তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী সমাসন্ন?
আশঙ্কাগুলো কখনোই উড়িয়ে দেবার মতো নয়। পৃথিবী ব্যাপী যে সব সামরিক তৎপরতা চলছে, তাতে করে যে কোনো সময় যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে উঠতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালী ও মালাক্কা প্রণালীর বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে যে মানসিক ও সামরিক বৈরিতার চাপ তৈরি হয়েছে, এবং তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, সেই সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোটের তৎপরতা যেমন গোটা পরিস্থিতিকে চমকে দিচ্ছে, তাতে করে এই শঙ্কা অমূলক নয় যে, যে-কোনো সময় তাকে আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তর করে ফেলতে পারে।
এ-হলো এক দিককার চিত্র। এই সামরিক চিত্রের পাশে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেকার মানসিক ও সামরিক শক্তির দৃশ্যপট। কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সামরিক টানাপোড়েন আজকের না হলেও, একে কেন্দ্র করেও চলছে দ্বন্দ্ব। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার ২০০৭ সালে গড়ে ওঠা সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট ‘কোয়াড’, যাকে আজকে বলা হচ্ছে একটি মিনি জোট বা মিনি ন্যাটো, সেই জোটে বাংলাদেশের মতো ছোটো ও গরিব দেশকে যোগ দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীন ও পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা, এবং বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সাবমেরিনের টহল ভারতের পক্ষে মেনে নেয়া সহজ হচ্ছে না। বিশেষ করে সেই সাবমেরিন যখন চীনের কাছে থেকে কেনা, তখন বৈরিতা তো ডবলই হবে।
অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগর ও ভূ-মধ্যসাগরে এসে টহল দিচ্ছে রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ। আছে ব্রিটেনের নৌ-বহরও। ভূ-মধ্যসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মার্কিনী রণতরী। বলা যায় ত্রিপক্ষই মুখোমুখি আজ। সিরিয়ার রাশিয়ান ঘাঁটির শক্তি বাড়িয়েছে ভ্লাদিমির পুটিন। তিনি কেবল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের পক্ষেই আছেন তা নয়, গোটা মিডিল ইস্টে তার সামরিক শক্তির প্রদর্শনও করছেন। এ-সপ্তাহেই রাশিয়া সিরিয়ার ঘাঁটিতে মিগ-৩১ এর সমাবেশ ঘটিয়েছেন তিনি হাইপারসনিক কিলঝিল মিসাইলসহ।
ওই মিসাইলের পাল্লা ২ হাজার মাইলের মতো। তার মানে সিরিয়ার ওই ঘাঁটি থেকে যে কোনো শত্রুকে আঘাত হানার মতো শক্তি নিয়ে রাশিয়া প্রস্তুত। ওদিকে ব্রিটেনের যুদ্ধ জাহাজ কুইন এলিজাবেদ টহল দিচ্ছে মেডিটারিয়ানে। তারাও প্রস্তুত। আসে মার্কিন রণতরীও। এই সব সামরিক যুদ্ধাস্ত্রযজ্ঞের মূল নিহিত আছে ক্ষমতার দাপট আর তার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের নীল নকশা। আছে নব-উত্থানপর্বে থাকা পরাশক্তি চীনের গতিরোধ করে দেয়ার পরিকল্পনা।
এই যে রণতরীর সমাবেশ কৃষ্ণ ও ভূ-মধ্যসাগরে, যে কোনো কারণে কোনো পক্ষ যদি গোলা ছোঁড়ে,(একমাস আগে ব্রিটিশ রণতরীর ক্রিমিয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাশিয়ার পানিসীমা অতিক্রম করায় গোলাও ছুঁড়েছিলো বলা হচ্ছে) তাহলে গোটা বিশ্ব চলে যাবে আরেকটা মহাযুদ্ধের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর দোরগোড়ায়।
রাশিয়া, চীন, ইরান ও তুরস্ক একটি সামরিক জোট গড়ে উঠতে যাচ্ছে। যা ন্যাটো জোটের বিপরীতে আরেকটি শক্তিবলয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এই জোটের সাথে আছে পাকিস্তানও। কারণ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও আমেরিকার ‘কোয়াড’ প্রকাশ্যে আসছে আবার। তবে এই জোটের অন্যতম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে সামরিক জোট বলতে রাজি নয়। তারা চায় একে অর্থনৈতিক জোট হিসেবে গণ্য করতে। এই জোটে যোগ দেবার আমন্ত্রণ পেলে,এখনো সেই প্রস্তাব আসেনি কোনো স্কোয়াড সদস্যেও কাছে থেকে, বাংলাদেশ কি করবে তা জানা যায়নি। কোয়াডে যোগ দেবার কোনো প্রস্তাব উত্থাপনের আগেই চীনের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ‘হুশিয়ারি’ দিয়ে বলেছেন বাংলাদেশের উচিত হবে না ওই জোটে ঢোকা। চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী।
করোনা মোকাবিলায় চীন বাংলাদেশকে সিনোফার্মার টিকা দিয়েছে এর মধ্যেই। চিকিৎসা ক্ষেত্রে চীন বড় রকমের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল ও আবাসনখাতে চৈনিক স্টাইলের নগর গড়ে তোলারও প্রস্তাব করেছে। তিস্তা নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ভাবনার জেরে তারা এ-নদীর বাংলাদেশ অংশে উন্নয়ন প্রকল্পই কেবল নেয়নি, তার সাথে নদীর দুই পারে বেঁধে সেখানে উন্নয়ন সহায়ক ব্যাপক কর্মযজ্ঞের আয়োজন করছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দেবে বলে মনে হয় না। এছাড়া ‘কোভিড-১৯ এর টিকা কূটনীতি’র আলোকে চীন ও রাশিয়া বিশেষ মানবিকতার পরিচয় দিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের প্রভাব বলয় গড়ে তোলার সুযোগ বাড়িয়েছে। কেবল উন্নয়ন সহযোগীই নয় চীন ও রাশিয়া অন্যান্য খাতের পাশে আছে বলে নিজেদের তুলে ধরেছে। চীনের ও রাশিয়ার ‘পুনরুত্থানে’ চিন্তিত পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র।
বোধহরি , তাই ২০১৭ সালে পুনরায় মাথা তুলে গোটা বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ‘কোয়াডে’র মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি প্রতিরোধে এই জোট ‘মালাবার যৌথ নৌ-মহড়া’ করে তাদের শক্তির একটা নমুনা দেখিয়েছে। এটা মূলত চীনের বিরুদ্ধে একটি প্রচ্ছন্ন ইঙিগত। দ্য রিম অব প্যাসিফিক এক্সারসাইজের (রিমপ্যাক) এর আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে কোয়াডের নৌ অনুশীলন তার একটি উদাহরণ। কোয়াডের সাথে যুক্ত হতে পারে নিউজিল্যান্ডও। তারা এর মধ্যেই ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স অ্যারেঞ্জমেন্ট’ এবং ‘ফাইভ আইজে’র মাধ্যমে কোয়াডের সঙ্গে সহযোগিতায় নেমেছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়া ছিলো দুই পরাশক্তির একটি। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয় সোভিযেত ইউনিয়নের পতনের পর। সোভিয়েত ভেঙে গেলে তার শক্তিরও ভারসাম্য হারায়। গত চল্লিশ বছর ধরে পৃথিবীর একক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষমতার দন্ডটি ঘুরিয়ে আসছে। পৃথিবীর নানাপ্রান্তে যুদ্ধ বাঁধিয়ে যেমন জনজীবন, সামাজিক জীবন ধ্বংস করেছে, (আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার ধ্বংসস্তুপ তার প্রমাণ) তেমনি সমরাস্ত্রের ব্যবসাও করেছে একচ্ছত্র বলয়ের আওতায়। আর ওই সময়ে চীন নিজেকে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত বা রূপান্তরিত করেছে। রাশিয়া ভেতর থেকে তৈরি হচ্ছিল। মার্কিনী মুরোলিপনা মোকাবিলায় রাশিয়া নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে। সে এখন আরেক পরাশক্তির দ্বারপ্রান্তে। ফলে নৈতিকভাবে ও আদর্শগতভাবে রাশিয়া এখন চীনের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে ন্যাটো জোটের তুরস্ক তার সামরিক শক্তি বাড়াতে রাশিয়ার সামরিক অস্ত্র কিনেছে। এ-নিয়ে তার সাথে আমেরিকার বিরোধ চলছে এখন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের সার্বিক উন্নতির পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি ইসতানবুলের ইউরোপীয়ান অংশের একটি খাল পুনরুদ্ধার করেন। ওই খালটি এখন বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের প্রধান নৌ-পথ হবে। কারণ খালটি দুটি সাগরকে সংযুক্ত করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে ‘কোয়াড’ একটি সামরিক জোটে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। কারণ তারা নানা কায়দায় অনেক দেশকেই কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উদগ্রিব হয়ে আছে। ন্যাটোর দুই সদস্য জার্মান ও ফ্রান্সকে কোয়াডে নেবার জন্য চেষ্টা করছে। গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা ধীরে ধীরে রূপ পরিবর্তন করে নিচ্ছে বোঝা যায়। এতে করে পৃথিবী জুড়ে এক উদগ্র সামরিক চেতনার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে, যা মানুষের জন্য খুবই খারাপ। আর ওই খারাপ কি আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের দামামা?
লেখক : সাংবাদিক, সাবেক অ্যাসোসিয়েট এডিটর, যুগান্তর, কবি ও চিন্তক
এইচআর/জিকেএস