আধুনিক নারীর মানসিক দৈন্য

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ৩০ জুন ২০২১

নাসরীন আক্তার

দুনিয়া বদলে যাচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বদলে যাচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক জীবন। পারিবারিক কাঠামো। আমাদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, রুচি আসবাবপত্র, দিন যাপনের রীতি। কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে বদলাচ্ছে না আমাদের মানসিকতা, চিন্তার খাঁচা।

আমরা মেয়েরা বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছি। কর্পোরেট চাকরি করছি। কিন্তু সমাজের হাজার বছরের পুরাতন ধ্যান-ধারণার বৃত্তটিকে ভাঙতে পারছি না। গত কয়েক দশকে নারীরা অনেক এগিয়েছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিশেষকরে কৃষিখাত, পোশাকশিল্পে নারীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। নারীরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে এখন পুলিশ, সেনাবাহিনিতে যোগ দিয়েছে। রোগের জটিল অস্ত্রপচার করছে, বিমান চালাচ্ছে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু এ নারী তার পারিবারিক পরিমন্ডলে কতটা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছে সে নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে।

আজও পরিবারে আর্থিক ব্যয় ও পরিচালকের আসনটি কিন্তু পুরুষেরাই দখল করে আছে। আর সে কারণে যতই নারী ক্ষমতায়নের কথা বলি সে ক্ষমতা কিন্তু নারী তার পারিবারিক কাঠামোতে অর্জন করতে পারেনি। এর কারণ যতটা না সমাজ বা পুরুষ তারচেয়ে নারী নিজে। নারীর ভ্যানিটি ব্যাগে টাকা এলেও মগজের জড়ত্ব সে আজও ঘুচাতে পারেনি।

আমি ছোট বেলায় আব্বাকে দেখেছি ইনকামিং পারসন হিসাবে, যিনি পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব পুরোটা পালন করতেন। আম্মা সামলাতেন ঘরের কাজ। রান্না ঘরেই যিনি দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতেন। সন্তান পালন আর তাদের জন্য মুখরোচক খাবার বানানোই ছিল আম্মার কাজ। পড়াশুনা পুরোপুরি শেষ না করলেও আম্মা ছিলেন আধুনিকমনা। তিনি বলতেন,মেয়েরা সব করবে। পড়াশুনা, চাকরি, অন্যান্য শখের কাজ। আম্মা বলতেন, মেয়েরা চাকরি করলে স্বাধীনতার স্বাদ পায়। এসএসসি পাশের আগেই অল্প বয়সে আম্মার বিয়ে হয়ে যায়। আব্বা চাইলেও আম্মা আর পড়াশুনা করেননি। ঘরই সামলালেন। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা বাইরে কাজ করলে সংসারে স্বচ্ছলতা বাড়ে এবং মেয়েরা নিজেদের পরিচয়ে সমাজে টিকে থাকে, এই কথাটি আম্মা বিশ্বাস করতেন।

আমরা এখনকার মেয়েরা তো পড়াশুনা করার সম্পূর্ণ সুযোগ পেয়েছি এবং পড়াশুনা শেষে অনেকেই মোটা অংকের চাকরিও করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা মেয়েরা সংসারের অন্যান্য দায়িত্ব নিলেও অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে ততোটা স্বতঃস্ফূর্ত নই। আমরা চাই ছেলেরা মূলত সমস্ত খরচ বহন করুক। ভাবটা এমন যেন ছেলেরা তাদের আয়ের ১০০ ভাগ খরচ করার পর যদি টান পরে তখন না হয় আমরা মেয়েরা সংসারের জন্য ব্যয় করবো। ছেলেদেরই তো সিংহভাগ খরচ করা উচিত। তবেই সে দায়িত্ববান ও উদার ছেলে হিসেবে পরিচিত হবে। নিজেদের সুবিধার জন্য অনেক সময় আমরা দীর্ঘদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চলে আসা প্রথা বা ধর্মের দোহাই দিয়ে বলি সংসারের খরচ তো ছেলেদেরই করা উচিত। সংসারে টাকা খরচের এই সমীকরণটি মেয়েদের মন ও মগজে ঢুকিয়েছে আমাদেরই পরিবার আর সমাজ। এখনকার শিক্ষিত মেয়েরা ছেলেবেলায় দেখেছে বাবারাই আয় করে,খরচ করে এবং সংসারে কর্তৃত্ব স্থাপন করে থাকে।

উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং উচ্চ বেতনে চাকরি করা সত্ত্বেও আমাদের মানসিক দৈন্যতা কাটেনি। আমরা এটাও মেনে নিতে পারিনা যে একটি মেয়ে সংসারে কখনো কখনো প্রয়োজনে তার স্বামীর চেয়ে অধিক ব্যয় করতেই পারে। বিষয়টি তো এমন নয় যে, স্বামী সব সময় তার স্ত্রীর চেয়ে বেশি আয় করবেই। স্বামী যদি তার স্ত্রীর চেয়ে কম আয় করে, তবে কি করে সে বেশি ব্যয় করবে? এমন পরিস্থিতি হলে অনেক মেয়েই তা মানতে পারে না।

এমন অবস্থায়, কোনো কোনো মেয়ে সংসারে অধিক ব্যয় করে মানসিক কষ্টে ভোগে। তারা সমাজের অন্য একটি পরিবারের সাথে নিজের পরিবারের তুলনা করতে থাকে। যেখানে ঐ পরিবারে আর একটি মেয়ে তার স্বামীর চেয়ে কম খরচ করে কিংবা নামমাত্র খরচে অভ্যস্ত। বেশিরভাগ মেয়েই সেই মেয়েটিকে সুখী মনে করে। এমন ভাবনায় মানসিক যন্ত্রণা বাড়ে। দূরত্ব তৈরি হয় দুজনের মাঝে। অন্যদিকে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি ব্যয় করলেও ছেলেদের তেমন কোনো মানসিক যন্ত্রণা হয় না। তারা ভেবেই নেয় সংসারে অধিক খরচ তাদেরকেই করতে হবে।

স্বল্প ব্যয় আর অধিক সঞ্চয় করতে পারলে মেয়েরা সুখ অনুভব করে। মেয়েটির পরিবার,বন্ধু মহল,কলিগরা তখন বলতে থাকে যে, সে একটি ভালো ছেলে পেয়েছে, যে কিনা দায়িত্ব নিতে জানে। এদিকে সংসার খরচের ভার নিতে নিতে স্বামী বেচারার কখনো কখনো আর সঞ্চয়ের হিসাব মাথায় থাকে না। কোনো বিশেষ দিনে জামাই বাবু তার প্রিয়তমাকে গিফট দিতে না পারলে বা দিনটি ভুলে গেলে তবে সে হয়ে উঠে মোস্ট আনরোমান্টিক পারসন। অনেক সময় কৃপণ বলতেও ভুল হয় না। এদিকে অর্থনৈতিকভাবে সিকিউরড্ মেয়েটি এইসব বিশেষ দিনগুলো মনে রেখে গিফট্ প্রদানের মাধ্যমে পরিবার আর সমাজের চোখে সে এক অনন্য সামাজিক নারী হয়ে ওঠে।

ধরা যাক স্বামী স্ত্রী দুজনেই সমান আয় করে এবং তা মোটামুটি ভালো অংকের। এ অবস্থায় ছেলেটি যদি তার স্ত্রীকে সংসারে ফিফটি ফিফটি খরচের প্রস্তাব দেয়, তবে নারীটি তখন দারুণ কষ্ট পায় এইভেবে যে, তার সাথী অধিক হিসাব নিকাশ করছে। অথচ এই আমরাই পাশ্চাত্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলি.. "ওরা কতো সুন্দর জীবন যাপন করে। নারী পুরুষ সব কিছুই সমান ভাগে ভাগ করে নেয়। তাইতো তারা উন্নত জীবন ভোগ করে।" আমাদের বর্তমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে যেখানে ছেলে মেয়ে উভয়ই বাইরে কাজ করে সেখানে ছেলেরা অর্থ উপার্জন ছাড়া যে একেবারেই সংসারের অন্য কোনো দায়িত্ব নেয় না তা তো নয়।

বাড়িতে নানা কাজে তাদের সহযোগিতা থাকে। ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গী পালটাচ্ছে। তারা বাইরের কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজেও নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। এমন একদিন হয়তো আসবে যেদিন গৃহকর্মী না থাকলেও আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না। নারী পুরুষ উভয়ই তখন ঘরে বাইরে সমান সমান কাজ করবে। "ফিফটি ফিফটি ব্যয়".. এই কথাটির সাথে মেয়েরা মানিয়ে নিবে। মেয়েরা ভাবতে শিখবে, সঞ্চয় শুধু মেয়েরা করেই আনন্দ পাবে না; ছেলেরাও নিজেরা সঞ্চয় করে সেই আনন্দের অংশীদার হবে।

আসলে সংসারে ব্যয়ের বিষয়টি নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী তার খুশীমত কিছু খরচ করে বাকিটা সঞ্চয় করলেও স্বামীর মনে কোনো ক্ষোভ থাকে না। সবই হতে পারে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে। কোনো কারণে স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কারো চাকরি চলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে অপরজনকে সংসার ব্যয়ের পুরো দায়িত্বই নিতে হতে পারে। কোনো কারণে স্বামীর অর্থ উপার্জন কমে গেলে স্ত্রীর উচিত তখন তাকে মানসিক সাপোর্ট দেয়া। পাশে থাকা। কখনো কখনো মেয়েদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয় নানা কারণে। সন্তান প্রতিপালন তার একটা বড় কারণ। সেক্ষেত্রে ছেলেরা সংসার চালিয়ে নেয়। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেনো, পরস্পরের প্রতি সহযোগী মনোভাব ও আস্থা রাখা উচিত।

সংসারে নারী পুরুষ উভয়ের আয় সমান না-ই হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যার আয় বেশি সে-ই ব্যয় বেশি করবে, এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা উভয়েরই থাকতে হবে। পুরুষ সদস্যটি অধিক আয় করতে পারছে না বলে আমরা এমন ভাব দেখাই যেনো এটা তার ব্যর্থতা কিংবাতার যোগ্যতা কম। মনে রাখতে হবেযে, অধিক অর্থ উপার্জনের সাথে পড়াশুনা বা যোগ্যতার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।

অনেক ছেলেকেই দেখেছি বা শুনেছি বর্তমান সময়েও যে তার আয়ের পুরোটাই তার সহধর্মিণীর ( গৃহিনী/কর্মজীবী) হাতে তুলে দিতে। কিন্তু এমন ঘটনা খুবই বিরল যেখানে নারীটি তার আয়ের পুরোটা তার স্বামীর হাতে তুলে দেয়। যদিওবা তার স্বামী কিছুকাল বেকার থাকে। ছেলেরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখি সে তার সাথীকে দামী দামী জিনিস গিফট করতে। শাড়ি-গয়না থেকে শুরু করে বাড়ি-গাড়ি পর্যন্তও। কিন্তু এমন কোনো সলভেন্ট মেয়ে দেখিনি যে তার স্বামীকে ভালোবেসে এ ধরনের কিছু গিফট করতে।

মেয়েদের এক্ষেত্রে বলতে শোনা যায়, ছেলেরা নাকি মেয়েদের বড় কিছু দিয়ে আনন্দ পায় কিংবা ছেলেরা তাদের দাপট দেখাতে পছন্দ করে। তা-ই যদি হয় তবে সে কাজ তো মেয়েরাও করতে পারে। তাহলে তারা তা করে না কেনো? আসলে মেয়েরা তা করে না এইজন্য যে, তারা চায় অর্থনৈতিকভাবে অধিক নিরাপদ থাকতে। এক্ষেত্রে মেয়েরা উদার নয়। ছেলেরা যত বেশি সলভেন্ট হয় দায়িত্বের ভার ততো বেশি ঘাড়ে চাপে। অপরদিকে মেয়েদের সলভেন্সি বাড়লে মেয়েরা অধিক সঞ্চয়ী হয় এবং দায়িত্ববোধ কমতে থাকে।

আমরা নারীরা পুরুষের সাথে সমান তালে চলতে চাই। চলছিও। আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে সচেতন। পড়াশুনা করছি। চাকরি কিংবা ব্যবসা, সব করছি। সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত অনেকেই। শিল্প ও সংস্কৃতিমনা। সবই বুঝি। তো সংসারটা যে উভয়ের এটাও বুঝতে হবে। সেক্ষেত্রে শেয়ারিংটাও বুঝতে হবে। দায়িত্ববোধ নিয়ে সংসারে ব্যয় করতে হবে। প্রয়োজনে পুরুষের চেয়ে অধিক অর্থ খরচে বেদনা বোধ কেনো? এ ব্যাপারে আমরাও উদার মনোভাব দেখাতে পারি। যার সাথে বসবাস করছি সেতো পর নয়। তার হাত ধরে কতোই না সুখের স্বপ্ন দেখেছি ! স্বপ্ন বুনেছি!

লেখক : শিক্ষক।

এইচআর/এমএস

আমরা মেয়েরা সংসারের অন্যান্য দায়িত্ব নিলেও অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে ততোটা স্বতঃস্ফূর্ত নই। আমরা চাই ছেলেরা মূলত সমস্ত খরচ বহন করুক। ভাবটা এমন যেন ছেলেরা তাদের আয়ের ১০০ ভাগ খরচ করার পর যদি টান পরে তখন না হয় আমরা মেয়েরা সংসারের জন্য ব্যয় করবো। ছেলেদেরই তো সিংহভাগ খরচ করা উচিত।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।