আবারও তালেবান আতঙ্ক
তালেবানদের সঙ্গে পশ্চিমা দখলদারদের চুক্তি অনুযায়ী সব বিদেশি সৈন্য আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ এর মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার কথা। টুইন টাওয়ার হামলার ২০ বছর পূর্তির দিনটিকে স্মরণ করে, আফগানিস্তান ছাড়ার তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু তার অনেক আগেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়া শুরু করেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কাবুল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, বাগরামে বিমানঘাঁটি ত্যাগ করেছে মার্কিন সেনারা। এখান থেকে তালেবান ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা পরিচালনা করা হতো। প্রায় ২০ বছর সেখানে অবস্থানের পর ২ জুলাই নিজ সেনাদের সরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তালেবান ও আমেরিকার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায়, বিদেশি বাহিনীকে মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল।
বাইডেন সময় বাড়িয়েও আগে আগে চলে যাচ্ছেন। আফগানিস্তান থেকে ইতোমধ্যেই ৯০ শতাংশের বেশি মার্কিন সেনা দেশে ফিরে গেছে। জার্মানি তাদের সব সেনা দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড জানিয়েছে, আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে তারা বিমানঘাঁটিসহ সাতটি জায়গা তুলে দিয়েছে।
এসবই শুভ সংবাদ ছিল। কিন্তু অশুভবার্তা আসছে ন্যাটো বাহিনী চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তান আবার তালেবান রাজত্ব কায়েম হতে যাচ্ছে কিনা। তারচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে তালেবানের হাত ধরে আফগানিস্তানে পুনরায় আল-কায়েদা ঘাঁটি করতে যাচ্ছে কিনা। আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন যখন ১৯৯৬ সালে সুদান থেকে তার ঘাঁটি আফগানিস্তানে নিয়ে আসেন তখন থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে আফগানিস্তানে।
আমেরিকায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের আশ্রয়ে পালিয়ে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে ‘ওয়ার অন টেরর’ সূচনা করে তালেবান সরকারকে হটিয়ে দিলেও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতির অবসান হয়নি কখনো।
তারও ১০ বছর পর ২০১১ সালের ২ মে ইসলামাবাদের কাছে অ্যাবোটাবাদ থেকে ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতারের পর হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোর আক্রমনে তালেবানরা পরাস্ত হলেও গত ২০ বছর সেখান থেকে আল-কায়েদার অস্তিত্ব মুছে ফেলা যায়নি। নতুন করে যোগ হয়েছে ইসলামিক স্টেট বাহিনী।
কাবুল ছাড়া আফগান সরকার বাইরের রাজ্যগুলোতে আগেও দুর্বল ছিল। আফগানিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা এখন তালেবানের দখলে, এবং প্রতিদিনই তারা নতুন নতুন জেলা সরকারি বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। যদিও তারা বলছে জোর করে কাবুল দখল করার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই কিন্তু আতঙ্কে সরকারি বাহিনী ইতিমধ্যে দেশ ছাড়তে শুরু করেছে।
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে তালেবানের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে এক হাজারেরও বেশি আফগান সরকারি সৈন্য সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী তাজিকিস্তানে পালিয়ে গেছে বলে সে দেশের সরকার বলছে। তাজিক কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, আফগান প্রদেশ বাদাখশানের কয়েকটি জেলায় যুদ্ধের পর ‘জান বাঁচানোর’ তাগিদেই এসব আফগান সৈন্য তাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মনোবল হারানো সরকারি সেনারা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে হয় পালাচ্ছে, নয়তো আত্মসমর্পণ করছে। তালেবানরা অনেক জায়গায় মুরব্বিদের ব্যবহার করে সরকারি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাচ্ছে, ভবিষ্যতেও সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করবে না- এই মর্মে লিখিত নিচ্ছে। তাদের ঘাঁটি এখন তালেবান বাহিনীর দখলে।
মার্কিন অনেক বর্তমান এবং প্রাক্তন আইনপ্রণেতারা এমন পরিস্থিতিতে আশঙ্কা করছেন যে, বিদেশি বাহিনী চলে যাওয়া এবং আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানদের স্থগিত শান্তি আলোচনা আফগানিস্তানকে একটি সর্বকালের গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে যাচ্ছে, যা তালেবানকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে পারে। পর্যবেক্ষকরা আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে প্রত্যাবর্তনের অপচ্ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের নিয়ে শঙ্কিত, ল্যান্ডলক আফগানিস্তান থেকে কীভাবে নিরাপদে তাদের কর্মীদের সরিয়ে নেবে ভাবছে। সুরক্ষা উদ্বেগের কারণে অস্ট্রেলিয়া মে মাসে তার কাবুল দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছে। চলমান পরিস্থিতি অন্য দেশগুলোকেও তাদের দূতাবাস বন্ধে প্ররোচিত করতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কংগ্রেসের শুনানিতে সম্প্রতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে কাবুলের মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করছেন না। তিনি প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন কিনা সেটাও প্রশ্ন।
পশ্চিমারা আফগানিস্তান ছাড়ার আগেই তালেবানরা আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। দেশের আগামী দিনের একটি জোরালো রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে বৈধতা অর্জন করেছে। অবশ্য তারা এখনও আফগান সরকারকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, ‘কাবুল প্রশাসন’ বলে সম্বোধন করে।
তালেবানরা কখনো ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার অঙ্গীকার থেকে ফিরে আসেনি, নারীরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে সেটাও তালেবানদের কাছ থেকে আশা করা যাচ্ছে না। আধুনিক চিন্তাধারায় রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা ফিরবে সেটাও দূরাশা। তবে তারা আবার আফগানিস্তানকে আল-কায়েদার ঘাঁটি বানাবেন কিনা এটা নিয়ে দ্বিমত আছে। কারণ ইতোমধ্যে তাদের শিক্ষা হয়েছে ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়ে।
তালেবান নেতৃত্ব হয়তো তাদের অতীতের ভুল হতে শিক্ষা নেবে। যদি তারা ক্ষমতার ভাগ চায়, বৈধভাবে কাবুলে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক শক্তিকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তালেবান নেতাদের মধ্যে যারা বিচক্ষণ, বিশেষ করে যারা দোহায় শান্তি আলোচনা অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকে শিক্ষিত ছিলেন, তারা বিশ্বে একঘরে হয়ে থাকতে চাইবেন না।
আবার এটাও ঠিক তালেবান থেকে আল-কায়েদাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ এদের মাঝে অনেক অভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে, যেটি নেতারা চাইলেও পুরোপুরি ছাড়তে পারবেন না। এদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে সীমান্তের ওপারের পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠীর যাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম।
তাছাড়া ভৌগোলিক কারণে আফগানিস্তানের মতো একটা বিশাল, বিস্তৃত পাহাড়ি দেশে কোনো তালেবান সরকার আল-কায়েদাকে দমিয়ে রাখতে পারবে- এটাও বলা কঠিন। প্রত্যন্ত উপত্যকা আর গ্রামগুলোতে আল-কায়েদা সহজেই নিজেদের শেকড় গাড়তে পারবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/এএসএম