বানাতে, না বানাতে ভাঙে কেন ব্রিজ?

শাহানা হুদা রঞ্জনা
শাহানা হুদা রঞ্জনা শাহানা হুদা রঞ্জনা
প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ০৪ জুলাই ২০২১

 

বেশ কয়েকবছর আগে একটা অদ্ভ’ত সেতুর ছবি দেখেছিলাম সংবাদমাধ্যমে। সেতুর এই ছবিটি খবর হয়েছিল এজন্য যে, সেতুটা খালের ওপর দিয়ে না বানিয়ে খালের পাশ দিয়ে বানানো হয়েছিল। সেতু হবে নদী বা খালের আড়াআড়ি, পাশাপাশি নয়। কিন্তু এই সেতুটা খালের সমান্তরাল করে বানানো হলো। কেন এভাবে একটি সেতু বানিয়ে ফেলে রাখা হলো, এর কারণ বোঝা খুব কঠিন ছিল না। সেতু খাতে বরাদ্দ টাকার একটা অংশ খরচ করা হলো, বাকিটা পকেটস্থ হলো। কিন্তু কাউকে কোন জবাবদিহি করতে হলো না। ব্যবহার করা না গেলেও, সেতুতো হলো।

গ্রামে যারা থাকেন, তারা জানেন যে একটি ব্রিজ, কালভার্ট, পাকা রাস্তা তাদের জন্য কতটা দরকারি। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সুযোগ স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাজার সব হাতের কাছে চলে আসে। গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং জীবনধারাই পাল্টে যায়। গ্রামে যখন পাকা রাস্তা, সেতু, কালভার্ট থাকেনা, তখন মাইলের পর মাইল হেঁটে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যেতে হয় ঝড়-বৃষ্টি, কাটফাটা রোদ, ঠান্ডা বাতাস-কুয়াশার মধ্যে। কোন মানুষ অসুস্থ হলে বা গর্ভবতী মাকে টেনে-হেঁচড়ে হাসপাতালে নেয়ারও উপায় থাকেনা।

অবকাঠামোগত উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন, একথা বলা না গেলেও বলতে হবে, এর উপর একটি গ্রাম, থানা, জেলা এবং পুরো দেশের অনেককিছু নির্ভর করে। যেমন শুধু যমুনা ব্রিজ হওয়াতে উত্তরাঞ্চরের সাথে দেশের অন্য এলাকার যোগাযোগ দারুণভাবে উন্নতি হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটবে।

জেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে প্রতিবছর তো এগুলো তৈরি বা মেরামতের কাজ হয়না। তাই যখন হয়, তখন সেটা যেন শতভাগ মান বজায় রেখে হয়, এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। অথচ গণমাধ্যমে এরকম অনেক খবর প্রকাশিত হচ্ছে, যা দেখলে কষ্ট হয়, মনে ক্ষোভ তৈরি হয়। জনগণের করের টাকা এভাবে নষ্ট করাটা পাপ। গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে চোর ধরাও সম্ভব হয় না, দাবি-দাওয়া নিয়ে শহরে আসাও কঠিন হয়ে যায়।

খবরে দেখলাম, ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় বোরাখালি খালের ওপর নির্মিত তিনটি সেতু ও একটি কালভার্ট ধসে পড়েছে। লোকজন বলাবলি করছেন সেতু তিনটি পাইলিং না করেই তৈরি করা হয়েছে বলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। খবরে লিখেছে দুই মাস আগে বোরাখালি খালে খননকাজ করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। অপরিকল্পিত খননের কারণে সেতুগুলোর দুই পাশের মাটি সরে যাওয়ায় বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেতু ও কালভার্ট ধসে পড়তে শুরু করেছে।

কী অবাক করা একটা বিষয়, নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যে তিনটা সেতু ও একটা কালভার্ট প্রায় কাছাকাছি সময়ে ধ্বসে গেল। এখানে দুটি প্রশ্ন মনে আসে- প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে কেন এমন দুর্বল তিনটি সেতু বানানো হলো যে, তা নির্মাণের কয়েকবছরের মধ্যে ভেঙে পড়লো? আর পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনরকম ধারণা ছাড়াই কেন খালের দুই পাশে ৮ থেকে ১২ ফুট করে গর্ত খনন করলো যে, পানির চাপে সেতুগুলো ধ্বসে গেল?

পাউবোর মতো একটি প্রতিষ্ঠান যে অপরিকল্পিতভাবে খালটির দু’পাশে খনন করলো এই কাজের জবাবদিহিতা কোথায়? সেতুগুলো এত অল্পসময়ের মধ্যে কেন ভেঙে গেল, এর জবাবে কর্তৃপক্ষ যে কারণ দেখিয়েছেন, তা শুনলে আবারো প্রমাণিত হবে দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, প্রকল্পগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই।

তারা বলেছেন, এই নদ থেকে অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক বালু উত্তোলন করা হয়েছিল বলে সেতুর পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। তাই পানির তোড়ে সেতুটি ধসে গেছে। বন্যার পানি কমলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করা যেতে পারে। বাহ কী সুন্দর কথা। এর মানে হচ্ছে পাউবো, সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ, প্রকল্প অফিস, সওজ সবাই সবার মতো আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে এবং এর ফলে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার ভার বহণ করতে হয় জনগণকে।

জনগণের মঙ্গল ও সুবিধার জন্য সরকার অবকাঠামোগত যেসব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তা জনগণেরই করের টাকায় করা হয়। যদি বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে কাজটি করা হয়, তাও সেই ঋণ সুদসহ জনগণকেই শোধ করতে হয়। ভাবার কোন কারণ নেই যে এই টাকাগুলো কেউ এমনি এমনি দিয়ে যায়। সেতুর পর সেতু বানানো হয়, এরপর সেতুটির মাঝবরাবর বা পিলার ধসে পড়ে যায়, বা অংশবিশেষ দেবে যায়। আর জনগণের করের টাকা এইভাবেই অসৎ মানুষের পকেটে চলে যায়।

এরকম আরো শত শত কাজের হিসাব দেয়া যাবে। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় বন্যার পানির তোড়ে সেতুর মাঝখানের একটি পিলার ও দুটি স্প্যানের ৪০ মিটার ধসে পড়েছে। সুনামগঞ্জের-জগন্নাথপুর সড়কে নির্মাণাধীন একটি ব্রিজ উদ্বোধনের আগেই ধসে পড়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ ২০১৯-২০ সালে ৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজটি শুরু করেছিল।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সেতুর অংশ দেবে যায়, পিলার নড়েচড়ে উঠে, পানি বেড়ে গেলে বিপর্যয় শুরু হয়। এতে করে ঐসব সেতুর উপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়ে আশেপাশের গ্রামের মানুষ। অনেক রকমের চেষ্টা তদবির করে গ্রামের মানুষ একটা পাকা সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট পায়। এরপর যখন সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন দেখা যায় কোন কর্তৃপক্ষই সার্বিক বা একক দায়িত্ব গ্রহণ করেন না।

গ্রামের লোকজনের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম ছিল হয়তোবা সেই রাস্তা বা সেতুগুলো। ফলে তাদের যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অনেকসময় নদীতে ব্যাপক স্রোত থাকায় নৌকা নিয়ে পার হওয়াটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এসব এলাকার মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় বছরের পর বছর ধরে।

এইসব নির্মাণ কাজ যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পায়, এদের অনেকেই ঠিক মানসম্মত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা পয়সা খরচ করে. বিভিন্নভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ ও তদবির করে কাজ পায়। এই কাজ পেতে গিয়ে যে টাকা তাদের ব্যয় করতে হয়, সেই টাকা আদায় করার জন্য, তারা নির্মাণ কাজে নিচুমানের দ্রব্য ব্যবহার করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

আমরা মনেকরি যদি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ঠিকমতো চেপে ধরা যায়, তাহলে ভেঙে পড়া রাস্তা, সেতু, গর্ত সবই সারিয়ে নেয়া সম্ভব। গণমাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর ছাপা হয়, কর্তৃপক্ষ যদি সেই মোতবেক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন, ঘুষ, চুরিদারি, টাকা ভাগাভাগি বন্ধ করা যায়, তাহলে হয়তো প্রান্তিক মানুষের কিছু উপকার হবে। যেমন নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক সম্প্রসারণ কাজের ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায়, তিনি নিজের টাকা খরচ করে সড়কের পাশে করা গর্তগুলো বালু দিয়ে ভরাট করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

সরকার ভালো উদ্যোগ নেয়ার পরও কিছু অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অসততার কারণে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, আর সরকার বেকায়দায় পড়ে। যেমন জানুয়ারি মাসে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মধ্যে যে ঘর দিয়েছিলেন, তা ভেঙে পড়েছে। ঘরের মালিকরা অভিযোগ করেছেন যে, ঘর তৈরিতে খারাপ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে।

অনেক ঘরের জানালার পাল্লা লাগানো হয়নি, দেয়াল ফেটে যাচ্ছে, মেঝের সিমেন্টের পলেস্তার উঠে যাচ্ছে, শুরু থেকে ছিল না পানি ও বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যবস্থা। এছাড়া খালের কিনার থেকে মাটি তুলে নতুন ঘর তৈরিতে নিচু অংশ উঁচু করা হয়েছে। এখন বৃষ্টির পানির চাপে সেই মাটি ধসে যেতে শুরু করেছে, এমন অভিযোগও উঠেছে।

বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম আলো একটা মলাট পেইজ বের করেছিল, ‘সেতুসংখ্যা’ নামে। সেখানে আমরা দেখেছিলাম নানা রকমের সেতুর কাহিনি। কোনটা অর্ধসমাপ্ত, কোনটা অসমাপ্ত, সমাপ্ত কিন্তু সড়ক নেই, এপ্রোচ রোড নেই ফলে লোকে নৌকা দিয়ে চলাচল করে। অথবা একটা সেতুর পাশেই আরেকটা সেতু। আমরা এখনো কিন্তু সেই অবস্থাতেই আছি, এগুতে পারিনি।

মানুষের জানার অধিকার ও জানতে চাওয়ার অধিকার যতোদিন না প্রতিষ্ঠিত হবে, ততোদিন এভাবেই আমাদের মনে মনে প্রশ্ন করে যেতে হবে ”বানাতে না বানাতে ভাঙে কেন ব্রিজ?”।
৩ জুন, ২০২১

লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর,মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

এইচআর/এমএস

মানুষের জানার অধিকার ও জানতে চাওয়ার অধিকার যতোদিন না প্রতিষ্ঠিত হবে, ততোদিন এভাবেই আমাদের মনে মনে প্রশ্ন করে যেতে হবে ”বানাতে না বানাতে ভাঙে কেন ব্রিজ?”।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।