সফলতার নতুন পাঠ : ঠগিদের পোয়াবারো!
আজ লিখতে বসে হঠাৎ আমার দুএকজন স্কুল শিক্ষকের কথা মনে পড়ে গেলো। বিশেষ করে যার নাম মনে পড়ছে তিনি সুরেন্দ্র নাথ বর্মন। তিনি ছিলেন আমাদের হাই স্কুলের পন্ডিত স্যার। বাড়ি ছিল দিনাজপুর। ক্লাস টেনে তিনি আমাকে সংস্কৃত পড়িয়েছেন। তার আগে পন্ডিত স্যার ছিলেন হরিকিংকর ভট্টাচার্য। হরিকিংকর স্যারের বাড়ি ছিল বগুড়ার শেরপুরে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। দেখতেও ছিলেন সুদর্শন। গায়ের রং ফর্সা ছিল, নাক ছিল উন্নত। ব্রাহ্মণদের গায়ের রং সাধারণত উজ্জ্বলই হয়ে থাকে। ‘কালো’ ব্রাহ্মণদের ব্যাপারে হিন্দু সমাজে একটু নাক কোঁচকানো ভাব দেখতাম। ব্রাহ্মণ হলেন ‘ঠাকুর'। পূজা-পার্বণ থেকে শুরু করে বিয়ে-শ্রাদ্ধ কোনো কিছুই ব্রাহ্মণ ছাড়া হয় না।
বয়োজ্যেষ্ঠদের বলতে শুনেছি, ‘ঠাকুরের’ চেহারা দেখে যদি মনে শ্রদ্ধা না জাগে তাহলে কি দেবতার পূজায় মগ্ন হওয়া যায়! একেবারে বর্ণবাদী মনোভাব। মানুষকে গায়ের রং দিয়ে ভালোমন্দ বিচার করার ব্যবস্থা আমার ভালো লাগতো না। তবে প্রচলিত লোকবিশ্বাস বদলে যেতে আমরাই দেখেছি। গায়ের রং তেমন ফর্সা নয়, তেমন ব্রাহ্মণকে আমাদের বাড়িতেই পূজা করতে দেখেছি। তবে আমাদের কুলপুরোহিত ছিলেন নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি একটু বেটেখাটো ছিলেন বলে তাকে সবাই ‘বাচ্চা ঠাকুর' বলে ডাকতো। তবে তার গায়ের রং উজ্জ্বলই ছিল। আমি তাকে মামা বলতাম। কারণ আমার মাকে তিনি দিদি বলতেন। এই ঠাকুর মামার বড় ছেলে গোবিন্দ চক্রবর্তী এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
হরিকিংকর স্যার বেশ উচ্ছ্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকতেন। খোলামেলা স্বভাবের এই শিক্ষকের সঙ্গে আমাদের বেশ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি আমাদের হিন্দু ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ব্যাকরণও পড়াতেন। সংস্কৃত পন্ডিত হওয়ায় বাংলা ব্যাকরণ তিনি ভালো পারতেন। এই স্যারই আমাকে নাইন-টেনে পাঠ্য বিষয় হিসেবে সংস্কৃত নিতে প্রভাবিত, বলা যায়, প্ররোচিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি যেহেতু মানবিক বিভাগেই পড়বো, সেহেতু আমার সংস্কৃতি নেওয়া উচিত। কারণ সংস্কৃতে অংকের মতো নম্বর পাওয়া যায়। আমি একটু পড়লেই ৯০/৯৫ নম্বর পাওয়া সম্ভব। আমি যেহেতু মনে রাখতে পারি সেহেতু সংস্কৃত কিছু শ্লোক মুখস্ত করলেই বেশি নম্বর পাওয়া আমার জন্য কোনো সমস্যাই হবে না। আমি প্রলুব্ধ হলাম এবং আরো কয়েক জনকে আমার দলে ভিড়ালাম।
আমরাও সংস্কৃতি নিলাম, আর হরিকিংকর স্যারও আমাদের স্কুলের চাকরি ছেড়ে কয়েক মাইল দূরের একটি স্কুলে চলে গেলেন। তার এই চাকরি ছাড়ার পেছনে কোনো বিশেষ কারণ ছিল কিনা সেটা জানি না। তবে আমরা পড়লাম অথৈ জলে। প্রায় সাত/আট মাস পরে পাওয়া গেলো নতুন সংস্কৃত শিক্ষক সুরেন স্যারকে। তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন না । গায়ের রংও ছিল তামাটে। স্বভাবের দিক থেকেও ছিলেন একটু চাপা। হাসিটাও ছিল কৃপণের। অর্থাৎ হরিকিংকর স্যার আর সুরেন স্যার ছিলেন বিপরীত স্বভাবের। তখন আমরা বিপাকে। নাই মামার চেয়ে কানা মামাই তখন সেরা। সুরেন স্যার শিক্ষক হিসেবেও খুব অভিজ্ঞ ছিলেন বলে মনে হয়নি। তবে তিনি চেষ্টা করতেন এমনভাবে পাঠদানের যাতে আমরা অ্ন্তত সংস্কৃতে পাস করি। তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। তবে হরিকিংকর স্যার যেমন নম্বরের লোভ দেখিয়েছিলেন তেমন নম্বর পাইনি। সম্ভবত ৭০/৭২ পেয়েছিলাম।
যা হোক, হঠাৎ কেন সুরেন স্যারের কথা মনে পড়লো? অন্য শিক্ষকরা যেখানে আমাদের নানা নীতি শিক্ষা দিতেন সেখানে সুরেন স্যার ক্লাসেই এমন কিছু কথা বলতেন যা ঠিক ‘মরাল’ বা নীতিকথার মতো ছিল না। আমরা জানতাম ‘পরিশ্রমে আনে ধন, পূণ্যে আনে সুখ'। সুরেন স্যার বলতেন, এটা বইয়ের কথা, বাস্তবতা ভিন্ন। যে কৃষক সারাদিন মাঠে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন তিনি কিছু ধান হয়তো পান কিন্তু ধনবান তিনি হতে পারেন না। যারা কুলিমজুরের কাজ করেন, তারা কি পরিশ্রম কম করেন? কই, তাদের তো ধনবান হতে দেখা যায় না।
স্যারের্ কথা শুনে আমার কেমন সব তালগোল পাকিয়ে যেতো। আমাদের এক বড় ভাই এসএসসি পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি লিফলেটের মতো ছাপিয়ে বিলি করেছিলেন। পরীক্ষায় কেউ যেন অসদুপায় অবলম্বন না করে, সেটাই ছিল লক্ষ্য। ওই লিফলেটে একটি বাক্য ছিল : ‘আমরা স্বর্গ থেকে চুরি করে নয়, সমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভ করবো’। এই কঠিন বাক্যের অর্থ বুঝতে আমাদের সময় লেগেছিল।
সুরেন স্যার লিফলেটটি পড়ে তার স্বভাবসুলভ কৃপণের হাসি হেসে বলেছিলেন, জীবনে সফল হতে হলে তিনটি জিনিস লাগে : চুরি+চালাকি+চান্স।
স্যারের কথা শুনে আমি তার বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করতে গিয়েও করিনি। স্যারের মুখটি দেখে মনে হতো তার মধ্যে একটি প্রচন্ড দুঃখবোধ কাজ করে। অমন অসহায় মুখ আমি আমার আর কোনো শিক্ষকের দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদের ঘটনার পর কিংবা লক্ষ্মীপুরের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম পাপলুসহ আরও কিছু ঘটনা অর্থাৎ এমন আরও কারো কারো বিরাট উত্থানের নেপথ্য কাহিনীর প্রসঙ্গ এলেই আমার কেবলই সু্রেন স্যারের কথাই মনে হয়। সফল হতে হলে লাগে তিনটি বিষয় : চুরি + চালাকি +চান্স।
নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম আছে। ব্যতিক্রমকে আমরা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে এক ধরনের তৃপ্তি বোধ করলেও আসলে পরিশ্রম নয় ধনবান হতে হলে লাগে বিশেষ কিছু কৌশল। তারমধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতার সঙ্গে সংযোগ। ভূয়া কাগজপত্র দিয়ে ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা টাকা ঋণ নিয়ে তা লোপাট করার সাধ্য কি সবার আছে? কিংবা হাসেম ফুডের মালিক আবুল হাসেমের মতো সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কারখানা চালানোর বুকের পাটাও কি সব ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোক্তার আছে? কত ধাপে কত অনুমোদন-অনুমতি নিয়ে একটি কারখানা তৈরি করতে হয়। অথচ সেখানে থাকে না শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা। দুর্ঘটনা ঘটার পর জানা যায় অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কথা।
সরকারের এত এত সংস্থা থাকার পরও কীভাবে অপরিকল্পিতভাবে কারখানা গড়ে ওঠে? আগুনে শ্রমিক পুড়ে মরার ঘটনা তো দেশে প্রথম ঘটলো না। তদারকি সংস্থাগুলো কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়? অর্থ দিয়ে, ক্ষমতাবানদের হাত করে অব্যবস্থা অব্যাহত রাখার যে ধারা দেশে চলে আসছে তা আমাদের আসলে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে? শিশু শ্রম আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু সেজান জুসসহ হাসেম ফুডের কারখানায় শিশুরাও আগুনে পুড়ে মারা গেল। তারা নিশ্চয়ই সেখানে জুস বা আইসক্রিম খেতে যায়নি। আবুল হাসেম, তার চার পুত্রসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা শাস্তি পাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তর, বিস্ফোরক পরিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দায়দায়িত্বের বিষয়টি কি বিবেচনায় আসবে না?
বালুতে উট মুখ ঢাকলেই তো আর ঝড় বন্ধ থাকে না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/এএসএম