লাঠি ভাঙলে বিষধর করোনা তো ফণা তুলবে?
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
অতিমারি করোনাকালে সবচেয়ে ভীতিকর সংবাদ হলো চিকিৎসকের অকাল মৃত্যু। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে এত বড় অদমনীয় ভয়ংকর রোগ আর আসেনি, রোগীর সাথে সাথে চিকিৎসকও এত বেশি সংখ্যায় প্রাণ বিসর্জন দেননি। ধনী দেশের দামী দামী হাপাতালের বাঘা বাঘা চিকিৎসকগণ ঘাবড়ে গিয়েছেন। তবে তুলনামূলকভাবে আমাদের দেশের চিকিৎসকদের মৃত্যু হার ওদের চেয়ে অনেক বেশি।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার সারা বিশ্বে ২.৫ কিন্তু বাংলাদেশে ৪%। এই হার ২০২০ সালেই বেড়ে গিয়েছিল। ঢাকা ট্রিবিউন জুন ২০, ২০২০ রিপোর্ট করেছিল, “ডক্টরস্ মর্টালিটি রেট ইন বাংলাদেশ হাইয়েস্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড”। অক্টোবর ১৫, ২০২০ এর মধ্যে বাংলাদেশে ১০০জন ডাক্তার প্রাণ হারান। তবে এক বছর পর জুন ১৪, ২০২১ সালে এই সংখ্যা ১৫৫ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা শুধু আমাদের জন্য নয়- বিশ্বের চিকিৎসা জগতে বেশ ভয়ংকর খবর।
প্রথমদিকে কিছুটা অবহেলা করায় করোনা মোকাবেলার কাজে ফ্রন্টলাইনাররা বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন। চীনের পর বৃটেনে সবার সামনে চিকিৎসকগণ মারা যেতে থাকেন। সে সময় একটি মেমোরিয়াল পেজে করোনার আক্রমণে প্রাণ বিসর্জনকারী বৃটেনের ৪৩ জন ডাক্তারের ছবি ছাপিয়ে উৎসর্গ করা হয়েছিল। যা বিশ্ববাসীর হৃদয়কে করুণভাবে নাড়া দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারপর শুরু হয় তোলপাড়। সেখানেও মারা যেতে থাকেন প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে ডাক্তারগণ। এই খবরে দেশে দেশে ভয়ের সাথে দারুন সংকটে পড়ে যায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তখনও ভারতীয় উপমহাদেশে করোনার তাণ্ডব শুরু হয়নি। এরই মাঝে আমাদের দেশে ডাক্তারগণের মধ্যে সর্বপ্রথম সিলেট মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দীন (৪৭) করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ঘটনাটি দেশের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। শুরু হয় করোনাভীতি।
জুন ১৫, ২০২০ আমাদের দেশে ১২০০ স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়ে পড়েন। মারা যান ৩৬ জন চিকিৎসক। সেই সাথে পুলিশ ও অন্যান্য ফ্রন্টলাইনারদের মধ্যে মৃত্যুহার বেড়ে গেলে চরম সংকট তৈরী হয়। বিএমএ বলেছে, ২০২০ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৫ জন চিকিৎসকের প্রাণহানি ঘটে। তার কারণ আমরা সবাই অনুধাবন করতে পেরেছি অনেক পরে। যখন জানা গিয়েছিল আমাদের আমদানী করা মাস্ক, পিপিই ইত্যাদি ছিল ভুয়া, নকল। সেসব চিকিৎসা সামগ্রী পরে অকুতোভয় বীর চিকিৎসকগণ অকালে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সবার সামনে। পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছিল নকল করোনা রিপোর্ট ও অবৈধ চিকিৎসা নামক ব্যবসা। যা খুবই দুঃখজনক। বিশ্ব হতবাক হয়েছিল- কেন বাংলাদেশে এত ডাক্তার মারা গেলেন সেজন্য। অথচ আজও সেসব কুলাঙ্গার ও তাদের হোতাদের কঠিন শাস্তি হয়নি বরং তারা ছাড়া পাবার তদবিরে ব্যস্ত।
করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে গত বছর এত বেশি চিকিৎসকের প্রাণহানির কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হঠাৎ সংক্রমণ শুরু হলে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাই বেশ উদাসীন ছিলেন। প্রথম দিকে সবাই অনেকটা অপ্রস্তুত ছিলেন। হঠাৎ একটি অপরিচিত রোগের মোকাবেলায় অপরিকল্পিত প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমে এটা নেই, ওটা নেই, এটা করা উচিত, ওটা করা ঠিক হয়নি, ইত্যাদি নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির সন্মুখিন হয়েছেন চিকিৎসকগণ। তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তা কিটস্, মাস্ক, পিপিই ইত্যাদির চরম সংকট ছিল। তৎসঙ্গে নকল সামগ্রী সরবরাহ শুরু করেছিল অসৎ সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা। ফলত ভেজাল ও মানহীন নকল চিকিৎসা সামগ্রী ব্যবহার করে চিকিৎসকগণ দায়িত্ব পালনের শুরু থেকেই আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের আবাসন, পরিবহন, খাদ্য সরবরাহ, অতিরিক্ত ডিউটি ইত্যাদি নিয়েও ক্ষোভ দেখা দেয়। এছাড়া প্রশাসনিক ও মানসিক চাপ নিয়ে অনেককে কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। অনেকে দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজে আক্রান্ত হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।
দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড ১৮ এপ্রিল ২০২১ জানিয়েছে, চিকিৎসকের এই মৃত্যুহারের গতি এবছর এপ্রিলে আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এপ্রিলের ১৬ দিনে ১৭ জন চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন। গত ০৪ জুন একদিনে পাঁচজন চিকিৎসক মারা গেছেন। গত ২৭ এপ্রিল যশোরের একতা হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল ওহাবের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এপর্যন্ত আমাদের দেশে করোনায় সর্বশেষ চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। জুন ১০, ২০২১ পর্যন্ত মোট ১৫৫ জন চিকিৎসক মারা গেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে। চিকিৎসকের এই মৃত্যু আমাদের জন্য বড় অপূরণীয় ক্ষতি বলে জানিয়েছে বিএমএ।
এপ্রিল ০৪, ২০২১ পর্যন্ত আমাদের দেশে আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ২,৯১১ জন। নার্স ১,৯৯৮ জন, স্বাস্থ্যকর্মী ৩,২৯৫ জন। একজন নারী চিকিৎসক এক বছরে তিনবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবুও তিনি ঘাবড়িয়ে যাননি বা দায়িত্ব ছেড়ে যাননি। কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় তিনি জানিয়েছেন, সুস্থ হলেই আবার দায়িত্ব পালন শুরু করবেন। মানবতার কল্যাণে সদা তৎপর তাঁর অদম্য মনোবল সবাইকে বড় অনুপ্রেরণা দান করেছে।
দায়িত্ব পালন করতে গিযে প্রায় সব দেশেই চিকিৎসকগণ কমবেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ভারতে এপর্যন্ত মোট ৯৮০ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। তার মধ্যে প্রথম ঢেউয়ে মারা গেছেন ৭৩৬ জন ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে এপর্যন্ত ২৪৪ জন চিকিৎসক। ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন (আইএমএ) জানিয়েছে, এক দিনে (মে ১৩, ২০২১) সর্ব্বোচ্চ ৫০ জন চিকিৎসক মারা গেছেন।
ভারতে ১২ লাখেরও বেশি চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্উাকে একটানা ৪৮ ঘন্টা কাজ করতে হচ্ছে। বিশ্রাম ছাড়া একটানা করোনা রোগীর সেবায় কাজ করে শরীরে অবসাদ নিয়ে নিজেরা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হবার সুযোগ না পেয়ে অনেকে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। আইএমএর জেনারেল সেক্রেটারি ডা. জয়েশ লেলে এনডিটিভিকে বলেছেন, “এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা গত রোববার ভারতজুড়ে ৫০ জন এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে দ্বিতীয় ঢেউয়ে ২৪৪ জন চিকিৎসককে হারিয়েছি।’আইএমএ আরও জানিয়েছে, কোভিডের কারণে এ পর্যন্ত এক হাজার চিকিৎসক মারা গেছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। আইএমএ কেবল তাদের প্রায় সাড়ে তিন লাখ সদস্যের রেকর্ড রাখে।”(ডেইলী স্টার মে ১৮, ২০২১)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে গত ৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে কৃষ্ণাঙ্গ চিকিৎসক সুসান মুরকে (৫২) ইন্ডিয়ানা হাসপাতলে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়েছে। কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে ৮ জানুয়ারি২০২১ বাংলাদেশী চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। নিউ জার্সির একই পরিবারের বাবা-মেয়ে দুজনই চিকিৎসক ছিলেন। করোনায় দেব খান্না (৭৮) ও প্রিয়া খান্না (৪৩) দুজনই মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক সহ মোট ৩,৬০০ স্বাস্থ্যকর্মী করোনার প্রথম বছরে মারা গেছেন (মেডস্কেপ ১৩.জুন ২০২১)।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় বছরে চিকিৎসা সামগ্রীর উৎপাদন বেড়েছে, গুণগত মান বেড়েছে, সরবরাহ বেশি হচ্ছে। আবার কোন কোন দেশে চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে অক্সিজেন ও টিকার সংকট ভারতসহ আমাদের দেশকেও ভাবিয়ে তুলেছে। চিকিৎসকগণ সতর্ক হয়ে দায়িত্ব পালন করলেও সাধারণ মানুষ কোথাও সচতেন হয়েছেন আবার কোথাও কোথাও বেশি বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে স্বাস্থ্য বিধি লঙ্ঘন করে চলেছেন। তবে করোনা সংক্রমণের মারাত্মক প্রভাবে মানুষের মধ্যে অধৈর্য্য ও অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে। করোনার তথ্য আদান-প্রদান করা নিয়ে লুকোচুরি ও অসহযোগিতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। চীন করোনার উৎস নিয়ে উহানের সঠিক তথ্য এখনও প্রদান করছে না পেরু তার গোলমেলে তথ্য সঠিকভাবে প্রকাশ করার পরও দেখা গেছে তারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি করোনাক্রান্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে। কারণ তাদের মোট জনসংখ্যা কম।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির কথা বলা হলে কড়া সমালোচনা করে তা অস্বীকার করা হচ্ছে। টিআইবির গবেষণা রিপোর্টকে কর্তৃপক্ষ ‘ফ্যাশন’বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের রিপোর্ট মনগড়া, মুখস্থ বিদ্যার মত বুলি দিয়ে ঢালাও সমালোচনা বলেছেন স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ‘টিআইবির রিপোর্ট মিথ্যাচার, এটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না’, বলেছেন তিনি ডা. মাহমুদ মনোয়ারের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে বিশ হাজার চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
তবে যত কিছু করা হোক না কেন, তা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় এখনও অপ্রতুল। সম্প্রতি সীমান্তের ১৭ জেলাসহ প্রত্যন্ত গ্রামে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। লকডাউন দেয়া হয়েছে রাজশাহীসহ দেশের আরো ৭টি শহরে। এই সংক্রমণের প্রধান কারণ ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের উপস্থিতি। বিপজ্জনক এই ভেরিয়েন্টের সংক্রমণের শিকার হয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণহীন পড়লে মানুষ কি প্রতিবেশী দেশের গ্রামে আক্রান্ত মানুষের মত দিশেহারা হয়ে যাবে? সেটা এখন শুধু প্রশ্নই নয় বরং ভয়াবহ চিন্তা। কারণ আমাদের সীমান্তের জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ কিছুই নেই।
করোনা নামক কালসাপের বিষ নামানোর ঝানু ওঝা স্বরূপ চিকিৎসকগণ নিজেদের নিরাপত্তার দিকে না তাকিয়ে সর্বাগ্রে ছুটে গেছেন করোনা রোগীদের জীবন রক্ষা করতে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উল্লিখিত নানা কারণে ব্যাপক হারে চিকিৎসক মারা যাওয়ায় চিকিৎসা সংকট ঘণীভূত হয়েছে। তাঁদের জন্য সরকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেও তাদের পরিবার ঠিকমত সেটা পাচ্ছেন না। তাঁদের নির্ভরশীল পরিবারগুলোর খোঁজ কেউ নিচ্ছেন না। এ পর্যন্ত একজন চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কি-না জানা যায় নি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে চরম হতাশা। চিকিৎসক নামক লাঠিকে যত্ন সহকারে শক্ত হাতে ধরে রাখতে না পারলে করোনা নামক বিষধর সাপ আমাদের সবার মাথার ওপর ফণা তুলে অনন্তকাল ফোঁসফাস করতে থাকবে বৈ-কি?
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস