বেড়িবাঁধ : উপকূলের দুঃখ!
সজীব ওয়াফি
“জলে ভাসা পদ্ম আমি/ শুধুই পেলাম ছলনা” উপকূলের মানুষ ঠিক তেমনটাই প্রতি বছর বেড়িবাঁধ ভেঙে বানের জলে ভেসেছে, চোখের জলে ভেসেছে; আর শিকার হয়েছে ছলনার। দুর্যোগ পরবর্তী সাময়িক ত্রাণসামগ্রী পেলেও হয়নি স্থায়ী কোন সমাধান।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সিডর, আইলা, ফনী, আম্ফান ও ইয়াসের মত ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত উপকূলবাসী। আগের বছর গুলোর তুলনায় বেড়েছে সমুদ্রের উচ্চতা। মৌসুমি বর্ষায়, এমনকি জোয়ার ভাটায়ও নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে। দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে বেড়িবাঁধই উপকূলের একমাত্র রক্ষাকবচ। অথচ ষাটের দশকে নির্মিত বেড়িবাঁধ জোড়াতালি দিয়ে এতদিন চলে আসলেও বর্তমান পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। শক্তিশালী বেড়িবাঁধের অভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকে সব মৌসুমেই, বর্ষায় পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে উপকূলের সুরক্ষা বাঁধগুলো। সময়ের পরিক্রমায় যা দুর্বল এবং নিচু হয়ে গেছে। ইঁদুরের গর্তেও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেরামত সংস্কারে গত ৯ বছরে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কোন কাজে আসেনি। বরং প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের ঘটনা ঘটেছে, হয়েছে অর্থের অপচয়। নতুন বাঁধ নির্মাণেও অর্থ লুটপাট হয় দুর্নীতির মাধ্যমে, তারপর কোনক্রমে তৈরি করে দুর্বল বাঁধ। ফলে জলোচ্ছ্বাসের সময় পানির চাপে বাঁধ ভেঙে যায়।
দুর্যোগকালীন সময়ে কোন এক জায়গায় ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়ারও সুযোগ থাকে না। তলিয়ে যায় বাস্তুভিটা, ফসলি জমি, শাক সবজির ক্ষেত। বানের পানিতে ভেসে যায় মাছের ঘের। মানুষের পাশাপাশি সীমাহীন দুর্ভোগ নেমে আসে গবাদিপশুর। ভাঙনের কবলে চোখের সামনে বিলীন হয় শেষ সম্বলটুকু। হাহাকার ছড়িয়ে পরে দিশেহারা অবহেলিত পানিবন্দি লোকালয়ে। ভেঙ্গে পরে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রিজ, কালভার্ট, বৈদ্যুতিক লাইনসহ নানান ধরনের সরকারি বেসরকারি অবকাঠামোর।
শেষ মুহূর্তে জিও ব্যাগ, সিনথেটিক ব্যাগ, বাঁশ, দড়ির মত সরঞ্জামাদি দিয়ে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও দুঃখ লাঘব অসম্ভব। বাঁধ ভেঙ্গে লবণাক্ত পানি প্রবেশে তৈরি হয় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। অভাব দেখা দেয় সুপেয় পানির। উপকূলীয় শিক্ষার্থীদের পড়াশুনোয় ব্যাঘাত ঘটে। মাটি হারায় তার উর্বরতা শক্তি। লবণাক্ত জমিতে ফসল ফলানোর পরিস্থিতিও থাকে না। দোকানপাট, খেয়াঘাট বিধ্বস্ত হয়। ছোটখাটো গাছ মারা পরে অতিরিক্ত লবণাক্ততায়। খানাখন্দে ভরে উঠে পুরো জনপদ। যাদের মোটামুটি অর্থ বিত্ত হয় তারা হয়তো অন্য এলাকায় সরে পরে। বাধ্য হয়ে নিজ ভিটায় পানিবন্দি ভোগান্তিকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয় গরিব অসহায় লোকজন।
শুষ্ক মৌসুমে বাজেট পাস না হওয়া বেড়িবাঁধ মেরামতে সবচেয়ে বড় বাঁধা। পাস হলেও টেন্ডারবাজির কারণে অনেক সময় বিলম্বিত হয়। ঠিকাদারেরা কাজ না করে দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন এরকম অভিযোগও আছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। অভিযোগ আছে নিজেদের জীবন জীবিকা রক্ষায় জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে কিন্তু বিল তুলে নেয় সরকারি কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিরা।
আশ্বাস - আস্থা হারিয়ে উপকূলবাসীরা চেষ্টা করেছে তাদের সাধ্য সীমা পর্যন্ত। গতবছর স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করতে এসে খুলনার কয়রায় পানির ভিতরে পড়তে হয়েছে ঈদের নামাজ। ইয়াসের প্রভাবে বাঁধের নাজুক অংশ ভেঙে না যেতে বুক দিয়ে ঠেকিয়ে রাখার দৃশ্যের হয়েছে আলোচনা সমালোচনা। কিন্তু কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আসেনি। ফলে খুলনার কয়রায় সাংসদকে পড়তে হয়েছে জনতার রোষানলে। বরিশাল-নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষকে থাকতে হচ্ছে ভাঙনের শঙ্কায়। তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট কোথায় গেল! সরকারকে বিব্রতকর এই পরিস্থিতিতে ফেলতে দায়ী কে?
উপকূলবাসীর দুর্দশা ঠেকাতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ সময়ের দাবি। টেকসই করতে বাঁধের মাঝে নির্মাণ প্রয়োজন শক্তিশালী কংক্রিটের দেয়াল। বাঁধের ওপরে দুইপাশে বনায়ন বাঁধকে আরো মজবুত করে তুলবে। বাঁধ থেকে ১০০ মিটারে মধ্যে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষে। নদীর গতি প্রবাহ ঠিক রাখতে চালু রাখতে হবে ড্রেজিং। নিয়মিত মেরামত সংস্কারে তহবিল গঠনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত এবং মনিটরিং অবহেলিত মানুষের থেকে দায়মুক্তির একমাত্র পথ।
দুর্নীতির পাগলা ঘোড়া লাগামহীন ছুটেছে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উপকূল। ভোগান্তিতে পরেছে কয়েক লক্ষ মানুষ। ভাঙনে ছেড়ে দিতে হচ্ছে পুর্বপুরুষের কবরের জায়গাটুকুও। এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানবে কে? লাগাম যদি টানা না যায় বানভাসিরা ট্যাক্স কেন দিবে! তাদের ট্যাক্সের পয়সার অপব্যবহার হচ্ছে না তো? নিরুপায় মানুষগুলো কোথায় যাবে?
বেড়িবাঁধ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষার দাবি, ন্যূনতম বেঁচে থাকার দাবি। অন্যকোন উন্নয়ন নয়, কেবলই প্লাবণ এবং ভাঙ্গন প্রতিরোধে তীর রক্ষা বেড়িবাঁধের জরুরি প্রয়োজন উপকূলের জনপদে। দুঃখের নিস্তার দেওয়া কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নয়তো বুমেরাং হয়ে যাবে দক্ষিণের সমস্ত উন্নয়ন।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম