মা ছিলেন আমার বাবা
অডিও শুনুন
শৈশবে বাবাকে হারিয়েছি। তার কোনো স্মৃতি নেই। নেই কোনো ফটোগ্রাফও। বাবা দেখতে কেমন ছিলেন জানি না। মানসপটে তার কোনো অবয়ব নেই। পরিবারের কারও কাছে কখনো সেভাবে জানতেও চাইনি বাবার কথা।
বাবার কথা মনে পড়লেই অশ্রুভারে সিক্ত হই। বিধাতা কেন তাকে এত তাড়াতাড়ি তার কাছে নিয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয়। ছোটবেলায় দেখতাম বন্ধুদের বাবাদের ঘিরে কতরকম আবদার আহ্লাদ। আমার সে সবের কোনো সুযোগ হয়নি।
আমার বেড়ে ওঠা গ্রামে। শৈশবে বিশেষ করে উৎসবের দিনগুলোতে বাবার কথা খুব মনে পড়তো। ঈদের নতুন জামা-জুতার আব্দার কার কাছে করবো। কাকে বলবো আমাকে মেলা দেখাতে নিয়ে যাও। খেলনা কিনে দাও। আকাশে ঘুড়ি উড়াবো, লাটাই- সুতা কিনে দাও। বই-খাতা কেনার কথাও বা বলবো কার কাছে। একটা শূন্যতা গ্রাস করতো। বাবার হাত ধরে বন্ধুরা যখন হাটে যেত আমারও সেরকম ইচ্ছে করতো। সবচেয়ে কষ্ট হতো বাবা ডাক ডাকতে না পেরে।
বাবার অবর্তমানে মা ছিলেন আমার বাবা। তিনি একই সঙ্গে মা এবং বাবার ভূমিকা পালন করতেন। বাবা মারা যাওয়ার ২৫ বছর পর মাও চলে যান অনন্তলোকে। এই দীর্ঘ বৈধব্যের মধ্যে বাবার শূন্যতা ভুলে তিনি সন্তানদের মানুষ করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ছোট ছিলাম বলে তখন এতটা বুঝতে পারিনি। এখন বুঝি মার একাকিত্ব। কিন্তু মা কখনো সেটি বুঝতে দেননি। আমার যত আব্দার মান অভিমান সবকিছু ছিল মাকে ঘিরে। মা ছিলেন গৃহিণী। পরিবারের প্রধান আয় ছিল কৃষি। বড় ভাই শিক্ষকতা করতেন। ১৯৭২ সালে গ্রাজুয়েন করেও পরিবারের পিছুটানে তিনি সরকারি চাকরিতে কিংবা ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো চেষ্টা করেননি সেভাবে। পিতৃহারা এতগুলো ভাইবোনকে মানুষ করতে গিয়ে তাকেও বাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সব গল্প মনে হয় একই রকম। খুব বেশি আলাদা নয়। নানা কষ্টেসৃষ্টে বড় হতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে সাংবাদিকতার অমসৃণপথে নিজেকে প্রতিষ্ঠার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। জীবনের এই বেলায় এসেও সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়- বাবাকে দেখতে না পারার বেদনা।
সমাজ বদলে যাচ্ছে দ্রুত। পরিবার ভাঙছে। দেখা দিয়েছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। পারিবারিক কলহ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সন্তানের হাতে পিতা, পিতার হাতে সন্তান খুন হচ্ছে। প্রবীণকালে মা-বাবাকে যেতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। ছোট, একক পরিবারে মা-বাবা যেন বোঝা।
জীবনের গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত পেরিয়ে আমিও এখন এক সন্তানের জনক। কৈশোরোত্তীর্ণ মুস্তানসীর রশীদ ঋষির মুখে বাবার প্রতিচ্ছবি দেখি। সময়ের পরিক্রমায় এভাবেই হয়তো বাবারা প্রতিবিম্বিত হন। পৃথিবীতে টাকার বিনিময়ে সব কিছু হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু কোনো কিছুরই বিনিময়েই মা-বাবাকে পাওয়া যাবে না। আমি আমার বাবাকে একনজর দেখার জন্য যে কোনো বাজিতে রাজি। অথচ এই বাবা-মাকে আমরা তুচ্ছ জ্ঞান করি নিজেদের ভোগ-বিলাসকে নির্বিঘ্ন করতে।
নয়ন সম্মুখে আজ বাবা-মা কেউ নেই। কিন্তু তারা আছেন নয়নজুড়ে। বাবা দিবসে আজ ফেসবুকের দেয়ালজুড়ে বাবাদের নিয়ে কতজনের কত স্তুতি। এটা যেন একদিনের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থাকে- তারা যেন থাকেন আমাদের হৃদয়-মননজুড়ে সবসময় গভীর ভালোবাসায়।
গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাবাদের প্রতি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস