চট্টগ্রামের সিআরবি ধ্বংস অপরিণামদর্শী হবে
অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটি শহর ছিল চট্টগ্রাম! বলা হতো প্রাচ্যের রানি। পাহাড়, সমতল, নদী, সমুদ্র মিলে একাকার। পৃথিবীতে এমন কম্বিনেশনের শহর অনেক কম। অথচ চট্টগ্রামের সঙ্গে জলাবদ্ধতার সম্পর্ক এমন হয়েছে যে, বর্ষা এলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। পানি কবে নামবে সে প্রহর গুনতে হয় তাদের। একদিকে জোয়ারের পানি, আরেক দিকে বৃষ্টির পানি- দুটি মিলে নগরজীবনের নাভিশ্বাস। এই যখন অবস্থা তখন শ্বাসটাও বন্ধ করতে নেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ভবন (সিআরবি) এলাকায় হাসপাতাল তৈরির প্রকল্প।
১৮৯৫ সাল থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ বেঙ্গল রেলওয়ের সদরদফতর এবং বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদরদফতর সিআরবি। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ সিআরবি অনন্য সুন্দর ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা একটি এলাকা। সবুজে ঘেরা সারি সারি সুবিশাল বৃক্ষ। কোনো গাছের বয়স একশ বছর। কোনোটির বয়স তারও বেশি। বয়সের ভারে এ বৃক্ষগুলো ন্যুব্জ হয়নি বরং শত বছরেও ধরে রেখেছে তাদের সজীবতা।
ঐতিহ্যমণ্ডিত বৃক্ষরাজিবেষ্টিত সিআরবি এলাকা চট্টগ্রামের লোকদের জন্য ঢাকার রমনা উদ্যানের মতো। শত শত মানুষ সেখানে বিকেলে ঘুরতে যায়, সকালে শরীরচর্চার জন্য হাঁটতে যায় সেখানে। গত মার্চ মাসে আমাকেও যেতে হয়েছিল সেখানকার একটি সুসজ্জিত মসজিদে একটি আকদ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। মুগ্ধ হয়েছিলাম ছোটকালে দেখা রূপ সিআরবি এখনও ধরে রেখেছে বলে। সাত রাস্তার মাথায় তরুণ-তরুণীদের কোলাহল ঢাকার ধানমন্ডি লেক বা টিএসসির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে আমাকে।
যদিও এখন চট্টগ্রাম শহরে গেলে আমার মনে হয় উন্নয়নের ঠেলায় এটি মৃত প্রাচ্যের রানি। নব্বইয়ের পর থেকে সিটি করপোরেশন, সিডিএর কর্তা চোররা শহরটাকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করে মেরে ফেলেছে। একটুখানি নিশ্বাস নেয়ার জায়গা ছিল ডিসি হিল, ফয়’স লেক আর সিআরবি। ডিসি হিলকে ডিসিরা তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি বানিয়েছেন। সেখানে আগে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হতো, তা এখন হতে দেয় না। ফয়’স লেক দেয়া হয়েছে বেনিয়াদের হাতে, যারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকাটিকে হতশ্রী করে তুলল। এবার সিআরবি ধ্বংসের পালা।
পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে সিআরবি এলাকায় ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল এবং ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এই লক্ষ্যে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে ইউনাইটেড হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে রেলওয়ে।
তথ্যটি এতদিন আড়াল থাকলেও সম্প্রতি সিআরবি এলাকায় ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ সাইনবোর্ড লাগিয়ে হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের পরিবেশবাদীরা। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে।
রেলওয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেছে। তারা বলছে, হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য সিআরবি রেলওয়ের নিজস্ব হাসপাতালের পাশে গোয়ালপাড়া এলাকাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। মোট ছয় একর জায়গার ওপর হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানে বর্তমানে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতিপুরাতন ও জরাজীর্ণ বাসাবাড়ি রয়েছে। ওই স্থানে বসবাসরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইতোমধ্যে অন্যত্র বাসা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যারা বাকি রয়েছেন তাদেরও পর্যায়ক্রমে অন্যত্র বাসা বরাদ্দ দেয়া হবে।
প্রকল্প এলাকায় শতবর্ষী কোনো গাছ নেই, ওই স্থানে বিদ্যমান গাছ এবং ভূমিরূপের অবয়ব ঠিক রেখেই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে। সিআরবি শিরীষতলা এলাকা ও সাতরাস্তার মোড়ে শতবর্ষী গাছ রয়েছে। ওই স্থানটি এই প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত জায়গা নয় বিধায় শতবর্ষী গাছগুলো কাটা বা বিনাশের কোনো আশঙ্কা নেই।
তারা এক বিবৃতিতে আরও বলেন, শিরীষতলায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে সিআরবি এলাকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ ও শিরীষতলায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা বা বিঘ্ন ঘটবে না।
কিন্তু তাদের এ দাবি হাস্যকর। একটি ৫০০ শয্যার হাসপাতাল আর ১০০ আসনবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ বানালে তার প্রবেশ এবং বাহির কত বড় হবে, কেমন কোলাহল হবে সেখানে- অনুমান করতে পারছেন না তারা। এসব স্থাপনা তৈরিকালে সেখানে বড় বড় যন্ত্রের আগমন আর হাসপাতাল-কলেজ প্রতিষ্ঠার পর যান্ত্রিক কোলাহল কি সিআরবিকে আগের দৃশ্যে নিয়ে যেতে পারবে!
কেউ যদি বলে রমনা পার্কের মধ্যে বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি হাসপাতাল এবং কলেজ করবে- তা পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না- এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে? সিআরবিতে রেলওয়ের একটি হাসপাতাল ইতোমধ্যে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। সেটিও ব্যাপক জায়গা নিয়ে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুসারে সে হাসপাতাল নতুন প্রকল্পের বাইরে আছে। সেখানে যদি হাসপাতাল করা জরুরি হয় ইতোমধ্যে যা আছে তাকে তো আধুনিক করতে পারে কর্তৃপক্ষ। তার জন্য যদি বাড়তি জায়গার দরকার হয় তাও তারা নিতে পারে। কিন্তু নতুন করে আরও ছয় একর জায়গা দখল করে সেখানে প্রচুর সংখ্যক নতুন গাছ এবং দু-একটি শতবর্ষী গাছ কেটে আরেকটি হাসপাতাল ও কলেজ তৈরির দরকার তো পড়ে না।
এ নিয়ে মিডিয়ায় রেলমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য আমার চোখে পড়েনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার উক্তি হিসেবে কিছু কথা এসেছে সেগুলো সত্যি যদি তার হয় তাহলে ঔদ্ধত্যপনা তার সীমাহীন বলতে হবে। চট্টগ্রামের লোকজন স্বাধীনচেতা, তাদের মতকে উপেক্ষা করে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে তিনি হাসপাতাল- কলেজ বানাতে পারবেন না।
তাছাড়া চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায় সিআরবি এলাকাকে উন্মুক্ত স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং চট্টগ্রাম নগরীর সব পাহাড়-টিলাকে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করে সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত রক্ষিত অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা আছে। কারও মতের তোয়াক্কা না করে রেলমন্ত্রী যদি পণ করেন যে সেখানে হাসপাতাল তৈরি করবেন- সেটার পরিণাম সুখকর হবে না।
ইতোমধ্যে প্রকল্পটি বাতিলের দাবিতে পুরো চট্টগ্রাম ফুসে উঠেছে। প্রতিদিন সিআরবিতে সমাবেশ হচ্ছে। আগামী শুক্রবার বৃহত্তর কর্মসূচি পালন করা হবে সেখানে। প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণে সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে শুধু চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিক-জনতা নন, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। এ নিয়ে বুধবার (১৪ জুলাই) পরিবেশ ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট পাঁচটি সংগঠন- বেলা, বাপা, এএলআরডি, নিজেরা করি এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষে নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
আশা করছি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকলা এবং ইতিহাসসমৃদ্ধ সিআরবি এলাকায় একটি হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও আরেকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের দীর্ঘমেয়াদি এবং অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও সরকার সরে আসবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]
এইচআর/এএসএম