সর্ষের ভেতরের ভূত তাড়াতে হবে আগে
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসান শুক্রবার মাঠে যা করেছেন, তা আর যাই হোক ক্রিকেট নয়। কিন্তু সাকিবকে যারা দেবতার আসনে বসিয়েছেন, তারা সাকিবের এই মাস্তানিসুলভ আচরণেও অপরাধ নয়, বীরত্ব খোঁজেন। এটা আমাদের মজ্জাগত সমস্যা, আমরা যাকে পছন্দ করি, তাকে দেবতার আসনে বসাই। যারা আওয়ামী লীগের সমর্থন করেন, তাদের চোখে আওয়ামী লীগের কোনো ভুল চোখে পড়ে না, বিএনপির কোনো গুণ চোখে পড়ে না। তাদের চোখে বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার কোনো ভুল নেই।
আবার বিএনপি সমর্থকদের চোখে জিয়া, খালেদা, তারেক দেবতাতুল্য। আমাদের এই অন্ধত্ব সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। খেলাধুলার ক্ষেত্রে এ অন্ধত্ব যেন আরও। বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারই আমাদের। তারা ভালো খেললে আমরা গর্বিত হই, খারাপ খেললে মন খারাপ হয়, গালি দেই। যেমন আশরাফুল আমার খুবই পছন্দের ক্রিকেটার ছিলেন। ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারিতে তার নাম আসার পর আমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। অভিমানে কয়েক বছর কোনো খেলাই দেখিনি। কিন্তু ইদানীং খেলোয়াড়দেরও সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠছে। সাকিব ন্যায়-অন্যায় যাই করুক, সবকিছুর পক্ষে যুক্তি আছে তার সমর্থকদের। এমনকি সাকিব যা বলেন না, তাও বলে দেন তার সমর্থকরা।
জুয়াড়ির সাথে সাকিবের প্রমাণিত সম্পৃক্ততা, দেশের হয়ে না খেলে আইপিএল খেলতে যাওয়া, দর্শককে পেটানো, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, মাঠে উইকেট ভেঙে ফেলা সবই যেন সাকিবের বীরত্বের উদাহরণ। অথচ সাকিব একজন মানুষ। তিনি ভুলও করতে পারেন, শুদ্ধও করতে পারেন। যে কোনো যৌক্তিক মানুষের উচিত সাকিবের ভুল-ত্রুটি দুটোই সমান চোখে দেখা। সাকিব যখন পারফরম্যান্স দিয়ে বাংলাদেশকে জেতায়, তখন আমরা আনন্দিত হই। আবার সাকিব যখন লাথি মেরে উইকেট ভেঙে ফেলেন, তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে যায়। যারা সাকিবের কোনো আচরণে ভুল খুঁজে পান না, তাদের অবশ্যই সমস্যা আছে।
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে এলবিডব্লিউর আবেদনে সাড়া না পেয়ে উইকেটে লাথি মারা, খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উইকেট তুলে আছাড় মারা, আবাহনীর কর্মকর্তাদের দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, তেড়ে যাওয়া কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ঘরোয়া লীগে অন্যায় হয়। সাকিব সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু একটা অন্যায় দিয়ে আরেকটা অন্যায়কে জাস্টিফাই করা যায় না। প্রত্যেকটা অন্যায় আলাদা, তার শাস্তিও আলাদা। সাকিবের লাথিকে জাস্টিফাই করা হলে দেশে আইন-কানুন বলে কিছু থাকবে না।
সবাই আইন হাতে তুলে নিয়ে অন্যায়ের প্রতিকার করতে চাইবেন। সাকিব তার অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছেন- তিন ম্যাচ সাসপেন্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। আমার বিবেচনায় গুরু পাপে সাকিবের লঘুদণ্ড হয়েছে। উঠতি কোনো খেলোয়াড় এই অপরাধ করলে আরও বড় শাস্তি হতো। উঠতি ক্রিকেটার সুজন মাহমুদ ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যায়ের প্রতিবাদে ৪ বলে ৯২ রান দিয়েছিলেন, তাসনিম হাসান ৭ বলে ৬৪ রান দিয়েছিলেন। তাদের দুজনকেই ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মানে তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। তাদের ক্লাবকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কই তখন তো বিপ্লবী সাকিব আল হাসান সুজন বা তাসনিমের পাশে দাঁড়াননি।
ঠোঁটকাটা বলে সাকিবের সুনাম বা বদনাম আছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজেদের নানা সুযোগ-সুবিধার জন্য আন্দোলন করেছেন। প্রকাশ্যে আকরাম খানের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কই কোনো দিন তো ঘরোয়া ক্রিকেটের অনিয়ম নিয়ে কিছু বলেননি। আজ যারা বলছেন, আর কোনো উপায় না পেয়ে সাকিব লাথি মেরেছেন। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, সাকিব এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন, বলছেন; কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে আজ মেজাজ হারিয়েছেন। তেমন কোনো উদাহরণ কিন্তু নেই। মেজাজ হারানো, বেয়াদবি, নিয়মের তোয়াক্কা না করা- এসব সাকিবের স্বভাব। একে মহিমান্বিত করার কোনো সুযোগ নেই। সাকিবের আচরণ কখনোই ভালো উদাহরণ হতে পারে না।
তবে এটা ঠিক সাকিবের লাথি একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে। আমাদের আলো ঝলমলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পেছনে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরোয়া ক্রিকেট রয়েছে সেটা আমাদের কারও চোখেই পড়ছে না। তবে একেবারে পড়ছে না তা বলা কঠিন। ঘরোয়া ক্রিকেটের এসব অনিয়ম নিয়ে সাংবাদিকরা বছরের পর বছর লিখেছেন। সুজন আর তাসনিমের কথা তো আগেই বলেছি। খেলোয়াড়দের খেলতে না চাওয়া, পিচের ওপর বসে পরার ঘটনাও সবাই জানেন। এসব একদিন দুদিনের ঘটনা নয়। বছরের পর বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট একটি অশুভ চক্রের হাতে বন্দি।
আবাহনীর বিপক্ষে ৭ ম্যাচে একটাও এলবিডব্লিউ হয়নি, এ অভিযোগ হিমশৈলের চূড়া মাত্র। ঘরোয়া ক্রিকেটে মাঠে যা হয়, তার প্রায় পুরোটাই অভিনয়। কোন ম্যাচে কে হারবে, কে জিতবে, কে কত রান করবে- সবই প্রায় পূর্বনির্ধারিত। মাঠের জয়-পরাজয়ের চেয়ে বড় কথা হলো, সুপার লীগে কোন দল খেলবে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেই ক্লাবের প্রতিনিধিরা বিসিবি নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাই কারা বিসিবিতে ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করবেন, সেটা তো আর মাঠের পারফরম্যান্সের ওপর ছেড়ে দিলে চলে না। সবই টেবিলে বসে ছক কাটা হয়। মাঠে খেলোয়াড়রা শুধু অভিনয় করেন, যা শুনছি, তাতে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট আর রেসলিংয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই দেখতে খেলার মতো, আসলে খেলা নয়।
ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কারণ এই নিয়ন্ত্রণ দিয়ে নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড মানেই সোনার ডিম পারা হাঁস। অঢেল অর্থের ঝনঝনানি। বোর্ডের কেনাকাটা নিয়ে যত কানাঘুষা শুনি, ভবিষ্যতে বিসিবির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনাখুনি হলেও আমি অবাক হবো না। সর্ষের ভেতরের ভূত তাড়াতে হবে আগে।
খালেদ মাহমুদ সুজন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক। মাঠে তার পরিচয় ছিল ফাইটার ক্রিকেটার হিসেবে। বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচের নায়ক ছিলেন সুজন। তিনি এখন ক্রিকেট বোর্ডের প্রভাবশালী পরিচালক। নতুনদের তুলে আনা, তাদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই প্রভাবশালী পরিচালক যখন কোনো ক্লাবের কোচ হিসেবে মাঠে উপস্থিত থাকেন, তখন কোন আম্পায়ারের ঘাড়ে কয়টা মাথা সেই দলের ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে এলবিডব্লিউর আঙুল তোলে? বিসিবি পরিচালকের একটি দলের কোচ হওয়াটা স্পষ্টতই স্বার্থের সংঘাত। সুজনের উচিত অবিলম্বে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করা, নইলে আবাহনীর সাথে সম্পৃক্ততা ছিন্ন করা। দুটি একসাথে চলতে পারে না। বিসিবি, কয়েকটি ক্লাব আর একটি অশুভ চক্র এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটকেই গিলে খেতে বসেছে।
বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, সাকিবের ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে তিনি বেইজ্জতি হয়েছেন। কিন্তু সাকিব তো এই প্রথমবার তাকে বা বাংলাদেশকে বেইজ্জতি করেছেন। পাপনরা কী করেছেন এতদিন? সাকিব দেড় দশক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। এতদিনে বিসিবি সাকিবের মতো একটা পারফরমারকে শৃঙ্খলা, ক্রিকেট সংস্কৃতি, ভদ্রতা, সভ্যতা শেখাতে পারলেন না কেন? অনেক দিন ধরেই সাকিব বোর্ডের কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা মানছেন না। নিজের সাফল্য আর ভক্তদের আবেগকে পুঁজি করে সাকিব একের পর এক নিয়ম ভাঙছেন।
আসলে সাকিব তার মতো চলেন। বোর্ড দ্রুত সাকিবের মতো করে সব অ্যাডজাস্ট করে নেয়। এখন না হয় সাকিব ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়েছেন। কিন্তু শুরুতে বিসিবি তাকে ঠিকমতো পরিচর্যা করেনি কেন? নিয়মিত মনোবিদের কাউন্সেলিংয়ে থাকলে তিনি এতটা বেপরোয়া নাও হতে পারতেন। পাপন বলছেন, সাকিবের আচরণে তিনি বেইজ্জতি হয়েছেন। কিন্তু তিনি যখন বলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটের অনিয়মের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। কেউ তার কাছে কোনো অভিযোগ করেনি- তখন আমরা বেইজ্জতি হয়ে যাই। ঘরোয়া ক্রিকেটের এসব অনিয়ম, বিসিবির বাণিজ্য, সুজনের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কথা দিনের পর দিন লেখা হয়েছে। আমার ধারণা মিরপুরের ইটকাঠও জানে। পাপন সাহেব কান পাতলেই শুনতে পাবেন।
আমি ক্রিকেটের একদম বাইরের মানুষ, মাত্র দুদিনে যা জেনেছি; পাপন বছরের পর বছর ভেতরে থেকে তা জানেন না কেন? ৭ ম্যাচে আবাহনীর কোনো ব্যাটসম্যান এলবিডব্লিউর শিকার হননি, এটা কেন একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। ক্রিকেট মহলে পরিচিত ‘ফা’কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেও পাপন অনেক কিছু জেনে যাবেন। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে তখন অজগর বেরিয়ে আসবে। ঘরোয়া ক্রিকেটের এসব অনিয়মের খবর সত্যি যদি নাজমুল হাসান না জেনে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে পেশাগত ব্যস্ততার কারণে তিনি ক্রিকেটে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না। ক্রিকেটের খবর রাখছেন না। তিনি ক্রিকেট সম্পর্কে ‘ফা’র চেয়েও কম জানেন। এটা সত্যি হলে তার উচিত এখন দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া। যদি জেনেশুনে ব্যবস্থা না নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা আরও বড় অন্যায়। হয় কঠোর হাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করুন, নইলে ছেড়ে দিন। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবে না।
সাকিব কোনো অপকর্ম করলেই তার সমর্থকরা বলেন, যে গাই দুধ দেয়, তার লাথিও ভালো। কিন্তু অন্ধ সমর্থক ভাইয়েরা, সেই লাথি যদি ক্রিকেটকেই মেরে ফেলে তাহলে আর দুধ দিয়ে লাভ কি? সাকিব যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ভালোবাসেন, ঘরোয়া ক্রিকেটকে বাঁচাতে চান সিনিয়রদের নিয়ে বোর্ডের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজনে সংবাদ সম্মেলন করুন। আমরা আপনাদের পাশে আছি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের পাশে আছি। লাথি দিয়ে ভাঙা যায়, গড়া যায় না।
১৩ জুন, ২০২১
এইচআর/জিকেএস