ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অসাম্প্রদায়িকতা ও নারীমুক্তি আন্দোলন
২০২১ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন। আমরা জানি, এই শিক্ষায়তনের রয়েছে উচ্চশিক্ষার অগ্রযাত্রায় এক ঐতিহাসিক অনন্য সাধারণ ভূমিকা। মূলত এ অঞ্চলে মুসলিম ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জন্মসূত্রেই পেয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতার অবিনাশী চেতনা। এখানেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব। যেই মহান ব্যক্তির হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি হলেন প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ হার্টগ। রসায়নের শিক্ষক এই ক্ষণজন্মা মানুষটি ছিলেন একজন ভিনদেশি; জাতিগত পরিচয়ে ছিলেন তিনি একজন ব্রিটিশ। ধর্মীয় পরিচয়ে তিনি ছিলেন ইহুদি। তিনি শুধু এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় সংগঠক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন সংস্কারক ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব।
তিনি সর্বান্তকরণে চেয়েছিলেন পূর্ব বাংলায় একটি জ্ঞান বিভাসিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠুক, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে। বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে সংঘটিত ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিভিন্নভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় বাধাগ্রস্ত করেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবনে এর আরও নেতিবাচক অভিঘাত ছিল। ১৯৪৭-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বড় একটা দুঃসময় গেছে। ১৯৪৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বাধে এবং এই দাঙ্গার পটভূমি ছিল ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টি। ফলে পরিস্থিতি হয়ে পড়েছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। ১৯৪৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে আর্মানিটোলার মেয়েদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্ব-স্ব গৃহে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করতে অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল। সচেতন নাগরিক হিসেবে আর্মানিটোলার ড. ব্রজমোহন বিশ্বাস তার বোনের নিরাপদে বাসায় ফেরার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সম্পর্কে উপাচার্য ড. মাহমুদ হাসানকে টেলিফোন করেছিলেন। তাহলেই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়েছিল।
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় বলে সাম্প্রদায়িকতার বীজ অবিনাশী, কোনোভাবে একবার জাগ্রত হলে সহজে নিবারণ করা কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সম্পর্কে তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ সংবাদ পরিবেশন করেছিল এভাবে, “মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের সকল স্কুল ও কলেজ বন্ধ ছিল। এই দিন প্রাতে উভয় সম্প্রদায়ের ছাত্রদের এক বিরাট শোভাযাত্রা বাহির হয় এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য ধ্বনি করিতে করিতে শোভাযাত্রা বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ করে। তাহারা জনসাধারণকে আত্মঘাতী ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব হইতে নিবৃত্ত থাকিতে অনুরোধ জানায়। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রগণ পুনরায় এক সম্মিলিত শোভাযাত্রা করিয়া হিন্দু ও মুসলমান নাগরিকদের নিকট যে কোনো উপায়ে পারস্পরিক হানাহানির অবসান ঘটাইয়া ঢাকা নগরীর লুপ্ত গৌরব ফিরাইয়া আনিবার জন্য আবেদন জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মোটরে চড়িয়া শোভাযাত্রীদের সহিত পরিভ্রমণ করেন। ছাত্রদের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ নাগরিকদের মনে আস্থার সঞ্চার করিয়েছে বলিয়া মনে হয়। দৈনন্দিন কাজকর্ম অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিতেছে।”
তাহলে উৎকলিত সংবাদ বিবরণী থেকে বুঝতে পারা যায়, ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার প্রভাব বহুদিন বিদ্যমান ছিল এবং সেটার প্রভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিল। এই দাঙ্গার পরপরই পূর্ব বাংলা হতে বহু সংখ্যক হিন্দু ভারতে অভিবাসী হতে শুরু করে এবং এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলে। পূর্ব বাংলার অধিবাসী হিন্দুদের উদ্বাস্তু হিসেবে ভারত গমনের সময়ও তাদের ওপর অত্যাচার চলে। ১৯৪৮ সালে এরই প্রতিবাদ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীদ্বয়ের একজন বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাগ। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তু হিসেবে ভারতে অভিবাসন হয় পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলা হতে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ১৯৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে যেখানে হিন্দু ছাত্রীর সংখ্যা ছিল (নতুন ভর্তি) ৪৩ জন, ১৯৪৯-৫০ শিক্ষাবর্ষে তা হয়ে যায় মাত্র দুজন। আমরা কী এ কথা জানি, ১৯৫০ সালের পর বেশ কয়েক বছর কোনো হিন্দু ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হয়নি।
২.
বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইউনিয়ন বা ছাত্রী পরিষদের বার্ষিক সভার আয়োজন করা হয় কার্জন হলে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নবগঠিত ইউনিয়নের অভিষেক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে পূর্বে প্রচলিত নিয়মানুসারে মঞ্চের ওপর স্থাপন করা হয় একটি ‘মঙ্গল ঘট’। অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিখ্যাত সংগীত ‘বন্দে মাতরম্’-এর মাধ্যমে। উল্লেখ্য, যে ‘বন্দে মাতরম্’ ইতোমধ্যে পরিণত হয়েছিল এক সর্বভারতীয় ঐক্য গীতিতে। ঢাকা হতে প্রকাশিত সমসাময়িক সাপ্তাহিক পত্রিকায় এ বিষয়ে ‘বন্দে মাতরম্ গানে বিপত্তি’ শিরোনামে এই তথ্য পরিবেশিত হয়- “১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি রবিবার অপরাহ্নে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সমিতির কার্য নিবার্ হিক কমিটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়। এই অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত গীত হয়। প্রায় ১০ মিনিট কাল পরে একজন মুসলমান ছাত্র ভাইস চ্যান্সেলর ডা. হাসানকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি কেন ‘বন্দে মাতরম্’ গান করিবার অনুমতি দিলেন?
মঞ্চোপরি উপবিষ্ট ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় ছাত্রীটিকে নিরস্ত হইতে অনুরোধ করিয়া বলেন, ‘এটি ছাত্রীদের অনুষ্ঠান; সুতরাং আগে ইহার কার্য শেষ হোক; পরে এই প্রশ্নটি সম্বন্ধে আলোচনা করা যাইবে।’ কিন্তু বাধাদানকারী ছাত্রটি জিদ করিতেই লাগিলেন। তখন সমবেত ছাত্রগণ দুই দলে বিভক্ত হইয়া ভাইস চ্যান্সেলরের উপস্থিতিতেই বচসা আরম্ভ করে এবং পরস্পর পরস্পরকে চেয়ার ছুড়িয়া মারিতে থাকে। ক্রমে হলের বাহিরেও হাঙ্গামা বিস্তৃত হয় এবং হকিস্টিক ও সোডার বোতল বেপরোয়া চলিতে থাকে। ভাইস চ্যান্সেলর দাঙ্গা থামাইবার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেন নাই; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি অকৃতকার্য হন। পরে সশস্ত্র পুলিশ আসিয়া শান্তি স্থাপন করে। আহত ছাত্রদের মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে পাঠাইতে হয়। ঐদিন সশস্ত্র পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে পাহারা দেয়।”
উল্লেখ্য যে, ‘ঢাকা প্রকাশ’ সাপ্তাহিকীতে প্রকাশিত এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির বিবরণীতে এ সম্পর্কে আরও কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যায়। তদন্ত কমিটির বিরবণীও ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যেখানে ঘটনা সম্পর্কে বলা হয় : “৩১শে জানুয়ারি তারিখে কার্জন হলে উইমেন্স ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশন হয়। ভাইস চ্যান্সেলর সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। বন্দে মাতরম্ সঙ্গীতের পর সভার কার্য আরম্ভ হয়। ইহাতে কোন প্রকার আপত্তি করা হয় নাই। কিন্তু পরে একজন মুসলমান (সম্ভবত ছাত্র) দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করে যে পূর্ববর্তী বৎসরের অধিবেশনে ডা. মজুমদার ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত গীত হইবে না বলিয়া প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও কেন এই বৎসর এইরূপ করা হইল। ভাইস চ্যান্সেলর বলেন যে, তাঁহার পূর্ববর্তী ভাইস চ্যান্সেলর এইরূপ কোন প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন বলিয়া তিনি জানেন না এবং এই বিষয়ে তিনি অনুসন্ধান করিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দেন। প্রশ্নকর্তা এই উত্তর অসন্তোষজনক বলিয়া বিবেচনা করে এবং বিশৃঙ্খলার মধ্যে সভা ভাঙ্গিয়া যায়।”
ওই ঘটনার দুদিন পরে ২ ফেব্রুয়ারি খুব সকালে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের তদানীন্তন প্রাধ্যক্ষ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন তৎকালীন উপাচার্য ড. মাহমুদ হাসানকে জানিয়েছিলেন যে তিনি ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ হতে এই মর্মে টেলিফোন পেয়েছেন যে উভয় সম্প্রদায়ের ছাত্রবৃন্দ উত্তেজিত এবং যে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে পারে। প্রাধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় কিছুদিন বন্ধ রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু উপাচার্য মাহমুদ হাসান ঘটনার গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন এবং এর ফলে ছাত্রদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাধে। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় ১৬ জন ছাত্র আহত হয়, যাদের মধ্যে ৮ জন হিন্দু ও ৮ জন মুসলমান। আহতদের মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র নাজির আহমদ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে অতীব মর্মান্তিক। পাঠকবর্গ অবশ্যই লক্ষ্য করবেন যে ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকার জন্য অজিত নাথ ভট্টাচার্য প্রাণ বিসর্জন দেন, আর ১৯৪৩ সালে ঔপনিবেশিক শক্তি সৃষ্ট রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ বিসর্জন দেন নজীর আহমদ। উভয় ঘটনার উৎসস্থল একই। যাই হোক, এ ঘটনার সময় অর্থাৎ ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় কিছু সংখ্যক ছাত্রী লাঞ্ছিত হন। উর্দু রোডের বাসিন্দা ব্রজেন্দ্র কৃষ্ণ সেনগুপ্ত-এর কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ বিএ ক্লাসের ছাত্রী তৃপ্তি সেনগুপ্ত-এর গলা থেকে সোনার হার এই ঘটনার সময় ছিনিয়ে নেয়া হয়।” ঘটনাটির সত্যতা সম্পর্কে ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় ও বিশ্ববিদ্যালয় নথিপত্রে তথ্য পাওয়া যায়।
৩.
১৯৪৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পর ১০০ বছরের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এরূপ ঘটনা ঘটেনি। ওই রকম দুভার্গ্যজনক ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মারাত্মকভাবে চিন্তিত করে তুলেছিল। জরুরিভিত্তিতে ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকরী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সকল আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৪৩ সালের ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী পরিষদে ‘মঙ্গল ঘট’ প্রদর্শন ও ‘বন্দে মাতরম্’ সম্পর্কে এইচ. ডি. নর্থফিল্ড ও অধ্যাপক জে. কে. চৌধুরী যুগ্মভাবে প্রস্তাব করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে এমন কোনো কিছু প্রদর্শন বা পরিবেশন করা যাবে না, যা কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চেতনার পরিপন্থী। কিন্তু প্রস্তাবটি খুব স্পষ্ট না হওয়ায় ঢাকা বিভাগের কমিশনার এ. এস. লারকিন ও এ. এফ. রহমান নতুনভাবে প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে কিছু সংশোধন ও সংযোজনের সুপারিশ করেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও অধ্যাপক পি. সি. ঘোষ। ১৯৪৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে যে ‘শহীদ নজীর আহমদ দিবস’ পালিত হয় সেখানে সভাপতিত্ব করেন বাংলার আইন সভার সদস্য ও খাজা নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী তমিজুদ্দীন খান (১৮৮৯-১৯৬৩)। এই সভায় অন্যান্য বক্তা ছিলেন নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯৩-১৯৬৩), আজাদ পত্রিকার সহ-সম্পাদক মুজিবুর রহমান খা (১৯১০-১৯৮৪) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
১৯৪৭ সালের দাঙ্গার প্রভাব বহুদিন বিদ্যমান ছিল। এই দাঙ্গার পরপরই পূর্ব বাংলা হতে বহু সংখ্যক হিন্দু ভারতে অভিবাসী হতে শুরু করে এবং এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলে। পূর্ব বাংলার অধিবাসী হিন্দুদের উদ্বাস্তু হিসেবে ভারত গমনের সময়ও তাদের ওপর অত্যাচার চলে। ১৯৪৮ সালে এরই প্রতিবাদ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীদ্বয়ের একজন বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাথ। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তু হিসেবে ভারতে অভিবাসন হয় পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলা হতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ১৯৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে যেখানে হিন্দু ছাত্রীর সংখ্যা ছিল (নতুন ভর্তি) ৪৩ জন, ১৯৪৯-৫০ শিক্ষাবর্ষে তা হয়ে যায় মাত্র দুজন। ১৯৫০ সালের পর বেশ কিছুদিন কোনো হিন্দু ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হয়নি। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আবার শুরু হলো। প্রথম ঘটনা ঘটে খুলনার কালিশিরা গ্রামে। তারপর ছড়িয়ে পরে বরিশাল, ফরিদপুর ও ঢাকায়। প্রতিশোধ হিসেবে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সূচিত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই দাঙ্গা ছিল স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম।
পরিস্থিতি এতই মারাত্মক ছিল যে পূর্ববঙ্গের তফসিলি ফেডারেশনের নেতা ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আইন ও শ্রমমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল (১৯০৪-১৯৬৮) অসহায় অবস্থায় কলকাতায় চলে আসেন এবং এখান থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। ১৯৫০ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দাঙ্গার প্রভাব সম্পর্কে এ. জি. স্টকের স্মৃতিকথায় বেশকিছু তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় ১০ ফেব্রুয়ারি। লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানি ঘটে অনেক। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সেনাবাহিনী নামানো হয় এবং সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে ইতোমধ্যে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারী সচেতন হবার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিজদের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেনি; বরং মুসলমান ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারী হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। সরকারি নির্দেশের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। কোনো কোনোদিন ক্লাস হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ ক্লাসে যোগদান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে বসবাসরত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারীগণ ছিলেন অসহায়।
১৯৫০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চারুপমা বসু পুনরায় ছাত্রীনিবাসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন; কিন্তু তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি যে ঢাকার অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ সালের পরে পূর্ব বাংলায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণভাবে হিন্দুবিরোধী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ই ছিল এই দাঙ্গার একমাত্র শিকার। যাই হোক, অবস্থা একটু স্বাভাবিক হলে হিন্দু শিক্ষকবৃন্দ কর্মস্থল থেকে ছুটি নেবার আবেদন করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাউকেই এক সপ্তাহের বেশি ছুটি অনুমোদন করেননি। যাই হোক, ১৯৫০ সালের ২২ এপ্রিল চারুপমা বসু ছাত্রী নিবাসের সুপারিনটেনডেন্ট-এর পদ হতে অব্যাহতি নেন এবং দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ইংরেজি বিভাগের কৃতী ছাত্রী চারুপমা বসু ১৫ বছর শিক্ষাদান করে তার নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন সাম্প্রদায়িকতার জন্য। ১৯৫১ সালে বিদেশি অধ্যাপিকা এ. জি. স্টকও অবস্থা সুবিধাজনক নয় মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানে বাধ্য হলেন। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। এর প্রধান কারণ ছিল অভিজ্ঞ ও প্রবীণ হিন্দু শিক্ষকের দেশত্যাগ। বাংলা বিভাগের অবস্থা একই করুণ ছিল যে ১৯৫০ সালেই ইডেন কলেজের অধ্যাপিকা খোদেজা খাতুনকে খণ্ডকালীন শিক্ষকের পদ গ্রহণ করার জন্য রেজিস্ট্রার শিক্ষা সচিবকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
৪.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাট্যচর্চার সূচনা হয় সমাজসেবার প্রয়োজনে। ১৯৩১ সালে সংঘটিত প্রলয়ঙ্ককরি বন্যা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগণ বন্যাপীড়িত অঞ্চলে ত্রাণকার্য পরিচালনা করে। জাতীয় দুর্যোগে নারী শিক্ষার্থীগণ ত্রাণ তহবিলে অর্থ সংগ্রহের জন্য একখানা নাটক মঞ্চস্থ করতে উদ্যোগী হন। নিয়মানুযায়ী তারা নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তাব ছাত্রীনিবাসের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়িকা সুজাতা রায়ের নিকট পেশ করেন। সুজাতা রায় ছাত্রীদের নাটক করার প্রস্তাব ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। এর প্রধান কারণ ছিল তৎকালীন পরিস্থিতিতে সামাজিক সমালোচনার ভয়। সুজাতা রায়ের মতে, জনগণ বা ছাত্রদের সম্মুখে ছাত্রীবৃন্দ নাট্যমঞ্চে আবির্ভাবের বিষয়টি তীব্র সামাজিক সমালোচনার সৃষ্টি করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ছাত্রীনিবাসের ছাত্রীবৃন্দ তাদের তত্ত্বাবধায়কের নিকট একটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি ছিল এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসিক ছাত্রীবৃন্দ নাটকটি মঞ্চস্থ করবেন।
ছাত্রীনিবাসের তত্ত্বাবধায়িকা সুজাতা রায় এ প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপাচার্যের পরামর্শ কামনা করে লেখেন যে, ‘‘এ সময় উপাচার্য জি. এইচ. ল্যাংলির অনুপস্থিতিতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডব্লিউ. এ. জেনকিংস ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য। তিনি সুজাতা রায়ের চিঠিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেন। জেনকিংস ছাত্রীদের ত্রাণ তহবিল গঠনের উদ্যোগকে উৎসাহিত করেছেন, তবে নাটকের দর্শক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। জেনকিংসের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো ছাত্রীই ত্রাণ তহবিলে অর্থ সংগ্রহের জন্য নাটক বা অনুরূপ যে কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ছাত্রীনিবাসের তত্ত্বাবধায়িকার সম্মতি প্রয়োজন। তবে টিকিট বিক্রয় বা আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকা নগরীর কলেজসমূহের অধ্যক্ষগণ, প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকবৃন্দ এবং মহিলাদের মধ্যে সীমিত রাখা বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মনে করেন। অধ্যাপক জেনকিংস ৭৫০ খানার বেশি টিকিট বিক্রয় না করার পরামর্শ দিয়ে লেখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছরের ইতিহাসে নারী প্রগতির জন্যে কৃতীমান নারী লড়াই করেছেন এবং যোগ্যতার সাক্ষর রেখেছেন। তার মধ্যে কয়েকজনের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লিখতে গেলে লীলা নাগের কথা উল্লেখ করতেই হবে।
লীলা নাগ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন। তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী ছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে এমএ ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী। তখনকার পরিবেশে সহশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলে লীলা রায়ের মেধা ও আকাক্সক্ষা বিচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চান্সেলর ড. হার্টস তাকে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন। দেশভাগের দাঙ্গার সময় তিনি নোয়াখালীতে গান্ধিজীর সাথে দেখা করেন। তিনি দিপালী সংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। আরেকজন কৃতীমান আলোকিত নারীর কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। ফজিলতুন্নেসা জোহা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ও ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এ হিসেবে তিনি দেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ (১৯৪৮-৫৭)।
তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে গণিত শাস্ত্রে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট) হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯২৮ সালে বিলেতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা গ্রাজুয়েট। উপমহাদেশে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিলেত থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন। যে সময়টাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন ইতিহাসের বিবেচনায় তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তার প্রকাশিত লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- মুসলিম নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, নারী জীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ, মুসলিম নারীর মুক্তি ইত্যাদি প্রবন্ধ (মুসলিম নারীর মুক্তির জন্য যে লেখা ‘সওগাত’ ও ‘শিখা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন)। নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলক্ষে ‘বর্ষা-বিদায়’ নামক একটি কবিতা লিখেছিলেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রথম মুসলমান ছাত্রী আনোয়ারা খাতুন (১৯১৭-১৯৮৮) নিঃসন্দেহে জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রথম অবিভক্ত বাংলা ও পরে পূর্ব বাংলার আইন সভার সদস্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্র ও জনতার ওপর পুলিশের গুলি বর্ষিত হয় এবং বরকত, জব্বার ও সালাম শহীদ হন তখন আইন সভার অধিবেশনে আনোয়ারা খাতুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বারংবার আইন সভার স্পিকারকে ঘটনাস্থলে পরিদর্শনের আহ্বান জানান এবং তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে আনোয়ারা খাতুন আইন পরিষদ বর্জন করে ছাত্র-জনতার নিকট চলে আসেন।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে ২৩ আগস্ট ১৯৪৭ ‘বেগম’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। মোহসেনা ইসলাম নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে ওই প্রবন্ধ সে-সময় খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে লেখিকা সহজ ভাষায় অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র আট (০৮) দিনের মাথায় তিনি এই লেখা লিখেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী নাদেরা বেগম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন । তাঁর স্মৃতি কথা থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর কথা খুব ভালোভাবেই জানতে পারি।
নাদেরা বেগমও ‘ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতি’ প্রবন্ধে এ বিষয়টি স্বীকার করে লিখেছেন : ১৯৪৯-এর প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেয়ারারা তাদের বেতন বৃদ্ধি, চিকিৎসা, পেনশন ইত্যাদি অতি ন্যায্য দাবিতে যখন হরতাল করেন তখন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রী সংঘ এবং পরে আরও বহু ছাত্রদল, বলতে গেলে বাংলাদেশের গোটা ছাত্রসমাজ তাদের সমর্থনে এই হরতালে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন সরকারের নির্দেশে বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই ব্যবস্থার ব্যবহারিক ফল ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এদের বহিষ্কার। এদের মধ্যে ছাত্রী ছিলেন মাত্র দুজন, আইন বিভাগের ছাত্রী লুলু বিলকিস বানু এবং আমি। আর ঐ সময়ের সমগ্র ছাত্র-সমাজের গৌরবের কথা এই যে, শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের তালিকায় সবচেয়ে উজ্জ্বল নামটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। তিনি আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
লেখক : রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষক , সাবেক সহসভাপতি , জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ , সাবেক সিনেট সদস্য , যুগ্ন মহাসচিব , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন।
এইচআর/জেআইএম