ক্লিনিক ব্যবসার চাইতে আদম ব্যবসা ভালো
মন ভালো করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে এবাদুল। কোনো লাভ হচ্ছে না; বরং খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। টেলিভিশনের সুইচ-অন করল সে। রিমোট টিপতে টিপতে উড়াধুরা টাইপের নাচ-গান হয়, এমন একটা হিন্দি চ্যানেলে এসে থামল। দেখা যাক, উড়াধুরায় মন ভালো হয় কিনা। উহুঁ! কাজ হচ্ছে না। নাচ-গান ছাপিয়ে চোখের সামনে শরীফার মুখ ভেসে উঠছে।
এখন মনে হচ্ছে, শরীফার গালে জোরে একটা থাপ্পড় দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে সাপের বিষ ঢালার মতো রাগটা সেখানেই পড়ে যেত। মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখে বাসা থেকে বের হয়ে আসা ঠিক হয়নি। ভুল হয়েছে। মারাত্মক ভুল। ভুল সংশোধনের জন্য এখন বাসায় গেলে কেমন হয়? বাসায় গিয়ে কোনো সংলাপ বিনিময় না করে রোবোটিক স্টাইলে শরীফার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে চলে আসা যায়। ভাবনাটা এবাদুলের মনের মধ্যে বিড়াল-ইঁদুর খেলা খেলল কিছুক্ষণ। পরে এটাকে বাতিল করে দিল সে। লাভ নেই। মারপিট করে কারও বেসিক পয়েন্টের উন্নয়ন ঘটানো যায় না। নারীজাতির মূল সমস্যা হচ্ছে বেসিক পয়েন্টে গলদ। বেসিক পয়েন্টে গলদ না থাকলে শরীফা তাকে এ ধরনের কথা বলতে পারত?
কয়েকদিন ধরেই টাকার জন্য ঘ্যান-ঘ্যান করছিল শরীফা। আজ সকালেও একই সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল সে। দশ-বিশ টাকা না। অনেক টাকা। পকেট কামানের নলের মতো ফাঁকা না থাকলে প্রথমদিন চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দিত এবাদুল। ঘ্যানর-ঘ্যান সুরে বেহালা বাজানোর প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু না থাকলে দেবে কোত্থকে? টাকা-পয়সা গাছের পাতা নয়; গাছে উঠলাম, খানিকক্ষণ বাদে ভরা বস্তা নিয়ে গাছ থেকে নেমে এলাম। অনেকক্ষণ ধরে এ জিনিসটাই শরীফাকে বোঝানোর চেষ্টা করল এবাদুল। শরীফা বোঝাবুঝির ধারে-কাছেও গেল না। ঘাড় বাঁকিয়ে ফোঁস-ফোঁস করতে করতে স্বামীর উদ্দেশে বলল-
: টাকা থাকবে না কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর একেক শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্ষেত্রে একেকরকম হবে। এবাদুলের ক্ষেত্রে এর উত্তর হচ্ছে কিছুদিন হলো তার ব্যবসা বসে পড়েছে। বসে পড়েছে না বলে বলা উচিত শুয়ে পড়েছে। ‘অবৈধ ক্লিনিক ব্যবসার রমরমা অবস্থা’ শিরোনামে পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান শুরু করেছে। এবাদুলের ক্লিনিকে যে ক’জন রোগী ছিল- সবাইকে ‘স্ট্যান্ডরিলিজ’ দিয়ে সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হয়েছে। পরিস্থিতি পূর্বের অবস্থায় ফিরে না আসা পর্যন্ত ক্লিনিকে কোনো রোগী পাওয়া যাবে না। রোগীর আমদানি না থাকলে এমনি-এমনি এবাদুলকে কেউ টাকা দেবে? অত্যন্ত সহজ ভাষায় পুরো বিষয়টা বউয়ের কাছে উপস্থাপন করল এবাদুল। শরীফার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ভুল। কিসের মধ্যে কী- পান্তাভাতে ঘি! শরীফা বেমক্কা বলে বসল-
: মাছের ব্যবসা ছাইড়া এইসব আত্তাবাত্তার মধ্যে তোমারে যাইতে বলছে কে! কীজন্য গেছ?
একেই বলে সাতখণ্ড রামায়ণ পড়ে ‘সীতা কার আব্বা।’ আরে! মাছের ব্যবসা আর ক্লিনিকের ব্যবসা কি এক হলো? এ কথা সত্য, মাছের ব্যবসায়ে কোনো ঝুঁকি ছিল না। ৩০ টাকার মাছ ৯০ টাকায় বেচাবিক্রি করায় নগদ টাকা-পয়সার আমদানিও ছিল প্রচুর। ক্লিনিকের ব্যবসায়েও এরকম ছক্কা মারার সুযোগ আছে। এজন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। উতলা হলে চলবে না। ব্যবসাটা একবার জমে উঠুক, তারপর দেখ কোনটা ভালো- মাছের ব্যবসা, না ক্লিনিকের ব্যবসা! সবচেয়ে বড় কথা- মান-মর্যাদার বিষয়টা বিবেচনায় নিতে হবে। মাছের বাজারে সারাদিন পিঁড়ি বিছিয়ে কারবার করা আর ক্লিনিকের এসি রুমে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চেয়ারে বসে ঠ্যাং নাচানো কি এক জিনিস হলো? আরে বেক্কল মেয়েলোক! আগে লোকজন তোমারে বলত মাছওয়ালার বউ। আর এখন বলে এমডি স্যারের মিসেস। এ সম্মান লাখ টাকা দিয়ে কিনতে পারবা তুমি?
আশ্চর্য! এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে শরীফা এবাদুলকে তার আগের জীবনে ফিরে যেতে বলছে! এর অর্থ একটাই- শরীফার বেসিক পয়েন্টে গলদ আছে। গলদ না থাকলে এমন চিন্তা কেউ করতে পারে? ভাবনার এ পর্যায়ে বোমা ফাটাল শরীফা। এবাদুলের উদ্দেশে সে বলল-
: এখনও সময় আছে; ভুং-ভাং ছাইড়া আগের ব্যবসা ধরো। তা না হইলে...
এরপর শরীফা এবাদুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাপজোঁক শুরু করে দিল। শরীফার কথাবার্তা শুনে এবাদুলের মেজাজ এতটাই খারাপ হলো- জিহ্বা কামড়াতে কামড়াতে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে সে। এখানেই বোকামি হয়েছে। ‘ধর মুরগি-কর জবাই’য়ের মতো রাগটাকে ওখানেই ঝেড়ে ফেলা উচিত ছিল। তাহলে এখন যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না। নাস্তা করা দরকার। নাস্তা করার উদ্দেশ্যে এবাদুল পাশের হোটেলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই বুয়া এসে সামনে দাঁড়াল। বলল-
: পয়সাকড়ি দিয়া আমারে রিলিজ কইরা দেন।
আরে! সবাই কি উন্মাদ হয়ে গেল? শুধু টাকা-টাকা করছে! অভিযান শুরুর পর ম্যানেজ করতে লোকাল থানায় গিয়েছিল এবাদুল। সেখানে যে পরিমাণ টাকা দাবি করা হলোÑ তা শুনে এবাদুলের রক্ত পাতলা হওয়ার জোগাড়। এত টাকা-পয়সা তার কাছে নেই। থাকলে ডাক্তার-নার্স না পুষে হুন্ডি ব্যবসা করত সে। কপাল কুঁচকে বুয়ার কাছে এবাদুল জানতে চাইল-
: কী হইছে! হঠাৎ রিলিজ হইতে চাও কেন?
: আতংক লইয়া কাজ-কাম করতে ভালো লাগে না।
: আতংক পাইলা কই? সাইনবোর্ড নামাইয়া ফেলার পর এইটা তো এখন আর অবৈধ কোনো ক্লিনিক না, বাসা হইয়া গেছে।
: বাসা হোক আর বাড়ি হোক, আমারে বিদায় কইরা দেন। আমি এইখানে চাকরি করমু না।
: কই চাকরি করবা?
: বিদেশে।
: বিদেশে? বিদেশে যাইয়া তুমি কী চাকরি করবা?
: যে চাকরিই করি। আপনের কোনো সমস্যা?
: না, আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু বিদেশ যাইতে তো অনেক টাকা লাগে। অত টাকা তুমি পাবা কই?
: টাকা কই পামু- এইটা আপনে জাইনা কী করবেন? প্রয়োজন হইলে কিডনি বিক্রি করমু।
: কিডনি বিক্রি কইরা হইলেও বিদেশে যাবা?
: হ। দুই-চাইর টাকা দামের চাকরি অনেক করছি। আর করবার চাই না।
বুয়ার সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে হোটেলে ঢুকল এবাদুল। নাস্তা করার সময় বুয়ার কথাগুলো নিয়ে নড়াচড়া করতে গিয়ে মনের মধ্যে নতুন এক আইডিয়ার উদয় হলো। ক্লিনিকে রমজান নামে এক লোক রোগী ধরার দালাল হিসাবে কাজ করত। রমজানকে ফোন করে এবাদুল বলল-
: রমজান, একটা কাজ কইরা দিতে পারবা?
: কী কাজ, বস?
: নতুন একটা সাইনবোর্ড বানাইতে হবে।
: কিসের সাইনবোর্ড?
: আদম ব্যবসার।
: আদম ব্যবসা শুরু করবেন?
: হ। চিন্তা কইরা দেখলাম- ক্লিনিক ব্যবসার চাইতে আদম ব্যবসা ভালো। থানা-পুলিশ, গালকাটা- হাতকাটা, ল্যাংড়া বড়ভাইদের লইয়া কোনো টেনশন নাই। শুধু লোকজনরে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখাও আর ভাঁজকরা নোট পকেটে ঢুকাও। দুই নম্বরি কারবার যখন করবই, তখন অধিক ভালোটার লেংগুর ধরাই উচিত।
নায়-নাস্তা শেষ করে ফিরে আসার পর এবাদুল দেখল, বুয়া ফোনে কথা বলছে। কথা শেষ শেষ হওয়ার পর সে বুয়ার কাছে জানতে চাইল সে-
: এতক্ষণ ধইরা কার সঙ্গে কথা বলতেছিলা?
: এক আদম বেপারির লগে।
: কী বলল সে?
: এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা-পয়সা জোগাড় করতে বলছে।
: ওই ব্যাটার সঙ্গে যোগাযোগ ক্যান্সেল করো।
: কীজন্য!
ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ণ হাসির জন্ম দিয়ে এবাদুল বলল-
: বিদেশ যাওয়ার জন্য উল্টাপাল্টা জায়গায় ছোটাছুটি করার প্রয়োজন নাই। আইজ থেইকা আমি আদম বেপারি। তুমি হইলা আমার প্রথম কাস্টমার...
এইচআর/জিকেএস