মহৎ শুভ ও কল্যাণকর অর্জনে আওয়ামী লীগ
নাজমুল হুদা ওয়ারেছী চঞ্চল
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় গতবছরের ন্যায় এবারও অনাড়ম্বরভাবে উদযাপিত হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭২ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বলছিলাম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেন থেকে ১৯৭১ সালের অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এবং আজ অবধি আওয়ামী লীগের পথ চলার কথা।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হবার পর ঢাকায় মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রণ ছিল মাওলানা আকরাম খান ও খাজা নাজিমুদ্দিন এর হাতে। সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী উদারপন্থী নেতারা তখন নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। সে সময় পুরান ঢাকার মোগলটুলীর ১৫০ নম্বর বাড়িতে কর্মী শিবির স্থাপন করে নতুন দল গঠনের আলোচনা শুরু করলেন তারা। শেখ মুজিবও তখন কলকাতা থেকে এসে এ শিবিরে যুক্ত হন।
তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ পদত্যাগের ফলে সৃষ্ট শূন্য আসনের উপনির্বাচনে দুই দফা মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন ভাসানী ও শামসুল হক। কিন্ত নির্বাচন কমিশন ফল অবৈধ ঘোষণা করায় তারাও এই মুসলিম লীগ কর্মীদের সাথে মিলে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে একটি সভা আহ্বান করেন। সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হলেন মাওলানা ভাসানী-ইয়ার মোহাম্মদ খান।
অডিটরিয়াম পাওয়া না যাওয়ায় কাজী হুমায়ুন রশীদ কেম এম দাস লেনে তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার প্রস্তাব করেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালের দিকে রোজ গার্ডেনে ২৫০-৩০০ লোকের উপস্থিতিতে ও আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্ত্বে নতুন দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, মাওলানা ভাসানী'র প্রস্তাবে দলের নামকরণ হয় "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ" আর পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নাম হয় "নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ" যার সভাপতি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
ভাসানী'র নেতৃত্ত্বে ৪০ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয় তন্মধ্যে
সভাপতি : মাওলানা ভাসানী
সহ-সভাপতি : আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আহম্মদ আলী খান, সাখাওয়াত হোসেন ও আব্দুস সালাম খান
সাধারন সম্পাদক: শামসুল হক
ট্রেজারার: ইয়ার মোহাম্মদ খান।
জেলে থাকাবস্থায় শেখ মুজিব হোন যুগ্মসাধারন সম্পাদক। আলী আহাদের বই থেকে জানা যায় সরকারের কড়া নজরদারির দরুন ২৩ জুনের দুয়েকদিন আগে বোরকা মতান্তরে কম্বল মুড়িয়ে ভাসানীকে সম্মেলন স্থলে উপস্থিত করানো হয়। আরও জানা যায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল (বর্তমান এটর্নি জেনারেল) একে ফজলুল হক সাবেব ও কিছুক্ষণের জন্য সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
২৪ জুন আরমানিটোলায় অনুষ্ঠিত নতুন দলের সভায় হামলা চালায় মুসলিম লীগ কর্মীরা।
৫২ সালে শামসুল হক সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেখ মুজিব হোন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। ৫৩ সালে পুরান ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে ও ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সম্মেলনে ভাসানী-মুজিবকে নতুন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সে সময়ে হিন্দু মুসলিম আলাদা আসনে নির্বাচনে অংশ নিতো। এ কারণেই ৫৪ সালের নির্বাচনের সময়ে একটি সমঝোতা হয় যে অসাম্প্রদায়িকভাবে আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অংশ নিবে।
৫৪'র নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পায় ২২৩ আসন আর এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি আসন। ফ্রন্টের নেতা ছিলেন তখন ভাসানী, ফজলুল হক আর সোহরাওয়ার্দী। ৫৫ সালে সদরঘাটের রূপমহলে তৃতীয় সম্মেলনে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ" হয়। সোহরাওয়ার্দী'র প্রস্তাবে ভাসানী এ নাম পাস করান। এ সম্মেলনে ও ভাসানী-মুজিব কমিটি পুনর্বহাল থাকে। জানা যায় মুজিব-ভাসানী আগে থেকেই মুসলিম শব্দ বাদ দেয়ার পক্ষে ছিলেন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার আশংকায় প্রথমদিকে সোহরাওয়ার্দী রাজি হচ্ছিলেন না। ৫৫'র আগে হিন্দু কেউ দলের সদস্যও হতে পারতেন না। রূপমহল সিনেমা হলের সম্মেলনের মাধ্যমেই সকল ধর্মের মানুষের জন্যে আওয়ামী লীগের দরজা উন্মুক্ত হয়।
৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আমেরিকার সাথে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী মতবিভেদ দেখা দেয়।ভাসানী ও বাম ঘরানার অন্যরা সম্মেলন বয়কটের ঘোষণা দেন। এমতাবস্থায় পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে গণতান্ত্রিক ভোটাভুটিতে ভাসানী হেরে যাওয়ায় সেই রূপমহলেই নতুন দল "ন্যাপ" গঠন করেন তিনি। উল্লেখযোগ্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে ইয়ার মোহাম্মদ খান ন্যাপ-এ যোগ দেন। আর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হোন আব্দুর রশীদ তর্ক বাগীশ-শেখ মুজিব।
৫৮ সালে সরকার সামরিক শাসন জারি করে সকল ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ৬৪ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে ঘরোয়াভাবে রাজনীতি চালিয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ৬৪ সালে সোহরাওয়ার্দী মারা যাবার পর, রাজনীতি উন্মুক্ত হবার পর ৬ বছর প্রায় একা হাতে দলের হাল ধরে রেখেছিলেন শেখ মুজিব। তাই নেতাকর্মীরা তর্কবাগীশের পরিবর্তে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সভাপতি হবার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু তিনি প্রথমে রাজি হননি, পরে মন্ত্রিসভার সদস্য জাস্টিস মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে প্রস্তাব করা হয় উনিও রাজি না হলে তর্ক বাগীশ-মুজিব কমিটিই পুনর্বহাল রাখা হয়।
৬৬ সালের সম্মেলনে তর্কবাগীশ ছয় দফার বিরোধিতা করে সরে দাঁড়ানোয় মুজিব-তাজউদ্দীন নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ৬৮ ও ৭০ সালের সম্মেলনেও মুজিব-তাজউদ্দীন কমিটি পুনর্বহাল রাখা হয় আর এ কমিটির নেতৃত্বেই ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠনের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে দলের নাম "বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ" লিখা শুরু হয়।
৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নতুন সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু-জিল্লুর রহমান কমিটি গঠিত হয়। ৭৪ সালে বাকশাল গঠন করায় বঙ্গবন্ধু সরে দাঁড়ানোয় নতুন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হোন এইচ এম কামারুজ্জামান-জিল্লুর রহমান। ৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর ঘরোয়া রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নেতা মিজান চৌ. ও মোল্লা জালাল উদ্দিনকে নিয়ে নেতৃত্বের কোন্দল শুরু হওয়ায় দলীয় ঐক্য ধরে রাখতে ৭৬ সালে জোহরা তাজউদ্দীনকে আহবায়ক করে দলের নেতৃত্বভার দেয়া হয়। ৭৮ এর সম্মেলনে আব্দুল মালেক উকিল-আব্দুর রাজ্জাক হোন দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে ও আব্দুর রাজ্জাককে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ৮৩ তে বাকশাল গঠন করে রাজ্জাক সরে যাওয়ায় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ৮৭ সম্মেলনে দলের নেতা হন শেখ হাসিনা-সাজেদা চৌধুরী। ৯২ ও ৯৭-এর সম্মেলনে শেখহাসিনা'র সাথে সাধারণ সম্পাদক হন জিল্লুর রহমান। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলে আগের কমিটি পুনর্বহাল রাখা হয়।
২০০২ এর সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুল জলিল। ২০০৯ ও '১২ এর সম্মেলনে শেখ হাসিনা'র সাথে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফ। ২০১৬ ও '১৯ এর সম্মেলনে শেখ হাসিনা'র অনিচ্ছছা স্বত্ত্বেও তৃণমূল কাউন্সিলরসহ কেউই রাজি না হওয়ায় শেখ হাসিনা পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন, সাধারণ সম্পাদক হোন ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
ক. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংহত করা এবং রাষ্ট্রের স্বার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা সমুন্নত রাখা।
খ. প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করা।
গ. রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা।
ঘ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।
মূলনীতি: বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হইবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।
রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন "আওয়ামী লীগের অর্জন পাকিস্তান আমলের গণতান্ত্রিক মানুষের অর্জন। এই দলের অর্জন বাংলাদেশের অর্জন। জাতির জন্য যখন যা প্রয়োজন মনে করেছে, সেটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।" নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, নিজস্ব স্যাটেলাইট, জঙ্গি দমন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও অভূতপূর্ব উন্নয়নসহ দেশের প্রতিটি মহৎ, শুভ ও কল্যাণকর অর্জনে জড়িয়ে আছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সূত্র: লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমেদের বই আওয়ামী লীগের উত্থান এবং বিভিন্ন আর্টিক্যাল।
লেখক : সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।
এইচআর/এমএস