বাংলাদেশ বিস্ময় নয়, বাংলাদেশ আজ অনুসরণীয়
ফারাজী আজমল হোসেন
১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশের একজন বোলার ১ রান নেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশকে আইসিসি ট্রফি এনে দেয়, তখন কেনিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় ছিলো সকলের কাছে বিস্ময়। কিন্তু আজ কেনিয়ার কাছে বাংলাদেশ হারতে পারে, সেটাই এক বিস্ময়ের ঘটনা। বিগত ২৪ বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট এভাবেই উন্নতি করেছে।
শুধু ক্রিকেটে নয় একই সঙ্গে বাংলাদেশ তার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনৈতিক শক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন, শিক্ষা-গবেষণা থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। আর সে কারণেই অতীতে যেই বাংলাদেশকে বলা হতো উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে, আজ সেই বাংলাদেশকে দেখে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলোকে। বাংলাদেশের কোন উন্নয়ন আজ বিস্ময় নয়, বরং নিয়মতান্ত্রিক কঠোর পরিশ্রমের ফসল। কোটি মানুষের হাজারো দিনের কষ্টের ফসল ঘরে তুলছে আজ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যখন ২০১০ সালে প্রথমবারের মত ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, তা ছিলো বিস্ময়কর। বিশ্ব জুড়ে চলা অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও বাংলাদেশ এই অর্জন করে যা ছিলো বিস্ময় কর। বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধি অর্জনকে অনেকে ‘হঠাৎ অর্জন’ হিসেবে দেখলেও ২০১১ সালে আবারও ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ। এবার আগের থেকেও বেশি। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার বাড়তেই থাকে যার ব্যতিক্রম ছিলো শুধু ২০১৩ সাল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার এই বছরটি বাদ দিলে ক্রম বর্ধমান হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ কয়েক বছর ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যা ২০২০-২১ সালে ৮ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। বিশ্বজুড়ে চলা মহামারী করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে কিছুটা ভাটা নামে। কিন্তু যেখানে বিশ্বের উন্নত সকল দেশের প্রবৃদ্ধি এই বছরগুলোয় ছিল ঋণাত্মক, সেখানেও বাংলাদেশের অর্জন ছিলো চোখে পড়ার মতো। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিকাল ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ভাষ্য মতে, বাংলাদেশ এই মহামারীর মধ্যেই তার জিডিপি প্রায় ৫ শতাংশ রাখতে সক্ষম হবে ২০২১ সালে। তবে এবার বাংলাদেশের এই অর্জনকে ‘বিস্ময়’ হিসেবে বর্ণনা করেনি ডব্লিউইএফ। বরং বলেছে, সব ঠিক থাকলে এবং সঠিক সময়ে গণ টিকা ব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থা ফিরে এলে এই প্রবৃদ্ধি আরও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বিষয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে বিবিসি তার বিশ্লেষণে জানায়, ২০৩৫ সালের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবে বিশ্বে শক্তিশালী অর্থনীতির ২৫ দেশের তালিকায়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়ত এই উন্নয়ন আরও আগেই সম্ভব হতো। কিন্তু জাতির পিতার অবর্তমানে তার কন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই স্বপ্ন পূরণ করছে। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির দেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তুলনা করা হচ্ছে গত শতকের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার অর্থনীতির সঙ্গে। বাংলাদেশকে এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে জানিয়েছেন এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শিজিন চ্যান। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্যানুসারে মহামারী করোনা মোকাবেলা করে চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৮ শতাংশ এবং আগামী বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ৭.২ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে চলতি বছর মাথাপিছু জিডিপি উন্নয়ন হবে ৫.৫ শতাংশ এবং আগামী বছর তা বেড়ে দাড়াবে ৫.৮ শতাংশ।
২০১৫ সালে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রশংসা ছড়িয়ে যায় জাতিসংঘের ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) পূরণকারী সবচাইতে সফল দেশ হিসেবে। আটটি লক্ষ্যের সব কটিতেই ভালো করে বাংলাদেশ। এসব লক্ষ্য অর্জনে ৩৩টি উপসূচকের মধ্যে ১৩টি পুরোপুরি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এমডিজির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যটি অর্জিত হয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল, বাংলাদেশ এ সময়ে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এ ছাড়া শিক্ষা, লিঙ্গ বৈষম্য, শিশুমৃত্যু, মাতৃস্বাস্থ্য, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে রাখা, টেকসই পরিবেশ—এসব মূল লক্ষ্যের বেশির ভাগ উপসূচকই লক্ষ্য অর্জন করে।
জাতিসংঘ প্রদত্ত এই মডেল অনেক দেশই অনুসরণ করেছে, কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আলাদা বাংলাদেশ। কেননা নিজেদের কাছাকাছির অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্নভাবে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হয়েছে? বিষয়টি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব পরিকল্পনা বা মডেল অনুসরণ করে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেই নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে আসে, এখানেই লুকিয়ে ছিলো বাংলাদেশ বিনির্মাণের সেই নতুন ‘মডেল’। ডিজিটাল বাংলাদেশ ব্যবস্থা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে এই ইশতেহারে জোর দিলেও সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখ ছিলো প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই কথাগুলো আরও জোর দিয়ে বলে আওয়ামী লীগ। শহর কেন্দ্রিক শিল্প-কারখানা, ব্যবসা ও আয়ের ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে প্রান্তিক পর্যায়ে ঋণ সহায়তা, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, পরামর্শ সহায়তা থেকে শুরু করে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আইসিটি শিক্ষাকে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা হচ্ছে দক্ষ এক জনগোষ্ঠীকে।
২০১০ সালেও পাকিস্তানের কাছাকাছি অর্থনৈতিক অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপির হারে পাকিস্তানকে বেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর, যা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ভারত ও পাকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৭০ ও ৬৮ বছর। বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন নেতৃত্বের আসনে রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এগিয়ে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠার কথা বলা যায়। এ দেশে ৩০০টি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে, যারা স্থানীয় চাহিদার ৯৭ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। এমনকি তারা বৈশ্বিক বাজারেও ওষুধ রপ্তানি করছে। গত এক দশকে ঔষধ শিল্প থেকে রপ্তানি আয় বেড়েছে এগারো গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭টি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ।
বাংলাদেশ তার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছে যার ফল হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কাজ করছেন বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ কর্মী। বিদেশ থেকে রেমিটেন্স অর্জন করা শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ২০২০ সালে সব মিলিয়ে ১ জানুয়ারি থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে এসেছে ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এটি এক বছরে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ রেমিটেন্সের নতুন রেকর্ড গড়েছে। সর্বশেষ জুলাই-ফেব্রুয়ারি ২০২০-২১ সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬.৭ বিলিয়ন ডলার যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩.৫ শতাংশ বেশি। কোভিডের প্রভাবে যেখানে সারা বিশ্বে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশে চলতি বছরেও প্রবাসীদের রেমিটেন্স থেকে আয় বাড়বে বলে ধারণা প্রকাশ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) অনুপাতে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে তৃতীয়। যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ, রপ্তানি আয়ের অর্ধেক (৫৪%) এবং প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় তিনগুণ (নিট বৈদেশিক সাহায্য ৬ বিলিয়ন)।
বিদেশ শ্রমিকদের কষ্টে অর্জিত হচ্ছে যেই রেমিটেন্স সেই বিদেশে থাকা কর্মীদের সহায়তার জন্য বিদেশে বাংলাদেশের স্থাপিত কনস্যুলেট ও হাইকমিশনগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থাপনা রাখা হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। বিদেশে থাকা শ্রমিকদের সার্বিক সহায়তা প্রদান ও তাদের জন্য অনলাইনে পাসপোর্ট রিনিউ সুবিধাসহ প্রবাস কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার সুফল পাচ্ছেন প্রবাসীরা। সেই সঙ্গে বৈধ পথে দেশে অর্থ প্রেরণ এবং প্রবাসীদের বিনিয়োগের বিভিন্ন সুযোগ তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার। যার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে দেশের কোটি মানুষ। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের শ্রম বাজারে নতুন সুযোগ তৈরি করেছে বাংলাদেশ। সাধারণ শ্রমিকের পাশাপাশি বর্তমানে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিতে দক্ষ বিশেষজ্ঞরাও সুযোগ পাচ্ছেন দেশের বাহিরের চাকরির বাজারে। প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হচ্ছিলো, তবে গত ২০২০ সালে কোভিড-১৯ জনিত কারণে ২.২ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়।
২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং এ ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর একটি শিল্প দেশের তৈরি পোশাক খাত। আশির দশকে ধীরে বিকাশ লাভ করে শ্রমঘন পোশাক খাত। এই খাতকে ধ্বংসের জন্য প্রায়ই ষড়যন্ত্র করে এসেছিলো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী। কিন্তু সকল সমালোচনা ও ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে কিছুদিন আগেই চীনকে টপকে শীর্ষ স্থান দখল করে নিয়েছিলো বাংলাদেশ যা একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে এই শিল্পের জন্য। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হচ্ছে এই পোশাকশিল্প। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসছে এ খাত থেকে (অর্থবছর ২০১৯-২০)।
বাংলাদেশে বর্তমানে রেমিটেন্স অর্জনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত আইসিটি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে নতুন নতুন সকল প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। দেশে প্রযুক্তি বান্ধব সংস্কৃতির বিকাশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আইসিটি বিভাগের অধীনে রয়েছে প্রায় ৪২টিরও বেশি বিভিন্ন প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে তরুণদের নতুন চিন্তা বা প্রযুক্তিগত ধারণাকে ব্যবসায় পরিণত করতে সহায়তা করছে বাংলাদেশ সরকার। দেশে সিলিকন ভ্যালির মত প্রযুক্তি হাব তৈরির জন্য গঠন করা হয়েছে হাইটেক পার্ক ও ইনোভেশন সেন্টার। এ বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। প্রযুক্তি জ্ঞানের কল্যাণে শ্রমনির্ভর থেকে জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তি।
শেখ হাসিনার ঘোষণা করা ডিজিটাল বাংলাদেশের আওতায় গ্রামের ১০ কোটি মানুষকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতায় আনা হচ্ছে, যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে দুই কোটি মানুষের। এ ছাড়াও ধারণা করা হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি পণ্য ও সেবা রফতানি করে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় হবে। তৈরি পোশাকের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে তথ্য-প্রযুক্তি খাত। ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ শতাংশের বেশি বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে সর্বদা ভঙ্গুর অর্থনীতি বলে ভৎর্সনা করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু আজ বাংলাদেশ কৃষিনির্ভরতার কারণেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং মহামারী করোনায় দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে না পারার অন্যতম কারণ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন। ১৯৭১ সালের তুলনায় খাদ্য উৎপাদন প্রায় পাঁচগুণ (৪.৭৫) বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ২১ লাখ টন (অর্থবছর ২০১৮-১৯)। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ খুব সামান্যই চাল আমদানি করেছে। ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে মাত্র ০.০৪ লক্ষ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি ২০২০-২১ সময়ে বাংলাদেশ ধান/চাল রফতানি করে ৮৩.৭ লক্ষ মার্কিন ডলার আয় করে।
ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস করতে ৪ দফা সারের দাম কমিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বরাবর কৃষিবান্ধব পরিকল্পনা করা শেখ হাসিনা বিগত দশকে টিএসপি ৮০ থেকে ২২ টাকা, এমওপি ৭০ থেকে ১৫, ডিএপি ৯০ থেকে ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। শুধু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮০৭ দশমিক ১৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে কৃষি বাজেট ছিল ৭৯২৪ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেট দাঁড়িয়েছে ১০৩০৩ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা। ধানসহ ১০৮টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে ধান উৎপাদনে বিশ্বের ৪র্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ প্রদান করেছে।
অবশ্য রফতানির ক্ষেত্রে কৃষি নির্ভরতা কমেছে, বেড়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ও সেবা খাতের গুরুত্ব। স্বাধীনতার পর যেখানে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান ছিল মাত্র ৯ ভাগ, তা এখন বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ৩৫ ভাগ হয়েছে, যার মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ২৪.২ শতাংশ। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর যেখানে জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ছিল ৫০ শতাংশের বেশি, তা এখন হ্রাস পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩ শতাংশ হয়েছে।
বাংলাদেশের এই উৎপাদন খাতকে চাঙ্গা রাখতে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ। আর সে কারণেই ২০১০ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পর দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দৃঢ় সকল সিদ্ধান্তের কল্যাণে ২০২১ সালে এসে মোট ২১ হাজার মেগাওয়াট গ্রিডে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। অথচ চাহিদা রয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মতো। সরবরাহ ব্যবস্থা আরও বিস্তৃত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতের জন্য বর্তমানে চেষ্টা করছে সরকার। সেই সঙ্গে ঝড় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য ভূগর্ভস্থ সরবরাহ লাইনের বিষয়ে চিন্তা করছে সরকার।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশের তালিকায় শীর্ষ তিনে রয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ প্রদত্ত সকল মডেল অনুসরণ করছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে দেশের নিজস্ব কিছু লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন এখন আর মুখের কথা নয় বাস্তবতা। ২০২৪ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলার বিষয়টি বিস্ময়কর নয় বরং তা স্বাভাবিক এবং শতবর্ষের ডেল্টা প্লান থেকে শুরু করে পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং মেট্রো রেলের মত মেগা প্রজেক্টগুলো জানান দিচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের যেই স্বপ্ন বাংলাদেশ দেখছে তা বাস্তবায়ন করাটা খুব অবাস্তব চিন্তা নয়। তবে এর জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন পরিবেশ এবং শেখ হাসিনার মত দৃঢ় নেতৃত্ব। আর এ কারণেই জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ সকল উন্নয়ন সংস্থার কাছে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য অনুসরণীয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের এই উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম