আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ০৫ জুলাই ২০২১

বাংলাদেশ এখন এক অনিবার্য নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি। সবাই জানতেন করোনার তৃতীয় ঢেউ আসবে এবং আগের দুটি ঢেউয়ের চেয়ে যে তৃতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা বেশি হবে, এটাও কারও অজানা ছিল না। করোনার এ ঢেউ এখন সুনামির মতো ধেয়ে আসছে। মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। টানা আটদিন শতাধিক মৃত্যুর ঘটনায় মনে হচ্ছে, করোনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া বুঝি আমাদের আর কিছু করার নেই। সরকার নানা উদ্যোগ, চেষ্টার কথা বলেন। কিন্তু করোনার ঢেউ এসে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু। প্রতিরোধের সব বাঁধই যে বালিতে তৈরি।

আগের দুটি ঢেউয়ে করোনার মূল আক্রমণ ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে। কিন্তু এবার করোনা যেন কৌশল পাল্টেছে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের চেষ্টা এবার। সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢুকেছে অবাধে। এখন চারপাশ থেকে ঢাকার দিকে ধেয়ে আসছে করোনা, ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে। তাতেই মৃত্যু আর সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

ঢাকার বাইরে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাটা নগ্নভাবে ফুটে উঠছে। সারাদেশের তুলনায় ঢাকা-চট্টগ্রামের চিকিৎসা সুবিধা অনেক ভালো। তাতেও প্রথম দুই দফায় হাসপাতাল, আইসিইউ ও অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার ছিল। কিন্তু করোনা ছড়িয়ে পড়ায় এখন আইসিইউর অভাবে, অক্সিজেনের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন ১৩০-১৪০ জনের মৃত্যু দেশজুড়ে কান্নার রোল তুলেছে। ‘৫২ শতাংশ হাসপাতালে আইসিইউ নেই’, ‘আইসিইউ নেই ৩৫ জেলায়’, ‘অক্সিজেন-সঙ্কটের সময়ই মারা গেলেন পাঁচ রোগী’, ‘একের পর এক ভাঙছে মৃত্যুর রেকর্ড’- এ ধরনের বেদনাদায়ক শিরোনাম এখন পত্রিকার পাতায় পাতায়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিক দিন সংসদে তোপের মুখে পড়েছেন। সাংসদরা তার পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় তার অসহায়ত্ব তুলে ধরেছেন। বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পুরো শহরকে হাসপাতাল বানালেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। এটা ঠিক, করোনার দায় সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। কিন্তু করোনার বিস্তার রোধ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অবশ্যই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সমন্বয়হীনতা তো ছিলই, সময়ের সিদ্ধান্ত সময়ে নিতে না পারার ব্যর্থতাও ছিল।

বিশ্বে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় চীনের উহানে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে প্রথম রোগীর দেখা মেলে ৮ মার্চ, ২০২০। তার মানে বাংলাদেশ তিন মাসেরও বেশি সময় পেয়েছিল করোনা ঠেকানোর। কিন্তু বাংলাদেশ করোনা ঠেকাতে কিছুই করেনি। যেন আমরা অপেক্ষা করছিলাম কখন করোনা আসবে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বারবার পূর্ণ প্রস্তুতির কথা বলে আসছিল। তখন বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী একবার বলেছিলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শূন্য প্রস্তুতি নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতির গল্প শুনিয়েছে। তবে করোনার মতো একদম নতুন ভাইরাসের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতিকে তবু অনভিজ্ঞতা হিসেবে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু দেড় বছর পরে এসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো অজুহাতই আর শোনার সময় নেই।

প্রথম দুটি ঢেউ থেকে শিক্ষা নিয়ে তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলায় আমাদের অনেক দক্ষ প্রস্তুতি দরকার ছিল। বিশেষ করে করোনা যখন ভারতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল, তখনই আমাদের বোঝা উচিত ছিল, ভারতের ঢেউয়ের আঘাত বাংলাদেশেও লাগবে। আর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট করোনার আগের যে কোনো ধরনের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে বটে, তবে সেটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। ভারতের সাথে আনুষ্ঠানিক চলাচল বন্ধ করা হলেও অনানুষ্ঠানিক চলাচল বন্ধে কোনো উদ্যোগ ছিল না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বাংলাদেশে এখন সংক্রমণের বেশিরভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছিল, আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।

গত বছর আমরা ভাগ্যের অনেক সহায়তা পেয়েছি। সংক্রমণের ভয়াবহতাও কম ছিল। মৃত্যুও তুলনামূলক কম ছিল। উন্নত বিশ্বে যখন মৃত্যুর মিছিল, তখন বাংলাদেশে তুলনামূলক কম। ভাগ্যের এ সহায়তা নিয়েও আমাদের আত্মতুষ্টি কম ছিল না। কিন্তু আজ যখন উন্নত বিশ্ব প্রায় করোনামুক্ত, তখন আমরা এগিয়ে চলেছি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে। প্রধানমন্ত্রীর কৌশলী উদ্যোগে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল। কিন্তু ভারতে করোনার সুনামি আমাদের টিকা পরিকল্পনায় বাধ সাথে। এখন নানা উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। নানামুখী চেষ্টার পরও বাংলাদেশের মাত্র চার ভাগ মানুষ টিকা পেয়েছে। ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনতে আমাদের লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

কিন্তু ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা পর্যন্ত তো আমাদের বসে থাকার উপায় নেই। তাই টিকায় প্রতিরোধের আগে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি দিয়ে করোনাকে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। নানা সময় সাধারণ ছুটি, বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ নানা চেষ্টা হলেও কোনোটাই কার্যকর ছিল না। আমরা বারবার সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়েছি, সরকার বললেও তারা শোনে না। কিন্তু ১ জুলাই থেকে প্রমাণিত হয়েছে, সরকার বলার মতো করে বললে মানুষ ঠিকই শোনে বা শুনতে বাধ্য হয়। এটা ঠিক লকডাউন যত কঠোরই হোক, তা করোনা ঠেকাতে পারবে না। লকডাউন দেয়া হয় করোনা বিস্তারের চেইন ভাঙতে, ঢেউয়ের তীব্রতা কমাতে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে। আপাতত জনবিচ্ছিন্নতা ছাড়া আমাদের হাতে করোনা ঠেকানোর কোনো অস্ত্র নেই। তাই যত কষ্টই হোক আমাদের লকডাউন মানতে হবে, ঘরে থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

গত দেড় বছরে করোনা ঠেকাতে উদ্যোগের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যতটা আলোচনায় এসেছে, তার চেয়ে বেশি এসেছে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার জন্য। এই সময়ে দুর্নীতির দায়ে আলোচিত সাহেদ-সাবরিনাসহ অনেককেই কারাগারে যেতে হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কারোই কিছু হয়নি। করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্থের কোনো সঙ্কট নেই। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, টাকা যতই লাগুক, টিকা আনা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করার সক্ষমতাও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেই। করোনাকালেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের অর্থ ফেরত গেছে।

করোনা মোকাবিলায় সবাইকে মিলেই কাজ করতে হবে। কিন্তু নেতৃত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই। তাদের আরও দক্ষ হতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। সর্বনাশের আশায় বসে থাকা আর বসে বসে লাশ গোনা কোনো কাজের কথা নয়।

এইচআর/এএসএম/ফারুক

করোনা মোকাবেলায় সবাইকে মিলেই কাজ করতে হবে। কিন্তু নেতৃত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই। তাদেরকে আরো দক্ষ হতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। সর্বনাশের আশায় বসে থাকা আর বসে বসে লাশ গোনা কোনো কাজের কথা নয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।