ই-কমার্স : প্রতারণার নতুন ফাঁদ
পরিবারে কথা উঠেছিলো অনলাইন কোম্পানি ইভ্যালি নিয়ে। আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই অনলাইনে মাইক্রোওভেন, ফ্রিজসহ নানান রকম পণ্য কিনেছেন। পণ্য কেনার দুইমাস অপেক্ষার পরও [কোম্পানির নিয়ম-নীতির শর্ত অনুযায়ী] যখন তা ঘরে আসেনি, তখন শঙ্কা বেড়ে যায়। তারা কি কেনা পণ্যটি পাবেন? এই প্রশ্নটি শেষে উদ্বেগে পরিণত হয়।
শুরু হয় ভাইবোনদের মধ্যে আলোচনা। তারপর সেই আলোচনায় যোগ হয় অফিসের সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব। ফলে এই সমস্যা চাউর হতে সময় নেয় না। এর মধ্যে ক্রেতা হয়তো একটা পণ্য পেয়ে স্বস্তি বোধ করেন। তখন বিশ্বাস ফিরে আসে অন্তরে। তিনি সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে বিদায় দিয়ে জানান দেন কোম্পানি পণ্য দিয়েছে। দুই মাস/ তিন মাস দেরি হয়েছে বটে, কিন্তু তারা তো প্রায় অর্ধেক দামে পণ্যটি কিনেছিলেন। তার কেনা আরো দুই/তিনটি পণ্য কিন্তু এখনো পাননি। পাবেনই, এই রকম আত্মবিশ্বাস জন্মে তার মধ্যে।
গত ৬ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কমার্স সংক্রান্ত একটি নীতিমালা জারি করেছে। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে অনলাইনে কেনার সময়ই বিক্রেতাকে বলতে হবে যে, ক্রেতা শহরের হলে ৪দিনের মধ্যে ও গ্রামাঞ্চলে হলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য পৌঁছাতে হবে। ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানোর রিসিভিং রিসিট অনলাইনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে, তারা বিক্রেতাকে টাকা দেবে, তার আগে নয়।
বোঝা গেলো সরকার ই-কমার্স সম্পর্কে সজাগ হয়েছেন। এর আগে সরকার সজাগ-সচেতন, এমনটা কখনোই বোঝা যায়নি বা দেখিনি। গ্রাম দেশে একটা কথা খুব চালু আছে। তাহলো : চোর গেলে [গেরস্থের] বুদ্ধি বাড়ে।’ কথাটা যে কতোটা সত্য, তা প্রমাণের জন্য সমুদ্র হাতড়াতে হবে না। আজকের[ ০৭ জুলাই, ২০২১] কালের কণ্ঠ পত্রিকায় পড়েছি একটি রিপোর্ট : অনলাইন প্রতারণা : ১৭ হাজার কোটি টাকা পাচার’। ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ বেহাত হয়ে যাওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তাদের খেয়াল হয়েছে যে, লুপটে হয়ে যাচ্ছে ক্রেতা-জনতার টাকা। আসলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নন, এই প্রতারণার জালটি উদ্ধার করেছে সরকারেরই বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা বিভাগ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখার [সিআইসি] যৌথ নজরদারির ফলে।
এই রিপোপোর্ট যা বলছে তাতেই বোঝা যায় সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক এতোদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। কথাটা বললাম এ-কারণে যে, ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন তো দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যখন কোনো কোম্পানি অনলাইনে ব্যবসার জন্য আবেদন করেছে তখনই তো বাংলাদেশ বাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টনক নড়ার কথা। তৈরি হবার কথা এতদ্সংক্রান্ত নীতিমালা। সেই নীতিমালার আলোকেই তো ই-কমার্স চলবে। কিন্তু সেটা হয়নি।
আজকে যখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা থেকে একটি চিঠি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দেবার পর জানা গেলে দেশের ৫৪টি অনলাইন প্রতিষ্ঠান টাকা পাচারের সাথে জড়িত। তারা প্রতারণা করে এর মধ্যেই হুন্ডি ও বিট কয়েনের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। তার পরিমান ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। গত ৬ মাস ধরে অনলাইন ব্যবসায়ীদের কার্য়ক্রমে নজরদারি করছিলেন। উল্লিখিত ৫৪টি ওয়েবসাইট নির্ভর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বন্ধ করা হয়েছে। এদের একজনকে আটক করা হয়েছে। বাকিদের আটক করা হয়েছে কি না জানা যায়নি। আমাদের ধারণা দোষী ওয়েব সাইট বন্ধ করে দেবার আগে সেগুলোর মালিকদের আটক করা হলে, প্রতারকদের পাচারকৃত অর্থও ফেরৎ আনা যেতো।
২.
আমাদের সরকারি অফিসের আমলারা দক্ষ নয়, এটা শাদা চোখে দেখা অবস্থা থেকেই বলা যায়। কিংবা আমলা নির্ভর প্রশাসনটি এতোটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য যে তা দিয়ে কোনো স্বাধীন দেশের প্রশাসন চালানো যায় না। যুগটা যে পাল্টে গেছে, আমরা যে ‘ডিজিটাল যুগে বাস করছি, সরকার সেটা সগৌরবে ঘোষণা করলেও তার জন্য যেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বা তা আপ টু ডেট করারও কোনো প্রয়াস আছে বলে মনে হয় না। কোনো ছেঁড়া শার্ট জোড়াতালি দিয়ে, সুঁই-সুতো দিয়ে শেলাই করে হয়তো চালানো যায়। কিন্তু কোনো প্রশাসনযন্ত্র, যা শত বছরের পুরোনো, তা দিয়ে স্বাধীন দেশের শাসন কায়েম করা যায় না। এটা ভাবনার সময়-কাল ধীরে ধীরে হলেও চলে যাচ্ছে। গোটা ব্যবস্থাটি যে ঢেলে সাজানো উচিত, শুধু ডিজিটাল তকমা দিয়ে প্রশাসন চালালো যায় না।
৩.
ডেসটিনি’র কথা মনে আছে। একধরনের সোসাল বিজনেসের কথা বলে তারা এই অনলাইন ব্যবসার মতোই চাকরি প্রত্যাশীদের চোখের সামনে বিরাট লাভের মুলো ঝুলিয়ে দিয়েছিলো। ওই ডেসটিনির এরা নব্য ও আধুনিক স্মার্ট সংস্করণ। ওয়েবসাইট খুলে প্রলোভণের মুলো ঝুলিয়ে দিয়ে ক্রেতা-জনতার পকেট থকে লুটে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সরকার এখন পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরৎ আনবেন কেমন করে? আমার জানা নেই। নিশ্চয়ই সরকারি কর্মকর্তাদের তা জানা আছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশের ২শ অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নজর রাখছে। সেটা একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু সৃজনী প্রতিভার অধিকারী অনলাইন ব্যবসায়ীদের আরো বহুধরণের ফাঁদ আছে, যার কোনো খবরই তারা হয়তো জানতে পারছেন না। এ-ব্যাপারে তাদের আরো সজাগ ও সতর্ত হতে হবে।
আমার একটি অভিজ্ঞতা আছে অনলাইনে কেনার। সেটা নিউ ইয়র্কের ঘটনা। বিখ্যাত আমাজন থেকে পণ্য কিনতে গেলে একটা অ্যাকাউন্ট করতে হয়। আমারও ছিলো। একাউন্ট করতে কোনো টাকা লাগে না। পণ্য সিলেক্ট করার পরে পেমেন্ট মুড কি হবে তা জানতে চায়। তারপর পণ্য আজকেই ডেলিভারি চান নাকি কালকে চান, নাকি ৭২ ঘন্টার মধ্যে, নাকি সাত দিনের মধ্যে চান, সেটা জানতে চায়। এ সব জানার পর তার বাসার ঠিকানা দিয়ে ক্রেডিট/ডেভিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট দিতে হয়। কেনা হলে গ্রাহককে জানানো হয় ডেলিভারির শিপিং নম্বর। কেতা ওই ডেলিভারি নম্বরের মাধ্যমে শিপিংয়ে পণ্যটি কোনো স্ট্যাটাসে আছে, জানতে পারে। সাধারণত, ডেট ও টাইম অনুযায়ী পণ্য আমাজনের নিজস্ব গ্রাইন্ড কাভার্ড ভ্যানের চালক তা স্ক্যানারে স্ক্যান করে দোরগোড়ায় রেখে যায়। এর ব্যত্যয় খুবই কম ঘটে থাকে।
এই প্রক্রিয়া জানানোর পেছনে আছে একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। তাহলো : প্রত্যেক অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়্যার হাউজ থাকতে হবে। থাকতে হবে ডেলিভারি ভ্যান ও দক্ষ কর্মীবাহিনী, যারা ঢাকা মহানগর ও দেশের সব শহর ও উপজেলা পরযায়ে পণ্য যথাসময়ে ডেলিভারি দিতে পারে। আমরা বলবো, সরকার যদি সত্যই ই-কমার্সের উন্নতি চান, তাহলে এর পূর্ণাঙ্গ নীতিমাল,যা হবে যুগোপযোগী ও অগ্রগামী চিন্তার, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখনই এই ই-কমার্স-এর রাশ টেনে ধরা জরুরি। নীতিমালার বাইরে, এদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। আর সব অনলাইন বিজনেস স্থগিত করে নতুন নীতিমালার আলোকে তাদের পুনরায় তাদের বিজনেস চালু করতে পারেন। সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত ব্যবসাই কেবল একটি জাতির অর্থনৈতিক উন্নতির পথে সহযোগ দিতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, সাবেক সহযোগী সম্পাদক,দৈনিক যুগান্তর, কবি, ক্রিটিক্যাল চিন্তক।
এইচআর/জিকেএস