নারীবান্ধব বাজেট চাই

লীনা পারভীন
লীনা পারভীন লীনা পারভীন , কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৩৫ এএম, ০৩ জুন ২০২১

অনেকেই হয়তো ভাবছি বাজেটের সাথে জেন্ডার বা লিঙ্গের কী সম্পর্ক। বাজেটতো হচ্ছে সহজ কথায় বললে রাষ্ট্রের আয় ব্যয়ের হিসাব। আমাদের মত দেশে নারীবান্ধব বাজেট কথাটি এখনও তেমন প্রচলিত বা পরিচিত নয়। অথচ আধুনিক বাজেটিং পদ্ধতিতে জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেট বলে একটা টার্ম আছে। জাতীয় বাজেটে অর্থের বন্টন, কর আরোপ বা রাজস্ব নীতি দেশের সকল জনগণকেই প্রভাবিত করে। তাই বাজেটে সমাজের সকল অংশের কথাই মাথায় রাখতে হয়। আধুনিক বিশ্বে “জেন্ডার রেসপন্সিভ” বাজেট বলে একটা টার্ম প্রচলিত আছে। জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেটিং হচ্ছে একটি টুল বা এমন একটি পদ্ধতি যেখানে জেন্ডার পার্স্পেক্টিভকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কেন বাজেটকে জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে?
সমাজে এখনও নারীরা অবহেলিত এবং তাদের ক্ষমতায়নের কথাটি কেতাবি হিসাবেই পরিগণিত হয়ে আসছে। তাই মুখে আমরা যতই নারীর উন্নয়ন বা নারীর ক্ষমতায়নের কথাটি বলিনা কেন, এটিকে যদি জাতীয় পরিকল্পনায় আনা না যায় তাহলে এটি কেবল কথার কথাই থাকবে। পরিকল্পনায় আনাই কেবল কাজ নয়। এর সাথে সামঞ্জ্যস্য রেখে ব্যয়ের উৎসটিও বলে দিতে হবে। আর এই ব্যয়ের উৎস কোথায় থাকবে যদি তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না থাকে?

মূলত জেন্ডার রেসপন্সিভে বাজেটের উদ্দেশ্য হচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক সমতা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনাকে শক্তিশালী করা যেখানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, অর্থের যোগান ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজগুলো জাতীয় পরিকল্পনা ও বাজেটিং প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে। আমরা সবাই জানি বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে বদ্ধ পরিকর এবং উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের যাত্রায় নারীর টেকসই উন্নয়ন একটি বড় ইস্যু। সে লক্ষ্যে নারী উন্নয়ন নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রশাসনিক পদে নারীর পদায়ন করা হচ্ছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে প্রচুর নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে এখন। কিন্তু এসব উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই কাজ করছে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে। তাদের জন্য নেই কোন জাতীয় পরিকল্পনা বা নীতিমালা। আর্থিক সংকটে আছে অনেক উদ্যোক্তা। যার কারণে উদ্যোক্তা তৈরির মত এমন একটি সম্ভাবনাময় খাত উঠতে চেয়েও পারছে না। ঝাঁকে ঝাঁকে নারীরা এগিয়ে এসেও পিছিয়ে যাচ্ছে।

সমাজের অর্ধেক অংশ নারী। এই অংশের উন্নয়নকে অস্বীকার করে জাতীয় উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। করোনাকালীন সময়ে নারী নির্যাতন বেড়েছে উল্লেখজনক হারে। বাল্য বিবাহ বেড়েছে ভীতিকর আকারে। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় কমতে শুরু করেছে নারী শিক্ষার হার। করোনা একদিন চলে যাবে বা নিয়ন্ত্রণে আসবে তখন কেমন করে এই ক্ষতিকে পোষানো যাবে এর জন্যও পরিকল্পনা নিতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া নিশ্চিত করতে হবে নারীর জন্যও। জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট সমাজে বিরাজমান নারী পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য কমাতে নিশ্চিত ভূমিকা রাখে। সমাজে নারীরা এখনও অনেক দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। সম্পদের সমান অধিকার থেকে শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতির অনেক জায়গাতেই নারীদের পূর্ণ ও যৌক্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি। এখানে নারী বলতে আমি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির নারীর উন্নয়নকেও বুঝিয়েছি কারণ তারাও আমাদের এই জাতীয় পরিকল্পনার অংশ।

নারী-পুরুষের সমতা অর্জনকে বেগবান করতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। অগ্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী শিক্ষার মান উন্নয়ন, সৃজনশীল কর্মমুখী শিক্ষা এবং গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণে নারীর জন্য অর্থ বরাদ্ধ প্রয়োজন। তৃণমূলে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নেয়া হয়েছে অনেক রাজনৈতিক কর্মসূচি কিন্তু সেগুলো কতটা আলঙ্কারিক আর কতটা বাস্তবসম্মতভাবে নেয়া হয়েছে সেটিও মনিটরিং প্রয়োজন কারণ কেবল পদায়নেই সমাধান আসেনা বরং নারী কমিশনার বা জনপ্রতিনিধিদের আর্থিক ক্ষমতায়নকে স্বীকৃতি দিতে হবে বাজেটে। খাতওয়ারি বরাদ্ধ রাখতে হবে তাদের জন্য। উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনগ্রসর জনগোষ্ঠিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

নারী ও কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত চরমভাবে। মনোযোগী হতে হবে সেদিকেও। বিশেষ করে করোনাকালে এর অবনতি এখন দৃশ্যমান। নানারকম হতাশা এসে ভর করছে সবাইকে তাই এখন মনোযোগী হতে হবে শারীরিক/মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কিত যথাযথ কাউন্সেলিং বিষয়ে, বিদ্যালয়গুলোতে হেলথ কর্মসূচি সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বিশেষত ছাত্রীদের জন্য সৃজনশীল শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। স্যানেটারি ন্যাপকিন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মজুত প্রতিটি বিদ্যালয়েই রাখা প্রয়োজন। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে দক্ষ, যোগ্য, বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী এবং সৃজনশীল নারী ও পুরুষ শিক্ষক নিয়োগের চিন্তা করা প্রয়োজন, কেননা আমাদের শিক্ষা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন।

এমন অনেক অনেক আলোচনাই করা যায় কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারকদের আগে স্বীকার করতে হবে যে আমাদের জাতীয় বাজেট জেন্ডার সংবেদনশীল হচ্ছে না। লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় জাতীয় বাজেট ও পরিকল্পনায় নারীকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি এর বিভিন্ন অংশীদারদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাজেটকে জেন্ডার সংবেদনশীল করা একান্ত প্রয়োজনীয়।

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

সমাজে এখনও নারীরা অবহেলিত এবং তাদের ক্ষমতায়নের কথাটি কেতাবি হিসাবেই পরিগণিত হয়ে আসছে। তাই মুখে আমরা যতই নারীর উন্নয়ন বা নারীর ক্ষমতায়নের কথাটি বলিনা কেন, এটিকে যদি জাতীয় পরিকল্পনায় আনা না যায় তাহলে এটি কেবল কথার কথাই থাকবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।