ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারে যেন বাতাস ভারী না হয়
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
করোনা এখন ধনী-গরীব সবার প্রাণসংহারী অতিমারি। তবে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এসে দরিদ্র মানুষের জন্য বেশি দুঃখ-শোকের মহাকারণ হয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বের মানুষগুলোর অবহেলা ও উন্নাসিকতার খেসারত দিয়ে ব্যাপক প্রাণনাশ করে করোনা এখন উন্নয়নশীল ও অনুন্নত বিশ্বের অজ্ঞ-অসচেতন মানুষের দ্বারে আঘাত করে জমে-মানুষে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে।
বিত্তশালী দেশগুলো দ্রুততার সাথে চিকিৎসা সামগ্রী তৈরি বা সংগ্রহ করে করোনার আঘাত সামলে নিয়ে সবাইকে টিকা দিয়ে যখন আনন্দ শুরু করে দিয়েছে ঠিক তখনই প্রাণবায়ু অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে দরিদ্র দেশের বিত্তহীন মানুষগুলো। দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা সূচিত হয়েছে অনেক জায়গায়।
বিত্তশালী দেশগুলো দ্রুততার সাথে কারোনার পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে। তারা সতর্কতার মাত্র বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ছয়টি দেশে লকডাউন শিথিল করার পর সংক্রমণ পুনরায় শুরু হতেই ইউটার্ণ নিয়ে আবার সাটডাউনে ফিরে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লকডাউনে শিথীলতা দেখানোর পর সংক্রমণ আবার দেখা দেয়। তারা তড়িঘড়ি করে জনগণকে ঘরে ফিরে যেতে আহব্বান করে। সে সকল দেশের মানুষ সচ্ছল ও সচেতন। সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকার সদা সজাগ, আরো বেশি সচেতন। তাই তাদের দ্রুত ইউটার্ণ নিতে অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোর চরিত্র আলাদা। করোনা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সাথে কর্মহীন মানুষ এবং স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি এদেশগুলোতে। তাই জনগণকে বাধ্য হয়েই রাস্তায় নামতে হচ্ছে। কঠোর লকডাউনের প্রথম দিনেই ভিক্ষুক এসে বাসার দরজায় কড়া নাড়ছিল। মাটিকাটা শ্রমিক ভোরের আলো ফুটতেই কোদাল-টুকরি নিয়ে কাজের খোঁজে রাস্তায় নেমেছে। রিক্সাওয়ালারা ছুটছে যাত্রীর সন্ধানে। তাদের একজনকে লকডাউনের কথা বলতেই ক্ষেপে গিয়ে নানা কথা বলল সেদিন। তারপর ক্যামেরা দেখে নিজেকে সম্বরণ করে বলে উঠলো, “ভাইরে, হামরা আইজ বাইরত- কারণ পেট মানে না বারণ।” পেটের দায় বড় দায়। এজন্য সেদিন মাই টিভিতে (জুলাই ১২, ২০২১) মানুষ কেনাবেচার হাট অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, “শহুরে কর্মহীন দরিদ্রদের পেটের ক্ষুধা মেটাতে খুলো দেয়া হোক লঙ্গরখানা।”
কোরবানি ঈদের সময় মানুষ ছুরি, চাকু ব্যবহার করবে। কিন্তু কেউ তার দোকানে এখনও সেকাজ করতে ভিড় করছে না। তা অনুভব করে শান দেয়ার কাঠের যন্ত্রটি ঘাড়ে নিয়ে কঠোর রোদের মধ্যে লকডাউন উপেক্ষা করে পাড়া-মহল্লার রাস্তায় হাঁক-ডাক করে খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে এই ক্ষুদ্র বৃত্তির একটি লোক। বছরের এই সময়ে তার বাড়তি আয় হয়। তা দিয়ে সংসারের ঘানি টানা যায় বেশ কয়েকটা দিন। কিন্তু এবছরে ঈদে বাড়তি আয় থেকে বঞ্চিত হয়ে মাঠে মারা যেতে পারে সে। তাই তার আক্ষেপ বেড়ে গেছে। করোনার ভয়ে কেউই তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। সংসার চালাবে কি দিয়ে সে?
উন্নত দেশে করোনার সময় সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নিত্য জিনিসত্রের মূল্য বাড়েনি। কিন্তু আমাদের বাজারে যেন উল্টোব্যাপার ঘটে এমন দুর্বল সময়ে। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারঙ্গম আমাদের ব্যবসায়ীরা। মজুতদারদের সাথে যোগসাজশ করে তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপণ্যের। যার ফলে মূল্য বেড়ে যায়।
টিসিবির পণ্যের সংকট সবসময় ঘটে। টিসিবি-র পণ্যের পরিমাণের চেয়ে গ্রাহকের সংখ্যা সবসময় বেশী থাকে। লাইন দীর্ঘ, মানুষ প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে না পেরে হতাশ হয়ে চিৎকার করে সংবাদ মাধ্যমকে জানায়। তাদের এত কোন লাভ হয় কি-না তারা কখনও জানতে পারে বলে মনে হয় না। এই সামান্য পরিমাণ পণ্য বিক্রির চেয়ে না বিক্রি করাই ভাল বলে মনে করে অনেকে।
আমাদের মত দরিদ্র দেশগুলোর সিংহভাগ জনগোষ্ঠি স্বাস্থ্যবিধি কথাটির প্রচার বারবার শুনলেও আসলে করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি বলতে কী বুঝানো হয়েছে তা উপলব্ধি করতে পারছে না। বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুযোগ নাই তাদের অনেকের। সুযোগ নেই ব্যক্তি-সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার। কারণ, একই টিউবওলের হাতলে চাপ দেয় এলাকার ২০-৩০ জন, একই ঘরে ঘুমাতে হয় অনেকজনকে, কাঁচা, ঝুলন্ত গণ টয়লেট অথবা খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করা ছাড়া যাদের উপায় থাকে না। স্বাস্থ্যবিধির কখা ব্যাখ্যা করলে নিয়তির হাতে নিজেকে সমর্পণের কথা বলে ক্ষান্ত দিয়ে মুখে তর্জনী চেপে নিষেধ করে আর কিছু বলতে।
আসন্ন ঈদে গরুর হাট বসানো হয়েছে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির পরামর্শকে উপেক্ষা করে। বিধিনিষেধ শিথীলের জন্য কমিটি গভীর উদ্বেগের কথা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। ডেল্টার ভয়ানক দাপটের মুখেও সারাদেশে গরুর হাট বসানো খুবই হতাশাজনক। হাটে আরো মাখামাখি হচ্ছে মানুষে মানুষে সংক্রমণ। ইতোমধ্যে ঈদে বাড়ি ফেরার জন্য শুরু হয়েছে বেপরোয়া চলাফেরা যা সংক্রমণের ভয়াবহতাকে গভীরভাবে বিস্তৃত করবে বলে বলছেন পরামর্শকগণ।
এছাড়া কোরবানীর ঈদে ব্যাপক খানাপিনা চলে। ফকির মিসকিনরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাংস সংগ্রহ করে। প্রতিবেশি আত্মীয় বাড়িতে পাঠানো হয় কাঁচা মাংস। এগুলো উদ্বেগজনক হারে সংক্রমণ বিস্তারে সহায়তা করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গ্রাম ও বস্তি এলাকার অনেকের টিকার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করার জ্ঞান বা সুযোগ কোনটাই নেই। তারা কখনও টিকা দেয়ার সুযোগ নাও পেতে পারে। এখন গ্রামে ব্যাপক হারে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। যারা কিছুটা সচ্ছল শুধু তারাই হাসপাতালে যাচ্ছে, তবুও শেষ সময়ে। কোনরকমে শহরের হাসপাতালে গিয়েও অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। অক্সিজেনের সিলিন্ডার কেনার মত সময় ও সুযোগ কোনটাই পাচ্ছে না।
জুস কারখানার আগুনে পুড়ে মারা গেলে যদি মালিকের দায় থাকে তাহলে হাসপাতালে গিয়েও অক্সিজেনের অভাবে প্রাণবায়ু বের হয়ে গেলে, সেজন্য তার দায়ভার কি সরকারের উপর বর্তায় না?
বলা হচ্ছে, কোন মঙ্গা নেই, কেউ না খেয়ে নেই, খাদ্য সংকট নেই। কিন্তু যে হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে এবং বন্যার ঘনঘটা চলছে তাতে দুর্ভিক্ষ শুরু হতে কতক্ষণ? আফ্রিকার অনেক দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর কিছু ভূখা মানুষের জন্য প্যাকেটজাত খিচুড়ির ব্যবস্থা করেছে। চাহিদার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। এ মুহূর্তে সব শহর, গ্রাম-গঞ্জের হাতপাতা বুভুক্ষ মানুষের জন্য অনেক বেশি খাদ্য সাহায্য দরকার।
করোনার ভয়াবহতা যখন শীষের্, তখন লকডাউন শিথিল করা হলো। জীবিকার স্বার্থে না ব্যবসার স্বার্থে তা নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। তবে নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া শিথিলতায় ঈদের পরে ডেল্টার নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমণের তাণ্ডব যদি শুরু হয়ে যায় তাহলে চিকিৎসার কথা না ভেবে বুভুক্ষ মানুষের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে সরকারি বিশেষ বরাদ্দের টাকা দিয়ে লঙ্গরখানা খোলার কথা মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে এক্ষুনি। অন্তত খাদ্যাভাবে যেন স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর প্রাণহানি না ঘটে এবং দরিদ্রদের দুঃখ-শোক আর না বাড়ে। কারণ, অতিমারি করোনা কর্মহীন মানুষের পেটের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস