সাঈদ খোকনের হুমকির উদ্দেশ্য কী
ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখছিলাম ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের। একটি নিউজ চ্যানেলের সংবাদ ক্লিপিং, যেখানে সাঈদ খোকনের প্রেস ব্রিফিং তারা লাইভ দেখিয়েছিল। সেখানে খোকনের চিৎকার, কেন, কেন হুঙ্কার দেখে আমি তো অবাক- এটা সংবাদ সম্মেলন নাকি জনসভার মাঠের বক্তৃতা! সংবাদ সম্মেলনে আবার ভক্ত সমাজের স্লোগান! সেখানে তার মূল বক্তব্য হচ্ছে, তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারের লোকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে দুদক। প্রশ্ন তুলেছে, মেয়র হানিফের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউয়ের ব্যাংক হিসাব কেন জব্দ করা হবে?
সেই সঙ্গে ঢাকাবাসীর জন্য তার পরিবারের কথিত অবদানের গল্প বলেছেন খোকন। নানা মাজেদ সর্দারের কথা বলেছেন। মূল সুর হচ্ছে তাদের এতো এতো বিশাল অবদান এই ঢাকাবাসীর জন্য- তারা কেন আইনের মুখোমুখি হবেন? অবদান রাখতে গিয়ে তারা নাকি ব্যবসাও করতে পারেননি- করলে দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী হতেন। কিন্তু তাদের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া বিশাল অংকের টাকা, সম্পদ কোন জমিদারি থেকে এসেছে- দেখলে সমস্যা কী বুঝলাম না! তার তো উচিত অন্যায় হয়ে থাকলে আইনের আশ্রয় নেয়া। কিন্তু তিনি তা না করে প্রয়োজনে সংগ্রামের হুমকি ছাড়লেন। সংগ্রাম কার উদ্দেশ্যে, হুঙ্কার কাকে- যেটুকু সম্প্রচারিত হয়েছে তাতে অবশ্য বোঝা যায়নি। তবে দুদকের এই তৎপরতার পেছনে মেয়র তাপসের প্ররোচনা রয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
পত্রিকায় দেখলাম সাঈদ খোকনের ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়টি আদালত ও দুর্নীতি দমন কমিশন- সংশ্লিষ্ট বলে উল্লেখ করেছে ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের পক্ষ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগ। আরও বলেছে, বিচারাধীন কোনো বিষয়ে বর্তমান মেয়র কোনো ধরনের বক্তব্য বা প্রতি-উত্তর দিতে নিরুৎসুক। উল্লেখ্য, গত ২৭ জুন সাঈদ খোকনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবসহ তার মা ফাতেমা হানিফ, স্ত্রী ফারহানা আলম ও বোন শাহানা হানিফের মোট আটটি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত।
অবশ্য সাঈদ খোকনের অভিযোগ অস্বীকার করে দুদক বলছে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে তারা কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করে না। অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ থাকবে। মনে করা হচ্ছে যে অতীতে বেশ টাকা-পয়সার অস্বাভাবিক লেনদেন আছে। জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলোতে মোট কত টাকা আছে দুদক এখনও কিছু বলেনি।
সাঈদ খোকনের প্রেস কনফরেন্সে হুমকির পর নানা কথা উঠছে। প্রথম কথা হচ্ছে তিনি এ ঘটনায় প্রেস কনফারেন্স না করে প্রথমেই তো আদালতে যাওয়া উচিত ছিল। কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে সহজপন্থা হচ্ছে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। তবে কি তার উদ্দেশ্য গত মেয়র নির্বাচনে নমিনেশন প্রাপ্তির দৌড়ে যার কাছে হেরেছেন সেই তাপস? কারণ পত্রিকায় প্রেস কনফারেন্সের বিস্তারিত যা খবর এসেছে তাতে তার লক্ষ্য তাপসই বোঝা যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে তাপসের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, কত শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তা এই শহরের মানুষ জানে। যা হোক, ক্ষমতায় আছেন, কাজ করেন। ঢাকার মরা মানুষের ওপরও ট্যাক্স বসিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে মানুষের ভালোবাসা আশা করেন। হাস্যকর বিষয় হচ্ছে সাঈদ খোকনের নিজের নির্বাচনটিও স্বচ্ছ ছিল না। জোর জবরদস্তির অভিযোগ আছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে। সে নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, তাপসের নির্বাচনে তা ছিল না- এ অভিযোগ করা যেতে পারে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না বলেই তাদের রায় হাইজ্যাক করে তাপস নির্বাচিত হয়েছেন ভোটাররা মনে করেন না, যেটা সাঈদ খোকনের বেলায় করেন।
তাপসের বিরুদ্ধে নগর পরিচালনা করতে পারেন না বলেও অভিযোগ খোকনের। আর দশটা নাগরিক এ অভিযোগ করলে শোভা পায়। কিন্তু মেয়র হিসেবে ব্যর্থতা যার ষোলআনা, মশার যন্ত্রণায় যেখানে রাজধানীবাসী ঘুমাতে পারেনি, ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়ার মরছে অগণিত- সেখানে খোকনের অভিযোগ তামাশার মতো শোনায়।
সমালোচকরা অবশ্য এর নাম দিয়েছেন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় নিজেরা নিজেরা ক্ষমতার লড়াই করছেন। দুর্নীতি–দুর্বৃত্তায়ন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে বলে বিরোধও হচ্ছে। সাবেক ও বর্তমান দুই মেয়র পাল্টাপাল্টি যেসব অভিযোগ করছেন তা তদন্ত হওয়া দরকার মনে করেন সমালোচকরা।
গত জানুয়ারি মাসেই তাপস-খোকনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। দলের নীতিনির্ধারকদের হস্তক্ষেপে মাঝখানে কয়েক মাস দুজনই চুপ ছিলেন। তাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে সিটি করপোরেশনের কিছু দোকান উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ ওঠে সাঈদ খোকন মেয়র থাকার সময় অবৈধভাবে বিপুল অর্থ নিয়ে অনিয়ম করে সেসব দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এনিয়ে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে একজন দোকান মালিক মামলাও করেছিলেন।
সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। যার ফলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশনা এসেছে এখন। সিটি করপোরেশনের অবৈধ দোকান নিয়ে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ আসে তখন ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্য সমাবেশ করে ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে পাল্টা অনিয়মের অভিযোগ আনেন সাঈদ খোকন। তখন তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, মেয়র তাপসের মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে সিটি করপোরেশনের শত শত কোটি টাকা হস্তান্তর করেছে। এর জবাবে মেয়র তাপস তখন বলেছিলেন, এতে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি।
সাঈদ খোকনের এই হুঙ্কারে আবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আওয়ামী ‘পরিবারের সন্তান’ তথা মেয়র হানিফের ছেলে হিসেবে এতদিন তিনি দলের উচ্চমহলের যে আশীর্বাদ পেয়েছিলেন তা হারিয়েছেন কিনা? তাকে দ্বিতীয় দফা মনোনয়ন না দিলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যদিওবা ক্ষমতার বাজারে এর কোনো প্রভাব বা জৌলুস নেই।
সাঈদ খোকন এক-এগারকালে দল ত্যাগ করে ফেরদৌস আহমেদ কোরাইশীর কিংস পার্টি বলে খ্যাত প্রগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ভিড়েছিলেন। ঢাকার কিছু দুর্বৃত্ত সাংবাদিকের সঙ্গে তার ওঠাবাসা, তারাও তখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলতো। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ওই গোষ্ঠী এবং সাঈদ খোকন আওয়ামী লীগের মধু খেতে ফিরে আসেন।
খোকনের পিতা মোহাম্মদ হানিফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত স্টাফ ছিলেন। সেই সুবাধে কালক্রমে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হন এবং অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র হন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে। মেয়র হিসেবে মোহাম্মদ হানিফ দৃষ্টান্তমূলক কোনো কাজ করে যাননি, মশা আর ডেঙ্গু উৎপাদনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধেও ছিল।
সিটি করপোরেশনে দুর্নীতির হাট বসেছিল। মানুষ সহজে সব ভুলে যায়। এ নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট- কার্টুনগুলো দেখলে সবার মনে পড়ে যাবে। তারপরও আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক অবদানের কথা মাথায় রেখে মোহাম্মদ হানিফের নামে ঢাকায় উচ্চমূল্যে নিম্নমানের একটি ফ্লাইওভার করেছে, তার ছেলে মেয়র হয়ে আজিমপুর গোরস্তানে বাবার নামে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ করেছেন।
হানিফকে আওয়ামী লীগ মূল্যায়ন করে মেয়র হিসেবে তার কাজের জন্য নয়, দলের জন্য তার নিষ্ঠার কারণে। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনাকে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে রক্ষার জন্য মানবঢাল হিসেবে যারা ঘিরে রেখেছিলেন তাদের মধ্যে মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন অন্যতম। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ তৈরিতেও হানিফের অবদান ছিল অসামান্য। সেসবের পুরস্কার ছেলে হিসেবে সাঈদ খোকন যথার্থই পেয়েছেন। কিন্তু নিজের যোগ্যতা প্রমাণে এবং প্রতিদান দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। ফলে কখনো হুমকি-ধামকি, কখনো চোখের জল দিয়ে তিনি পার হতে চাইলেও বাড়তি সুবিধা আর পাবেন না ধরে নেওয়া যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/এএসএম