আজিমদ্দিন খায় শোল মাছ আমি খাই পুঁটি...
আজিমদ্দিন খায় শোল মাছ আর আমি খাই পুঁটি মাছ। হু ইজ আজিমদ্দিন? মহামহিম আজিমদ্দিন হচ্ছে একটা সরকারি অফিসের ৩য় শ্রেণির একজন কর্মচারি। আজিমদ্দিনের বয়স আমার চেয়ে কম। উঁচা-লম্বায়ও আমার চেয়ে খাটো। আজিমদ্দিন ইন্টারমিডিয়েট পাস আর আমি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে মাস্টার্স অব সোসিওলজি।
আজিমদ্দিনের কোনো ঠেকা নেই আমাকে মনে রাখার; বরং আমিই তাকে সময়ে-অসময়ে স্মরণ করি। শুধু স্মরণ করা নয়, আগের জামানায় জমিদারদের নায়েব-গোমস্তাদের সঙ্গে মানুষ যেরকম আদব-লেহাজ নিয়ে কথা বলত, আমিও সেইরকমভাবে তার সঙ্গে বাক্য বিনিময় করি। প্রজারা কাচারিতে গিয়ে সেলামি না দিয়ে নায়েব-গোমস্তাদের সঙ্গে কথা বলত না। এটাকে বেয়াদবি মনে করা হতো। আমিও সেলামি ছাড়া আজিমদ্দিনকে মুখ দেখাই না। মনে আছে, প্রথমবার সেলামি দিয়েছিলাম পাঁচশ টাকা। সেই টাকা হাতে নিয়ে আজিমদ্দিন বলেছিল, আপনে তো বাংলাদেশ ব্যাংকরে অপমান করলেন। আজিমদ্দিনের কথা বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইলাম। সে টাকাটা পকেটে রাখতে রাখতে বলেছিল
: বাংলাদেশ ব্যাংক এক হাজার টাকার নোট বাজারে ছাড়ছে, জানেন?
: জানি।
: জানার পরও এই ধরনের একটা ভুল করলেন!
: এইটা দিয়া পরিচয় হইলাম। এরপর ইনশাল্লাহ...
আজিমদ্দিন আমার ফাইলটার দিলো জাহাজ। এরপর থেকে কিছুদিন বাদে বাদে আমি আজিমদ্দিনের কাছে যাই। আজিমদ্দিন আমাকে জাহাজের গল্প শুনায়Ñ গল্পÑ১: ভিনদেশের বন্দর থেকে জাহাজ আমাদের বন্দর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। গল্পÑ২: চমৎকার আবহাওয়া; জাহাজ পূর্ণগতিতে বন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গল্পÑ৩: জাহাজ বর্হিনোঙ্গরে অবস্থান করছে। গল্পÑ৪: ...
অবাক হয়ে বললামÑ
: আজিমদ্দিন ভাই, ডট মারলেন ক্যান?
: ডট তো আমি মারি নই; এইটা উপরওয়ালার কাম।
: বিষয় কী?
: জাহাজ জট। বন্দরে জাহাজ যেগুলা আছে, এইগুলার মালই খালাস করা যাইতেছে না। নতুন জাহাজ ঢুকব ক্যামনে।
: এখন উপায়?
: এই বন্দরের যে অবস্থা দেখতেছি, এইখানে ঝিম মাইরা পইড়া থাকার কুনু মানে হয় না।
: কী করবেন?
: জাহাজের মুখ ঘুরাইয়া দুই নম্বর জেটির দিকে অগ্রসর হইতে বলি।
: তাড়াতাড়ি বলেন।
: আপনের কিন্তু ডেমারেজ খাওন লাগব।
: কী জন্য!
: আরে মরজ্বালা! আপনে আমদানিকারক না? এইটা তো জাহাজ কোম্পানির কুনু গিলটি না। তাড়াতাড়ি মাল ডেলিভিারি লওয়ার জন্য আমরা নিজেরাই এই সিস্টেমে যাইতেছি। এরজন্য আলাদা খরচ আছে না?
খরচের টাকা দিলাম। আজিমদ্দিন বলল বসেন; চা খান। চা খাচ্ছিÑ এমন সময় দেখলাম, এক লোক এসে আজিমদ্দিনকে সালাম দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আজিমদ্দিন তার চেয়ারে কিছুক্ষণ দোল খায়। পত্রিকার পাতা ওল্টায়। এরপর একটা খিলিপান মুখে ঢুকিয়ে দুই দাঁতের চিপায় চুনসহ পানের বোঁটা রেখে সে জানতে চাইলÑ
: কী খবর তর?
: ভালা শইল মাছ আনছিলাম স্যার।
: লারে লারে, লা... রে, রে রে...
: লইয়া আসি, দেখেন।
: আপা তাপা, তা...পা, পা পা...
: আনমু!
: ঝামেলায় ফেললি। গতকাইল বইদ্যা জোর কইরা মাছ গছাইয়া দিয়া গেছে। বাসার ফ্রিজ, ডিপ ফ্রিজÑ দুইটাই ভরা।
মাছওয়ালা দাঁত বের করে বললÑ
: আপনের কাছে মাছ আইন্যা সেই মাছ ফেরত নেওনের তো অভ্যাস নাই স্যার!
: তা তো বুঝলাম রে পাগলা। কিন্তু রাখনের তো জায়গা নাই। হুম হো...। হুম হো...। হু...ম। আইচ্ছা, লইয়া আয় দেখি...
মাছওয়ালা মাছ এনে কোনোটার মাথা, কোনোটার পেট চেপে ধরে আজিমদ্দিনকে দেখায়। আজিমদ্দিন পান চিবায়; বিশেষ কায়দায় জিহ্বার আগায় চুন লাগায় আর মাছ দেখে। দেখতে দেখতে বললÑ
: মাছের সাইজ তো মাশাল্লাহ ভালোই। আমার পছন্দ হইছে। ওয়েট কর, ছোটভাইরে ফোন কইরা দেখিÑ কী কন্ডিশন।
: হ্যালো, ফজি...
: ভাইজান আসসালামু আলাইকুম।
: ভালো কয়টা শইল মাছ পাইছিলাম; কিন্তু আমার ফ্রিজ তো বোঝাই। তর কী অবস্থা?
: আমারও তো একই অবস্থা। তোমার না আরেকটা ফ্রিজ নেওয়ার কথা ছিল?
: কথা তো ছিলই; কিন্তু নতুন একটা প্লট বুকিং দিলাম...
: মাছগুলান জেতা না?
: হ জিয়ল মাছ। শইল মাছ মরা হইলে কি আমি কিনি!
: জিয়ল মাছ ফ্রিজে রাখার দরকার কী? ড্রামে পানি ভইরা জিয়াইয়া রাখো।
: বাসায় তো খালি ড্রাম নাই।
: আমি ব্যবস্থা করতেছি।
মাছগুলোর একটা গতি হওয়ায় আজিমদ্দিন উৎফুল্ল হলো। কিছুক্ষণ আগে আমার দেওয়া নোটগুলো পকেট থেকে বের করে মাছওয়ালার পাওনা মেটাল সে। আজিমদ্দিনের কাছে জানতে চাইলামÑ
: আপনের ছোটভাইও কি চাকরি করে?
: হুঁ। সেও আমারই মতন এই প্রজাতন্ত্রের একজন সেবক।
বাসায় ফেরার পথে বাজারে ঢুকলাম। দেখি, সস্তায় পুঁটি মাছ বিক্রি হচ্ছে। টিপে-টুপে দেখলাম, শরীর এখনও মোটামুটি শক্ত আছে। কিনে ফেললাম দুই ভাগা। বাজারের ব্যাগ হাতে নিতে নিতে বউ জানতে চাইলÑ
: মাছ আনছো?
: আনছি।
: কী মাছ?
: পুঁটি মাছ।
: পুঁটি মাছ!
: হ পুঁটি মাছ। আজিমদ্দিন খায় শোল মাছ; আর আমি খাই পুঁটি মাছ।
: মানে কী?
: মানে হলো, আজিমদ্দিন হচ্ছে এই প্রজাতন্ত্রের সেবক আর আমি হলাম লেদক। লেদক বুঝ তো? যে খালি লেদায়...
এইচআর/জেআইএম