দায় রাজনীতিকদেরই
রাষ্ট্রের কাজ পরিচালনায় আমলাদের কারণে রাজনীতিকরা 'ম্লান' হয়ে যাচ্ছেন বলে জাতীয় সংসদের চলমান অধিবেশনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন সদস্য। গত সোমবার সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় প্রবীণ রাজনীবিদ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন প্রথমে প্রসঙ্গটি তুলেন। তিনি বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা যারা এই জাতীয় সংসদের সদস্য, এমন একজনও নাই যিনি এই করোনাকালীন সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে বা যেভাবেই হোক গরীব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছে। আমি আমার নিজের এলাকায় ৪০ হাজার মানুষকে রিলিফ দিয়েছি। এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মানুষ মনে করে আমরা যা দেই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেয়”।
বাংলাদেশে করোনা ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রী এমপিসহ মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ হয়তো কিছু করছেন৷ কিন্তু প্রশাসনিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে তারা অনুপস্থিত৷ ফলে যারা জনপ্রতিনিধি তাদের কাজ চলে গেছে আমলাদের কাছে৷ আমলারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন৷ ফলে সাধারণ মানুষ কোনো কিছু জানতে জানতে পারছেন না৷
মুলত এ নিয়েই কথা বলেছেন তোফায়েল সহ কয়েকজন। কিন্তু রাজনীতিকদের নিজেদের ভেতরকার অবস্থানে কতটা ফাটল আছে তা প্রমাণিত হয়েছে একদিন পরই। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জেলা পর্যায়ে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়াকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
তোফায়েল আহমেদের সাথে সুর মিলিয়ে আরও কয়েকজন সংসদ সদস্য সেদিন সংসদে উত্তাপ ছড়িয়েছেন। তাদের এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক আবার কিছুটা অস্বাভাবিকও। বর্তমান বাস্তবতায় এই জনপ্রতিনিধিরা দেশ শাসনে নিজেদের অবহেলিত মনে করছেন। কিন্তু একথা কি বললে বেশি বলা হবে যে, এ জন্য তারা নিজেরাই দায়ী?
স রকারি কর্মীর কর্তব্য হলো দেশের মানুষের সেবা। বাস্তবে কাজটি সহজ নয়। গণতন্ত্রে সংসদ সদস্য, অন্যান্য জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীরাই দেশবাসীর প্রতিনিধি। তাদের নির্দেশ পালন সরকারি কর্মীদের কাজ। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটুকু পারেন সেই নির্দেশনা সত্যিকারভাবে দিতে? জনগণের কল্যাণের দায়িত্ব যেহেতু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, তাই নীতি প্রণয়নের দায়িত্বও তাদের। আমলাদের কোন সুযোগ নেই তার বিরোধিতা করা। করতে পারেন শুধু নীতি ও বিধি-বিধান সমুন্নত রাখতে। তাদের অধিকার আছে ন্যায়-বহির্ভূত, আইন-বিরোধী নির্দেশ অমান্য করবার।
সমস্যা উভয়ের। আমলাতন্ত্রের অচলায়তন নানাভাবে মন্ত্রীদের জনহিতকর উদ্যোগ নস্যাৎ করতে পারে। বাইরে আনুগত্যের অভিনয় করে কার্যত সরকারি প্রক্রিয়ার জটিলতার ফাঁদে মন্ত্রীদের আটকাতে আমলাদের জুড়ি নাই। ক্ষমতার দম্ভে নাগরিকের প্রতি সরকারি কর্মীর দুর্ব্যবহার এবং উদাসীনতার দৃষ্টান্তও ভূরি ভূরি। তবু দিনান্তে নীতি, সেবা-পরিষেবার জন্য সরকারি কর্মীর উপরেই নির্ভর করতে হয়। তাদের সততা, দক্ষতা ও সাহস গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। ক্ষমতার নিকট তিনি ঝুঁকে পড়লে দেশ সিধা দাঁড়াতে পারে না। সরকারের উপর নাগরিক সমাজের নজরদারির যতই নূতন প্রকরণ বের হোক, সরকারি দফতর সমূহের অভ্যন্তরে নৈতিক জোরটি বজায় না রাখলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে আমলারা ক্ষমতার নিকট শুধু ঝুঁকেই পড়ছেন না, বলা যায় ক্ষমতা শুধুই তাদের হাতে এবং সেটা তাদের অনেকেই যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন।
সেদিন সংসদে তোফায়েল আহমেদের চেয়েও বাস্তব কথা বলেছেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ। তার ভাষায়, রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, “দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎশেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথছ এই দেশ স্বাধীন করেছে রাজনীতিবিদেরা”।
একজন সংসদ সদস্যের আসল কাজ আইন প্রণয়ন। কিন্তু সেই কাজে কতজন সাংসদের মনোযোগ আছে? আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় তারা খুব সামান্যই অবদান রাখেন। বেশিরভাগ বিল কোনোরুপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা বিতর্ক ছাড়াই পাস হয়ে যায়। একটা আইন কতটা জনগণের উপকারে আসবে, কতটা জটিলতা সৃষ্টি করবে, কতটা সংবিধান সম্মত- এমন কোন আলোচনা সংসদ সদস্যরা আজকাল আর করেন না।
সংসদ অধিবেশন চলাকালে আলোচনায় অংশ নেওয়া বেশিরভাগ সংসদ সদস্যই গঠনমূলক কোনো বক্তব্য দেন না। ক্ষমতাসীন দলের সিংহভাগ সাংসদ বেশিরভাগ সময় আলোচনার সময় খরচ করেন হয় সরকারের প্রশংসায়, নইলে বিরোধী দল বা সরকারের সমালোচকদের নিন্দায়। সংসদে প্রণীত আইনের পর্যালোচনা বা তাতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে সংসদ সদস্যদের। কিন্তু তারা সেটা প্রয়োগ না করে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন।
সংসদ সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তাই আমলাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। নিজেদের দোষেই কাজী ফিরোজ রশিদের ভাষায় তৃতীয লাইনে চলে গেছেন সংসদ সদস্যরা। সাংসদদের দুরবস্থার বড় প্রধান কারণ - রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমলাতন্ত্রের ব্যবহার করা। এখন অনেকেই বলছেন, খেলছেন আমলারা, দেখছেন রাজনীতিকরা। কেউ কেউ অবশ্য একথাও বলেন যে, এখনকার সময়ে আমলারাই বড় রাজনীতিক।
এই রাজনীতিবিদরাই আমলাদের সুরক্ষা দিয়েছেন। সংসদে তারাই আইন পাস করেছেন যে, অপরাধ আদালত কর্তৃক প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন সরকারি কমর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। অথচ তাদের নিজেদের কিন্তু সামান্য অভিযোগেই ধরে নিয়ে যাওয়া যায়। নিজেদের জনপ্রতিনিধি বানাতে, অর্থাৎ সোজা বাংলায় নির্বাচনে জিতে আসতে প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবহার করলে আমলারা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বিষয়গুলোতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সুযোগ পেয়ে যান। আর তাদের সব কাজের জবাবদিহি চাওয়ার নৈতিক ক্ষমতাও রাজনীতিবিদরা হারিয়ে ফেলেন। প্রশাসনের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করার জন্য এই সুযোগটি ব্যবহার করেছেন আমলারা।
সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক হচ্ছেন জনগণ আর তাদের ভোটে নির্বাচিতদেরই দেশ পরিচালনার কথা৷ কিন্তু কাজকর্মে সংসদ সদস্যদের খবর নেই, আর সচিবরা সব কাজ করেন, মন্ত্রীরা অনেক কিছুই জানতে পারেন হয়ে যাওয়ার পর। এখন প্রশাসনের সচিব বা পদস্থ কর্মকর্তারা অবসরের পরই রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এমপি মন্ত্রী হতে চান৷ আর কাজটি শুরু করেন সরকারি চাকরিতে থাকার সময়ই৷ তারা সরকারি চাকরিতে থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, সভা সমাবেশে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্যও দেন। এর দায় রাজনীতিবিদদের৷ তারা নিজেরাই আমলা নির্ভর হয়ে আমলাশাহী কায়েম করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইটআর/এমএস