পালকি যদি ডানে যায় দুলকি যায় বামে...
আমাকে মুখটিপে হাসতে দেখে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন-
: ভাইজান! ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড; কীজন্য হাসলেন, জানতে পারি কি?
হাসির কারণ বলা যাবে না। তার সাজগোজের অস্বাভাবিকতা আমার হাসির কারণ- এ কথা জানার পর ভদ্রমহিলার প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই আমার জন্য সুখকর হবে না। খামাকা নাগিনীর লেজে পা দেয়ার দরকার কী? ঠোঁটে অমিমাংসিত হাসি ঝুলিয়ে রেখে আমি ভদ্রমহিলার নামের প্রশংসা করলাম।
প্রশংসায় আল্লাহপাক খুশি হন। আল্লাহপাকের মহব্বতের সৃষ্টি মানুষও খুশি হয়। ভদ্রমহিলা খুশি হলেন। লজ্জা মেশানো গলায় বললেন-
: আমার নামকরণের একটা ইতিহাস আছে, বলব?
যে কাজে এখানে এসেছি, তার সঙ্গে কারও নামের ইতিহাস শোনার কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিকে বলে ‘বাটে পড়া’। আমি না বুঝে বাটে পড়েছি। নাম ধারণের ইতিহাস পর্ব শেষে ভদ্রমহিলা যদি তার দুধদাঁত ঝরে পড়ার ইতিহাসও আমাকে শোনাতে চান, ধৈর্য সহকারে সেটাও শুনতে হবে। এ কাজটা আবার বিরস মুখে করলে হবে না; রসযুক্ত মুখে করতে হবে। মুখে হাসির ফোয়ারা উৎপন্ন করে এমনভাবে হাসতে হবে- যাতে উপর-নিচ মিলে কমপক্ষে আঠারটা দাঁত দৃশ্যমান হয়। আমি তাই করলাম। দন্ত প্রদর্শন ব্যাপক সমারোহ ঘটিয়ে বললাম-
: বলবেন না মানে! অবশ্যই বলবেন। বলেন, শুনি...
: না, থাক।
: আহা! থাকবে কেন; চারপাশে যখন মিথ্যা আর বিকৃত ইতিহাসের ছড়াছড়ি, তখন আপনার মুখে একটা সত্য ইতিহাস শুনতে পাওয়া অবশ্যই সৌভাগ্যের বিষয়। প্লিজ ম্যাডাম! বলুন...
: ঠিক আছে, বলছি। ঘটনাটা হচ্ছে এরকম- বৈশাখ মাসের প্রচণ্ড গরমে মা পালকিতে চড়ে বাপের বাড়ি নাইওর দিচ্ছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তার প্রসব বেদনা শুরু হলো। এরপর পালকির মধ্যেই আমি ভ‚মিষ্ঠ হলাম। ধরাধামে আমার আগমনের সেই মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নানাজান আমার নাম রাখলেন পালকি বেগম। ইন্টারেস্টিং না?
: খুবই ইন্টারেস্টিং। নিশ্চয়ই আপনার নানা একজন গুণী লোক ছিলেন।
আমার কথা শুনে পালকি বেগম নীরব হয়ে গেলেন। এভাবে নীরব হয়ে যাওয়াকে আমাদের ময়মনসিংহ এলাকায় বলে থুম ধরা। হঠাৎ কীজন্য তিনি থুম ধরলেন, বুঝতে পারছি না। পালকি বেগমের ঠোঁট কখন ফাঁক হবে- সেই প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছি। একসময় তার ঠোঁট ফাঁক হল। কিন্তু সেখানে কোন কথা রচিত না হয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। বিচলিত হয়ে বললাম-
: আমি কি কোন কারণে আপনার মনে ব্যথা দিয়ে ফেললাম?
: না, না।
: তাইলে?
: আপনি আমার মরহুম নানাজানের কথা বললেন তো! তাকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি আছে। হঠাৎ সেসব কথা মনে পড়ে গেল।
: অ...
: একবার হয়েছে কী জানেন?
এই রে! ঠেলা সামলাও। হাতে সময় একেবারেই কম। এখানকার কাজকর্ম শেষ করে আমাকে আরও এক জায়গায় ছুটতে হবে। সেখানে মোক্ষলাভ হলে তবেই ঢাকায় ফিরতে পারব। ইতিহাস পাঠের পর এবার স্মৃতিকথা অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। পরিণতি ভালো ঠেকছে না। একটা চালাকি করলাম। টেবিলের উপর রাখা পেপারওয়েটটা আস্তে করে টোকা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলাম। এতে কাজ হলো। ঠক করে শব্দ হতেই পালকি বেগম সেদিকে মনোযোগ দিলেন। এরপর উপুড় হয়ে সেটা তোলার আয়োজন করলেন। পালকি বেগমের মনোসংযোগ নষ্ট করার কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করার পর আর এক সেকেন্ডও দেরি করলাম না; ফাইল থেকে প্রশ্নপত্র বের করে তার সামনে রাখলাম।
পালকি বেগমের সঙ্গে কাজ শেষ হওয়ার পর উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসায় উপস্থিত হলাম। সবকিছু শোনার পর তিনি কপাল কুঁচকালেন। বললেন-
: আমি হইলাম উপজেলা চেয়ারম্যান; অথচ আপনে প্রথমে আমার কাছে না আইসা ভাইস চেয়ারম্যানের কাছে গেছেন। কাজটা সঠিক হইছে?
উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম দুলকি বেগম। দুলকি বেগমের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেলাম। এ আবার কোন মসিবত! হাত কঁচলে বললাম-
: আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যেই উপজেলা অফিসে গেছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর দেখলাম- আপনি নাই; তিনি আছেন। তাই তার সঙ্গে কথা বলেছি।
: আরে রাখেন আপনের তিনি আর উনি। কোনটা বটগাছ, আর কোনটা ঝাউগাছ- আপনে যদি এইটাই বুঝতে অক্ষম হন, তাহলে কী গবেষণা করবেন?
: জি।
: এইবার বলেন- সে কি আমার বিরুদ্ধে কিছু লাগাইছে?
: এই গবেষণায় কারও বিরুদ্ধে কিছু বলার সুযোগ নাই।
: ধুরউ! আপনে আসলেই একটা ভেজাল। আরে ভাই! সে আপনের গবেষণার ফরম পূরণ করছে কলম দিয়া; মুখ দিয়া তো করে নাই? মুখ খোলা ছিল। সেই খোলামুখ দিয়া আমার বিরুদ্ধে আকথা-কুকথা কিছু বাইর হয় নাই?
: না, না; এইরকম কিছু ঘটে নাই। তিনি বরং আপনার প্রশংসা করছেন।
আমার কথা শুনে দুলকি বেগমের চোখের মনি স্থির হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে তিনি ঘরের বাইরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বললেন-
: আপনে সত্য কথা বলেন নাই। পালকি বেগম আমার প্রশংসা করছে- এইটা শোনার পর মনে হইল, তাইলে তো পৃথিবীর নিয়ম উল্টাইয়া যাওয়ার কথা। পৃথিবীর নিয়ম-কানুন সত্যই উল্টাইয়া গেছে কিনা, সেইটা দেখার জন্য আমি ঘরের বাইরে যাইয়া সূর্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকাইয়া রইলাম। দেখলাম, সূর্য ঠিক ঘুরতেছে। বুঝলেন, আপনের কথা সত্য হইলে সূর্য ঘুরত না; স্থির হইয়া থাকত।
ফাটা বাঁশে লেজ আটকে যাওয়া বলে একটা কথা আছে। আমার লেজ নেই, তবে ঘাড় আছে। বাঁশের চিপা থেকে ঘাড় বের করার জন্য বৈজ্ঞানিক সত্য সামনে এনে বললাম-
: আপা! সূর্য তো ঘুরে না; পৃথিবী ঘুরে।
দুলকি বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি পিটপিট করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললেন-
: শুনেন! আমারে জ্ঞান দিতে আসবেন না। আমি পালকি বেগমের মতো মূর্খ মহিলা নই। প্রয়োজন মনে করলে আপনে বাইরে যান। দেইখা আসেন- কোনটা ঘুরতেছে।
: কিন্তু বিজ্ঞান...
: আরে রাখেন আপনের বিজ্ঞান! বিজ্ঞানের কথা বলবেন ল্যাবরেটরিতে বইসা। পলিটিশিয়ানের সামনে বিজ্ঞানের সূত্র অচল। এইখানে চোখের দেখায় যা বোঝা যাবে, সেইটাই বিশ্বাস করতে হবে। বুঝাইতে পারছি?
: জি।
কাজ শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল। হোটেলে ভাত খেয়ে পাশের একটা দোকানে বসে চা পান করছি, পাশ থেকে এক লোক জানতে চাইল-
: ভাইয়ের বাড়ি?
: বাড়ি মমিসিং; অস্থায়ী নিবাস ঢাকা।
আমার কথা শোনার পর কিছুক্ষণ মাথা ঝাঁকিয়ে লোকটা পুনরায় জানতে চাইল-
: ভাই কি ডিফেন্সে আছেন?
: উহু! অফচান্সে আছি।
অফচান্সের বিষয়টা খুলে বলা যাক। ‘সাম্বাদিক’ হওয়ার আগে অনেকদিন নামকরা বেসরকারি একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এটা যারা জানেন, তাদের একজন হচ্ছেন ইব্রাহিম সাহেব। কিছুদিন আগে তিনি ফোন করে বললেন-
: মোকাম্মেল, একটা কাজ পাইছি। উঠাইয়া দিতে পারবেন?
: কী কাজ?
: উপজেলা পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের উপর মতামত জরিপের কাজ। দেশের নির্দিষ্ট কিছু উপজেলায় গিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। পারবেন?
: পারব। পয়সাকড়ি কেমন পাওয়া যাবে?
: খারাপ না; ভালোই পাবেন।
পয়সাকড়ির ব্যাপারে এতদিন উদাসীন থাকলেও জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝতে পারছি- টাকাপয়সা হচ্ছে অতি মূল্যবান বস্তু। বর্তমান পেশায় বেতনের বাইরে বাড়তি রোজগারের সুযোগ নেই বললেই চলে। কাজেই বাড়তি কিছু টাকা রোজগারের ধান্ধায় এ ‘অফচান্স’টা গ্রহণ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় বিভিন্ন উপজেলায় ছুটে বেড়াচ্ছি। ইতোমধ্যে দুটি উপজেলার কাজ শেষ করেছি। এটি হচ্ছে তৃতীয় উপজেলা। লোকটা আমার কথা বুঝল কিনা, জানি না। কিছুক্ষণ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর জানতে চাইল-
: এইখানে কার কাছে আসছিলেন?
: উপজেলা চেয়ারম্যান দুলকি বেগম আর ভাইস চেয়ারম্যান পালকি বেগমের কাছে।
: কী জন্য?
: নারীর ক্ষমতায়নের উপর একটা গবেষণার কাজে।
আমার কথা শুনে অন্যপাশ থেকে একজন বলে উঠল-
: ভাই! ‘ক্ষমতা অন’ কইরা তো দেশে অনেক গবেষণা হইল। এইবার ‘ক্ষমতা অফ’ কইরা গবেষণা করেন।
: মানে?
: মানে বোঝাইয়া দেওয়ার জন্য আমার কথা বলার প্রয়োজন আছে কি? আপনে ক্ষমতাসীন যে দুই চেয়ারম্যানরে গবেষণা করছেন বা করতেছেন; তাদের ভাবসাব দেইখা কি কিছুই বুঝতে পারেন নাই? ‘ক্ষমতা অন’ থাকায় তারা তাদের মর্জিমতো চলাফেরা করতেছে। দুইজনই জনপ্রতিনিধি। দুইজনের দর্শনই হইল উন্নয়ন। অথচ ওইগুলা ছিঁকায় তুইলা তারা কেবল ঠেলাঠেলি আর পাল্টাপাল্টির কারবার লইয়া ব্যস্ত। পালকি বেগম যদি ডানে যায়, দুলকি বেগম যায় বামে। একজন অফিসে গেলে অন্যজন বাড়িতে বইসা থাকে। একজন হাটে গেলে অন্যজন মাঠে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে। মনের মিল নাই, মতেরও মিল নাই। দুইজনে যদি একমত, এক পথের সঙ্গী হইয়া একত্রে কাজ করত, তাইলে আমাদের এই ছোট্ট উপজেলাটা সারা দেশে উন্নয়নের একটা মডেল হইত!
লোকটা সামনের একজনকে সাক্ষী মানার পর তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
: পালকি আর দুলকির ঘটনা তো নতুন কিছু না রে ভাই। এই দেশে বাপ যদি থাকে আইলে, পুত থাকে খালে। মাস্টার যদি ডালে, ছাত্র থাকে পানিতে। মন্ত্রী যদি থাকে পূবে, সচিব থাকে পশ্চিমে। গুতাগুতি আর ঠেলাঠেলির জন্যই তো আমাদের এই দুরবস্থা। সব মত, সব পথ এক হইলে শুধু আমাদের উপজেলা না, দেশটাই সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হইত।
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক।
এইচআর/জিকেএস