কোরবানির অর্থনীতি থাকুক নিরাপদ
করোনার সংক্রমণের এখন ঊর্ধ্বগতি। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু। জাতীয় পরামর্শক কমিটি যখন লকডাউন বাড়িয়ে কারফিউ জারির পরামর্শ দিয়েছে, সরকার তখন কঠোর বিধিনিষেধ এক সপ্তাহের জন্য শিথিল করেছে। এই বৈপরিত্য অনেককে অবাক করলেও এটাই বাস্তবতা। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দুটিই সঠিক। করোনা পরিস্থিতিতে পরামর্শক কমিটি যা বলেছে, তাদের পক্ষে অন্য কিছু বলা সম্ভব ছিল না। আবার সরকার যা করেছে, তার কোনো বিকল্প ছিল না। করোনাকালীন ঈদের অভিজ্ঞতা বলে যত চেষ্টাই করুক সরকার, মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যায় না। বরং বিধিনিষেধ থাকলে মানুষ যে কোনো উপায়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। অনুমতি থাকলে বরং স্বাস্থ্যবিধি মানানোর চেষ্টা করা যায়। তবে বিধিনিষেধ শিথিল করার মূল কারণ অর্থনীতি।
দুই ঈদ ঘিরেই দেশের অর্থনীতিতে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ঈদুল ফিতরে মূলত পোশাকের দোকানে ভিড় থাকে। ঈদুল আজহায় বদলে যায় চিত্র। কোরবানির ঈদ মানেই জমজমাট পশুর হাট। এ বছর দেশে এক কোটি ১৯ লাখ পশু তৈরি আছে। লকডাউন থাকলে এর বড় অংশই অবিক্রীত থাকার ঝুঁকি তৈরি হতো, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারতো। কোরবানিকে কেন্দ্র করে পশু কেনাবেচার বাজারটা ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার। শুধু পশু কেনা-বেচা নয়, বাংলাদেশের চামড়া শিল্পও কোরবানির ঈদনির্ভর। চাহিদার ৬০ ভাগ চামড়া আসে কোরবানির পশু থেকে। সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বড় ভিত।
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের বেশিরভাগ কোরবানির পশু আসতো প্রতিবেশী ভারত থেকে, তার বড় অংশ আসতো চোরাইপথে। নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে গরু আসার পথ বন্ধ করে দেয়। ২০১৪ সালের কোরবানির ঈদে কোরবানির পশুর দারুণ সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভারতের সে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য শাপেবর হয়েছে। সঙ্কটই সমাধানের পথ বাতলে দেয়। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ গরু পালনে স্বাবলম্বী হয়ে যায়। এখন চাহিদার পুরোটাই দেশে লালন-পালন হয়। এই পশু লালন-পালনকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। গ্রামে ঘরে ঘরে গরু-ছাগল পালন তো আছেই, গড়ে উঠেছে আধুনিক অনেক খামারও। এসব খামারে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পশু পালন করা হয়, যা বাজারে আসে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে। পাশাপাশি নিয়মিত চাহিদা তো আছেই।
গরু ব্যবসা যেমন বাংলাদেশের আদি, তেমনি গরু ব্যাপারীও। কিছু ব্যবসায়ী আছেন, যাদের মূল পেশাই গরু বেচাকেনা। সারা বছরই তারা গরু কেনাবেচা করেন। আবার কোরবানির ঈদের সময় অনেকে মৌসুমি গরু ব্যবসায়ী বনে যান। খামারিরা তো আছেনই। গরু ব্যাপারী যেমন আদি পেশা, তেমনি গরু চুরিও। তবে কোরবানি এলেই গরু ব্যবসায়ীদের নানারকম হয়রানির মুখে পড়তে হয়। ব্যবসাটা যত চাঙ্গাই হোক, গরু পরিবহন তত সহজ নয়। মূলত ট্রাকে গরু এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় নেয়া হয়। পশু পরিবহনে পথে পথে নানা ভোগান্তি হয়। চাঁদাবাজি তো আছেই, আছে নিরাপত্তা ইস্যুও। বিভিন্ন ফেরিঘাটে যানজটে দীর্ঘ সময় গরুবাহী ট্রাক আটকে থাকার খবরও ছাপা হচ্ছে পত্রিকায়। অবলা প্রাণী গরু তাদের অসুবিধার কথা বলতে পারে না। কিন্তু তীব্র গরমে ১০-১২ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা যে কারও জন্যই কষ্টের, এমনকি গরুর জন্যও। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার দারুণ উন্নতি হলেও গরু পরিবহনটা এখনও যথেষ্ট সংবেদনশীল হতে পারেনি।
সারাদেশেই কোরবানির পশুর বাজার রয়েছে। বড় বাজারটা অবশ্যই রাজধানীতে। করোনা সংক্রমণের মধ্যেও এবার রাজধানীতে ১৮টি পশুর হাটের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া গাবতলী ও সারুলিয়া দুটি স্থায়ী হাট রয়েছে। এছাড়া করোনার কারণে এবার অনলাইনে পশু কেনা-বেচার ব্যবস্থা হয়েছে। সাড়াও মিলছে ভালো। তবে হাটগুলোতে প্রচুর পশু এলেও ক্রেতা তুলনামূলকভাবে কম। অনেকেই হাটে ঘুরে দেখছেন, তবে কিনছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, করোনার কারণে অনেকেই এবার আগে গরু কিনে সেটা পোষার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। দেখে পছন্দ করে রাখছেন, হয়তো শেষ মুহূর্তে কিনে নেবেন। গরু ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এবার দাম নিয়ে তারা বিপাকে পড়বেন। যতটা লাভের আশায় বছরজুড়ে বিনিয়োগ করেছেন, ততটা নাও মিলতে পারে।
পুলিশের আগাম সতর্কতায় এবার গরু পরিবহন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। পথে নানা ভোগান্তি হলেও নিরাপত্তা ইস্যুতে খুব বেশি অভিযোগ নেই। ফেনীর ঘটনা সারাদেশের গরু ব্যবসায়ীদের আতঙ্কিত করেছে। ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম লুটে নিতে চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী শাহজালালের গরু। সব গরু লুটে নিলে শাহজালাল নিঃস্ব হয়ে যেতেন। তাই বাধা দিয়েছেন। তাতেই আবুল কালাম গুলি করে হত্যা করে শাহজালালের মরদেহ পুকুরে ফেলে দেয়।
এক সময়কার যুবদল নেতা আবুল কালাম এখন আওয়ামী লীগ নেতা। এই পরিচয়েই চলে তার মাস্তানি, চাঁদাবাজি, লুটপাট। আবুল কালামের দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তবে আবুল কালাম এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সারাদেশের গরু ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করতে অবিলম্বে আবুল কালামকে গ্রেফতার করতে হবে।
করোনার মধ্যে শত ঝুঁকি নিয়ে যারা বাড়িতে বা খামারে পশুপালন করেছেন, যারা এই পশু বিক্রির জন্য বাজারে তুলছেন, যারা কিনতে যাচ্ছেন; তাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। করোনার ঝুঁকি সত্ত্বেও যে অর্থনীতির বিবেচনায় লকডাউন শিথিল করা হলো, তা যেন ঠিকমতো শেষ হতে পারে। করোনায় অর্থনীতি যখন স্থবির, তখন পশুর কেনাবেচাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৮ জুলাই, ২০২১
এইচআর/জিকেএস