্শক পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
আমি অতিসম্প্রতি ওটিপি প্লাটফর্মে অনেকগুলো নাটক, সিনেমা এবং সিরিয়াল দেখেছি। এর মধ্যে মহানগর, লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, মরীচিকাসহ আরও কয়েকটি কনটেন্ট আমার ভালো লেগেছে। অনেক কনটেন্ট বিরক্তিকরও লেগেছে। আবার অনেক বিদেশি মুভি এবং সিরিয়ালও আমার মন কেড়েছে। তার মধ্যে তুরস্কের সরকারি প্রতিষ্ঠান টিআরটি নির্মিত দিরিলিস আরতুগ্রুল ছিল সবার সেরা। একটি সিরিয়াল কীভাবে দর্শক টেনে ধরে রাখতে হয় দিরিলিস আরতুগ্রুল-এর নিমার্তাদের কাছে অনেকের শেখার আছে। আমাদের সিরিয়াল নির্মাতাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এরা ছোট্ট কাহিনীকে রাবারের মতো টেনে টেনে লম্বা করে, কাহিনীর গতি থাকে না।
যাই হোক সময়ের তালে তালে, যুগের চাহিদায় ঈদ বিনোদন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমরা কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি না। সংস্কৃতি এবং বিনোদন চলমান নদীর জলের ধারার মতো। সেখানে আগামী দিনে দেশি-বিদেশি সংস্কৃতি-বিনোদন বলে আলাদা কিছু থাকবে মনে হচ্ছে না। নদীর স্বচ্ছ জলের মতো এক দেশ আরেক দেশের সংস্কৃতির স্বচ্ছ অংশটুকু নিচ্ছে এবং নিবে, আবর্জনা-ঘোলা পানি বর্জন করবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/এমএস