বুলিংও হতে পারে আপনার সন্তানের নীরব ঘাতক
ফাহিমা আবেদীন
ছোটবেলায় আমরা দেখতাম ক্লাসে একজন আরেকজনকে বিভিন্ন নামে ডাকতো। যেমন ‘এক ব্যাটারি’, ‘দেড় ব্যাটারি’, ‘মোটকু’ বা হাল আমলে ‘মোটু’ কিংবা ‘পাতলু’, ‘চিকন আলী’, ‘ল্যাংড়া’, ‘লুলা’, ‘কানা’, ‘কালু’, ‘ধলু’, ‘বাট্টু’, ‘হাবলু’, ‘হাবা’। এই যে নাম—এগুলো শিশুরাই শিশুদের ডাকত। এতে করে যাকে এ নামে ডাকা হচ্ছে তার কতটা খারাপ লাগছে সেটার পরোয়া তারা করতো না। অনেকসময় শিক্ষক বা বড়দের কাছে অভিযোগ করলে তারা বিষয়টা এড়িয়ে যেতেন কিংবা দায়সারাভাবে একটা সমাধান করে দিতেন। তাদের ধারণা—এ আর এমন কী! ছোটবেলায় এমনটা সবাই করে, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কথাই বলছি—যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা দেখে বড় হচ্ছি। আমাদের চোখে বিষয়গুলো এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। শুধু যে শারীরিক গড়ন নিয়ে আমাদের শিশুরা অপমানিত হয় বা হচ্ছে এমন নয়, ক্লাসে একজন শিক্ষার্থী মেধায় দুর্বল হলেও তাকে নানান তিরস্কার শুনতে হয়। শিক্ষকরাও এর আওতার বাইরে নন। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করেন, উপহাস করেন।
আমি অনেক শিক্ষককে বলতে শুনেছি, ‘মাথাভর্তি তো গোবর ছাড়া কিছুই নেই, গলা অব্ধি গিললেই তো শুধু হবে না, পড়াশোনাটাও তো করতে হবে’। যাকে কথাগুলো বলা হলো তার দুটো ধারণা তৈরি হয়। এক. আসলে আমার দ্বারা কিছু হবে না। দুই. পড়াশোনায় ভালো না হলে এ জীবনের কোনো মানে নেই।
শুধু যে দুর্বল শিক্ষার্থী এমন হেনস্থার শিকার হয় তা কিন্তু না, অনেক সময় দেখা যায় ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীও এমন পরিস্থিতির শিকার হয়। ‘এই তোর তো আর কোনো কাজ নেই না পড়াশোনা ছাড়া?’ ‘আসছে মায়ের লক্ষ্মী ছেলে/মেয়ে’। ‘যা যা তুই মার আঁচলের তলে বসে বসে পড় গে।’ এ ধরনের বাক্যবাণে ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীটাও তটস্থ হয়।
এই যে পুরো প্রক্রিয়া—শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘বুলিং’। বুলিং একটি মারাত্মক অপরাধ। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ( সিডিসি) মতে, বুলিং হলো অপ্রত্যাশিত এবং আক্রমণাত্মক আচরণ, যা স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায়। এ আচরণের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার অসামঞ্জস্য প্রকাশ পায়। এই আচরণ আক্রান্ত শিশু বা কিশোরের ওপর ক্রমাগত চলতে থাকে। তবে এ আচরণ সাধারণত স্কুলে যাওয়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেখা গেলেও যেকোনো বয়সের ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যেতে পারে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেও এমন আচরণ দেখা যায়।
বুলিং শব্দের সহজ অর্থ বলা যায়—কাউকে মানসিকভাবে হেনস্থা করা, অন্যের সামনে লজ্জা দেয়া, অপমান করা, হেয় করা, যৌন নিপীড়ন করা। বিভিন্ন অবস্থানের ভিত্তিতে বুলিং হতে পারে। যেমন শারীরিক বা মানসিক আঘাতের মাধ্যমে, অপমানের মাধ্যমে, কোনো তথ্যের মাধ্যমে, শারীরিক বা মানসিক হয়রানির মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বুলিং প্রিভেনশন সেন্টারের মতে, কিছু বুলিং শারীরিকভাবে শনাক্ত করা গেলেও এটি কখনো কখনো নীরবে বা মানসিকভাবেও চলতে পারে। যেমন কোনো গুজব বা ইন্টারনেটে কোনো মিথ্যা কথা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে বুলিং হওয়া ব্যক্তির মানসিকভাবে ক্ষতি করা, যা সাইবার বুলিং নামে পরিচিত।
বুলিং আচরণের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো, এই আচরণের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, যারা এই ধরনের হয়রানি ঘটানোর মূলে, তারাও স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই এদের মধ্যে ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার’ (প্রধান লক্ষণ মনোযোগের অভাব, অতি চঞ্চলতা ও হঠকারী আচরণ), ‘কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার’ (প্রধান লক্ষণ অসামাজিক আচরণ, নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করা, আচরণে ঔদ্ধত্য, জীবজন্তু বা অন্য কোনো মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন ও ক্ষতি করার প্রবণতা, মিথ্যা কথা বলা, স্কুল থেকে পালানো, চুরি করা ইত্যাদি) রোগে আক্রান্ত শিশু-কিশোররা এ ধরনের আচরণ করে থাকে।
আবার ক্লাসে জনপ্রিয় হওয়ার লোভেও অনেক কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর প্রবণতা দেখা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন সিরিয়াল, সিনেমা বা ভিডিও গেমে দেখানো উৎপীড়ন বা ওই জাতীয় কোনো দৃশ্য শিশু-কিশোরদের মনে প্রভাব ফেলে, যেগুলো অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। বাবা-মায়ের কড়া শাসন, তাদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, পারিবারিক অস্থিরতা, পরিবারের কোনো সদস্যের নেশা করার প্রবণতা ইত্যাদিও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই জাতীয় প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। বুলিংয়ের শিকার হওয়া শিশু-কিশোররা ভবিষ্যতে অন্য শিশু-কিশোরদের বুলিং করছে, এমনটাও অস্বাভাবিক নয়।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বুলিংয়ের শিকার। বুলিংয়ের যে কী মারাত্মক প্রভাব পড়ে শিশুদের জীবনে, এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ডেপুটি ম্যানেজার (কাউন্সেলিং) ফারজানা শারমিন বলেন, ‘বুলিংয়ের ফলে একটি শিশু হৃদয়গতভাবে নিজেকে একা করে ফেলে, চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। বন্ধুপরিসর ছোট করে ফেলে, সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে সমস্যা হয়, সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে। মাত্রাতিরিক্ত বুলিং হতে থাকলে আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টাও করে ফলতে পারে।’
‘বুলিংয়ের প্রভাব মাদকের মতই ভয়ানক। এটি একটি শিশুকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। শিশুর সহজাত মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সে নিজেকে মেলে ধরতে পারে না, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে না। হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে, আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং নিজেকে অযোগ্য ভেবে মনে মনে কষ্ট পায়। শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী শিশু সামাজিক হতে পারে না, সহজে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। দিন দিন অসামাজিক হয়ে গড়ে ওঠে। ভীরু মনের হয়ে পড়ে। শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়। যার প্রভাব সারাজীবন ব্যাপী থাকে। জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি হয়। অন্যের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। যে বুলিংয়ের ভিকটিম সে যেমন ক্ষতির শিকার হয়, তেমনি যারা বুলিং করে তাদের মধ্যেও নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হয়।’
এখন প্রশ্ন, বিষয়টি রোধ করা কী করে সম্ভব? স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে শিশু ও কিশোররা বাবা-মাকে নিপীড়নের বিষয়ে বলতেও পারে না। এতে সমস্যা আরও বাড়ে। বাবা-মা বাচ্চার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশলে এমন ঘটনার আঁচ পাওয়া অনেক সহজ হয়। তাই সতর্ক থাকা জরুরি। হঠাৎ করে বাচ্চার পরীক্ষার ফল খারাপ হতে থাকলে, খিদে ও ঘুম কমে গেলে, স্কুলে যেতে না চাইলে, শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া গেলে তৎক্ষণাৎ খোঁজখবর নিন। নিয়মিত স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ জরুরি।
তবে মূল পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তরফ থেকে। বন্ধুর সঙ্গে কীভাবে মিশতে হয়, তা শিশুদের শেখানো ও বন্ধুত্ব স্থাপনে উৎসাহিত করার দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। শিক্ষক-ছাত্রদের সুসম্পর্ক, ক্লাস ও খেলার মাঠে উপযুক্ত নজরদারি এই জাতীয় ঘটনা কমাতে পারে। এছাড়া, বুলিংয়ে জড়িত শিক্ষার্থীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কমায়।
আর অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে বুলিং সম্বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমগুলিকেও এগিয়ে আসতে হবে। মোবাইল ও ইন্টারনেটের উপযুক্ত ব্যবহার, অতিরিক্ত ব্যবহারে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর বুলিংবিরোধী নিয়ম-নীতি প্রণয়ন ও সেগুলোর ঠিকমতো রূপায়ণ সাইবার বুলিংয়ের মতো সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।
লেখক
সহকারী শিক্ষক
মঙ্গলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফেনী
এইচএ/এএসএম