পরকীয়া যেন সংক্রামক ব্যাধি

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ০৯:৩০ এএম, ১৪ জুন ২০২১

স্বামী প্রবাসে। আসবেন এক বছর কিংবা দুই বছর পর। টাকা-পয়সা আসছে বিদেশ থেকে। অর্থসংকট নেই তেমন একটা। সুখেই থাকার কথা দেশে থাকা স্ত্রীর। কিন্তু সুখে আছেন কি এমন সব নারী?

কেউ হয়তো স্বামীকে কাছে পেয়েছেন সপ্তাহ দুই সপ্তাহ, কেউ হয়তো একটু বেশি। এরপর কবে দেখা হবে, অপেক্ষার পালা। কারো দেশে ফেরায় লাগবে দুই বছর কারো তারও বেশি। সুখের সংসার রচনা করা কতটা সম্ভব হয় সেই মেয়েটির জন্য। জীবনটা যদি হয় টাকাতেই পূর্ণ তাহলে হয়তো এটাই সুখের জীবন হতো । কিন্তু -জীবন মানে অনেককিছুর মিশ্রণের ফল। টাকা হয় তো একটা উপকরণ মাত্র। জৈবিক চাহিদা, মানসিক চাহিদা কি শুধু টাকাতেই পূরণ করা সম্ভব?

দেশে থাকা মেয়েটি কিংবা প্রবাসে থাকা ছেলেটি কেউই কিন্তু যন্ত্রণামুক্ত নয়। ছেলেটিকে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয় বাধ্য হয়ে। মেয়েটি প্রয়োজন মেটাতে বাঁকাপথকে বেছে নেয়। অভিভাবক কিংবা সমাজ কেউই ভাবছে না তলে তলে কোন দিকে যাচ্ছে সমাজ। অস্বচ্ছল অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দেশে বিদেশে শ্রম বিক্রি করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পরিণতি সম্পকে শুধু ইতিবাচক দিককেই মূল্যায়ণ করা হচ্ছে। সেই সূত্রে প্রবাসে থাকা ছেলেকে সোনার ডিম পারা রাজহাঁস হিসেবেই দেখা হয়।

অন্যদিকে অভিভাবক আত্মীয়-স্বজন বিদেশে অবস্থানকারী ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তৃপ্তি বোধ করেন। বাবা-মা ভাবেন, যাক তাদের মেয়েটা অন্তত দুধে-ভাতে দিন কাটাতে পারবে। কিন্তু মেয়ের নিজস্ব কিছু চাহিদার কথা তাদের ভাবার অবকাশ নেই। বাবা মায়ের জীবনে হয়তো সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো অর্থনৈতিক। তারা মনে করেছেন মেয়েকে প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারলে মেয়ে স্বাচ্ছন্দে থাকবে। জৈবিক চাহিদার অভাববোধ তাদের অভিজ্ঞতায় না থাকার কারণে তারা বিষয়টিকে উপেক্ষা করেন কিংবা ভাবনার সুযোগও পান না। মেয়ের বাবা যদি প্রবাসী কোনো ছেলে পান, নিজেকে ধন্য মনে করতে থাকেন। মেয়েকে বিয়ে দেন প্রবাসী ছেলের সঙ্গে।

কিন্তু সেই মেয়েটি স্বামীর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে নিজের চাহিদা পূরণে বাঁকা পথ ধরতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়। পরিণতিতে অশান্তি বাড়ে, এমনকি কখনো কখনো মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে যায়। এমন সংবাদ প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। মেয়ের সুখ চিন্তা করে যে বাবা-মা মেয়েকে প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন তখন তাদের ভুল ভাঙ্গে। কিন্তু কিছুই করার থাকে না তখন আর।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরকিয়ার সংখ্যা বেড়েছে অনেক। এই সূত্রে সামাজিক অশান্তি এবং মৃত্যুর ঘটনাও। মাস ছয় আগে একটি প্রতিবেদনের কথা মনে আসছে এই মুহূর্তে। একবারে সিনেমার মতো ঘটনা। কিশোরগঞ্জের এক যুবক সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী বাড়ি রেখে যান মধ্যপ্রাচ্যে। স্ত্রীকে তার সন্দেহ হয়। তিনি কৌশলের আশ্রয় নেন স্ত্রীকে পরীক্ষার জন্য। ভুয়া আইডি ব্যবহার করে নিজ স্ত্রীর সঙ্গে যুক্ত হন ফেসবুকে। চুকিয়ে প্রেম করেন বছরকাল। বুঝতে পারে না স্ত্রী। একসময় যুবকটি দেশে ফেরেন। প্রেমিক সেজে স্ত্রীকে বলেন এমুক জায়গায় দেখা করতে। ধরা খেয়ে যায় স্ত্রী।

সামাজিকভাবে সব দোষ পড়ে মেয়েটির ওপর। সবাই দুরছাই করে মেয়েটিকে। কিন্তু পেছনের বিষয়গুলো কেউ খুঁজে দেখার চিন্তা করেনি একবারও। সংসার এবং ওই সমাজে তোলপাড় তৈরি হয় নষ্টা মেয়ের কাণ্ড হিসেবে।

দোষারোপ করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবাহারকে। প্রযুক্তিনির্ভর পরিবর্তিত যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আর অবলা নারী হিসেবে কাউকে গৃহবন্দি করে রাখাও সম্ভব নয়। অবাদ যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হওয়ায় নারী-পুরুষ উভয়ই আগের চেয়ে ঢের বেশি কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পায়। এই সুযোগটি কখনো ইতিবাচক কখনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নেতিবাচক ফলের কথা জানার পরও এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পরিহার করা আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এই পরিস্থিতি থেকে কি কোনোভাবেই পরিত্রাণের উপায় নেই। এমন ধাঁচের পরকীয়া তো বেড়েই চলেছে। পরিত্রাণ কিংবা প্রতিরোধ বিষয়ে কেউ ভাবছে কি ? সামাজিক অশান্তি দাম্পত্য অশান্তি নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের সময় যায়। বিষয়টিকে আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবার কারণ নেই। এর জন্য সরকারকেও ভাবতে হবে। কারণ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মের পেছনে যেসব কারণ কাজ করছে তা দূর করতে না পারলে বৈদেশিক আয়ে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে যে শ্রমিকরা বিদেশে চাকরি করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে অবদান রাখছে তাদের কল্যাণের বিষয় আমাদের সরকারেরও চিন্তা করা প্রয়োজন আছে।

কী করণীয় আছে এক্ষেত্রে? সমাজবিজ্ঞানীরা ভাবতে পারেন এই বিষয়ে। সোজা কথায় সামান্য বুদ্ধিবিবেচনায় বলতে হয়, বিবাহিত ছেলে মেয়েকে দূরে থাকার এই পরিস্থিতি যতটা সম্ভব দূর করার চেষ্টা করতে হবে। এটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। প্রবাসে অবস্থানকারী তরুণটির ক্ষমতার বিষয় জড়িত। চাকরিদাতার শর্তের বিষয়টিও থেকে যায়। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। যেসব কর্মী এক বছরের বেশি সময় বিদেশে অবস্থান করেন, তাদের স্ত্রীকে বিদেশ সফরে সরকারি সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা অন্তত বছরে একবার স্ত্রীদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য বিমানের টিকেট দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে।

অন্যদিকে চাকরিদাতার শর্ত নিয়ে দর কষাকষির দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকে। চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান বছরে অন্তত ৩০দিন ছুটি বরাদ্দ করবে আসা-যাওয়ার খরচসহ। সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে অনেকটা লাঘব হবে এই সমস্যার। এর সঙ্গে দেশে সরকারি সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে স্বামী স্ত্রী বছরে অন্তত দুইবার মিলিত হতে পারবেন।

সরকার অতিসম্প্রতি গ্রাম শহর নির্বিশেষে ইন্টারনেট ব্যবহারে ব্যয়হারে সাম্যতা এনেছে। ৫০০টাকা ব্যয় করলেই এক মাস এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে যে কেউ। প্রবাসে অবস্থানকারী শ্রমিকদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারে ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রবাসী শ্রমিকের স্ত্রীর জন্য যদি ৫০% রেয়াত দেওয়া হয় তাতে রাজস্ব খাতে টান পড়বে না। কিন্তু এটি বড় রকমের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে।

মনে হতে পারে প্রবাসী শ্রমিক পরিবারেই পরকীয়া চলে। এমনটা ভাবার কারণ নেই। তবে সমকালীন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে প্রবাসী শ্রমিক পরিবারেই এর মাত্রা বেশি এটাও স্বীকার করতে হবে। স্বামীর উপস্থিতিতেও পরকীয়া হয়, তার কারণও খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ই সর্বাধিক দায়ি বলে মনে করি। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টিও ভাবতে হবে। আমার জানামতে বিষয়টিকে এখনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই সবাই মনে করছেন। এবং এর প্রতিকার বিষয়েও আন্তরিকভাবে কেউ ভাবছে না। অথচ এটি ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত নিয়ে বিকল্প কোনো উত্তম উপায়ও বের করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অনালোচিত রাখার সুযোগ নেই।

লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/জেআইএম

অবাদ যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হওয়ায় নারী-পুরুষ উভয়ই আগের চেয়ে ঢের বেশি কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পায়। এই সুযোগটি কখনো ইতিবাচক কখনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নেতিবাচক ফলের কথা জানার পরও এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পরিহার করা আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।