অমানিশার ঘোর অন্ধকারে মধ্যবিত্তের জীবন

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ২২ জুন ২০২১

লাভা মাহমুদা

ভুলটা অবশ্যই মধ্যবিত্তের ছিল না। চলমান জীবনে প্রতিনিয়ত যে সংকটের ভেতর দিয়ে মধ্যবিত্তকে যেতে হয়, তাতে ভুল করার সুযোগ কোথায়। গেল পনেরো মাসে নিম্নবিত্ত, যারা দিন এনে দিন খায় তারাও মোটামুটি সামলে নিয়েছেন। কাজ করছে, কোনমতে দিন গুজরান করছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের যে কোমর ভাঙলো, তা আর সোজা হলো না। কবে নাগাদ সোজা হবে বা আদৌ সোজা হবে কী না, সে প্রশ্নের উত্তর দেবারও কেউ নেই।

করোনাকালে পথ হারানো মধ্যবিত্তের জীবনযাপন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। সঞ্চয় নেই, বেহিসেবী খরচ, উচ্চাভিলাষী জীবন যাপন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়টি আসলেই তেমন নয়। মধ্যবিত্তের জীবন শুরুই হয় মোটামুটি শূন্য অবস্থা থেকে। আমাদের অর্থনীতির যে কাঠামো তাতে, নিম্নমাত্রার আয়ের সাথে উচ্চমাত্রার ব্যয়ের কোন সমন্বয় নেই। এই আয় ব্যয়ের বৈষম্যের ফারাকের কারণে মধ্যবিত্তকে সেই প্রথম জীবন থেকেই টেনেটুনে সংসার চালাতে হয়। ঘাত অভিঘাতের নানা সংকটে জীবনের সঙ্গে লড়াই চলে শেষ অবধি।

আগের মধ্যবিত্ত অনেক হিসেবি ছিল, তাই তো এতোটা সংকটে পড়ে নাই- অনেকেই এমন খেদোক্তি করেন। কিন্তু সমাজ এগিয়েছে, সেইসাথে পরিবর্তন এসেছে জীবন যাপন প্রক্রিয়ায়। একবিংশ শতকের জীবন মানের সাথে সেই বিংশ শতকের কোন মিল নেই, থাকার কথাও না। মুক্ত বাজার অর্থনীতি আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে মানুষের জীবন যাপনে বৈচিত্র্য এসেছে । তাই স্বাভাবিক ভাবেই ব্যয় বেড়েছে। পঞ্চাশ বছর আগের ধ্যান ধারণা দিয়ে এই সময়ে জীবনের গতি প্রবাহ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

কে জানতো হঠাৎ করে মহামারির উপদ্রব নিজের ঘরেই হাজির হবে, লণ্ডভণ্ড করে দেবে সবকিছু। তবে জানলেও করার কিছুই ছিল না। কারণ বিশেষ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অতিরিক্ত অর্থ জমিয়ে রাখার সামর্থ্য মধ্যবিত্তের কখনই ছিল না। যাদের সেই সামর্থ্য তৈরি হয়েছে, তারা উচ্চবিত্তের কাতারেই নাম লিখিয়েছে। আমাদের মধ্যবিত্ত তাই আজ বর্ণনাতীত বিপদের সম্মুখীন; নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে যাচ্ছে।

স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পেরুলেও আমরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারিনি। মৌলিক অধিকারগুলোই যেখানে নিশ্চিত করা যায়নি সেখানে রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আর্থিক সুরক্ষা কাঠামো তৈরি তো অনেক দূরের ব্যাপার। ফলে অচিরেই সব সামলে ফেলা যাবে, এমন নিশ্চয়তা রাষ্ট্রের পক্ষে দেওয়াও সম্ভব নয়। তাই যে দায় রাষ্ট্রের, আপদকালীন সময়ে তা চাপাতে চাইছি কখনো মধ্যবিত্ত কখনোবা নিম্নবিত্তের ওপর।

অথচ সামাজিক বিবর্তনের ধারায় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি 'একান্ত আপন' হিসেবে বিবেচিত। তারা যে সমাজে বাস করে, সেই সমাজ বা রাষ্ট্রকে তারা হৃদয়ে ধারণ করে। এই রাষ্ট্রে তার পূর্বপুরুষেরা দিন কাটিয়েছে, এখানেই তার উত্তর পুরুষেরা জীবন যাপন করবে- এমন ভাবনা তাদের মস্তিষ্কের কোষে ঝংকার তোলে।

আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা নিজেদেরকে সবসময়ই আত্মসম্মান আর অহমিকার আবরণে ঢেকে রাখে। সংকটে পড়লে তারা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে ঠিকই, কিন্তু সবার অলক্ষ্যে সেই সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খোঁজে। যতক্ষণ সেটা অনিবার্য সহ্যসীমা অতিক্রম না করে, ততক্ষণ তা গোপনই থাকে।

ফলে মধ্যবিত্তের সমস্যা সার্বজনীন হয়ে ওঠে না এবং সংগঠিত শক্তি হিসেবে তাদের দাবি সামগ্রিকভাবে দানা বাঁধতে পারে না। তাই চার দেয়ালের অন্দরেই তাদের নীরব কান্না, চাপা কষ্ট আটকে থাকে । করোনার সময়ে সৃষ্ট আর্থিক সমস্যা তারা নিজেরাই সামলানোর চেষ্টা করেছে । কিন্তু এটা এখন সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। মহামারির এই আপদকালীন সময়ে অনিবার্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা রকম হৃদয় বিদারক দৃশ্যের।

এই পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের বিকাশ থেমে গেলে সেটা সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য শুভকর হবে না। সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতাকে রোধ করবার জন্য, সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য মধ্যবিত্তের মূর্ত অবস্থানের কোন বিকল্প নেই। তাই যে ভাবেই হোক মধ্যবিত্তের ঝরে পড়া রোধ করতে হবে, না হলে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সমাজ এবং দেশ পিছিয়ে যাবে বহুগুণে।

মহামারির কালে টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রামে অসহায় মধ্যবিত্তের দেওয়ালে ঠেকা পিঠটা সোজা করার কঠিন উপায় হলো সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে টেকসই উন্নয়ন আর পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যূহ তৈরি করা। নইলে আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে মধ্যবিত্ত নামের শ্রেণিটি নিম্নবিত্তের কাতারে চলে যাবে অচিরেই। দেশের প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যা ভীষণ দুঃসহ এক অমানবিক জীবন যাপনে বাধ্য হবে। ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার নামে মরে যাবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে মধ্যবিত্ত নামের শ্রেণিটি নিম্নবিত্তের কাতারে চলে যাবে অচিরেই। দেশের প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যা ভীষণ দুঃসহ এক অমানবিক জীবন যাপনে বাধ্য হবে। ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার নামে মরে যাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।