না পারি কইতে না পারি সইতে
নাজনীন তৌহিদ
দুদিনের টানা বৃষ্টিতে আমাদের নাকাল অবস্থা! ছেলেবেলায় মায়ের কাছে এক শ্লোক শুনেছিলাম , ‘সবে তো ফুলফুলানি, এখনও বাকি গোবর গাদানি’ । মায়ের সেই শ্লোক ধরেই বলতে চাই এখনও কিন্তু বর্ষা রানি ধরায় নামেননি। প্রতি বছর তার সাথে মহব্বতের জাপটাজাপটি করেই পথ চলতে হয় আমাদের। তার অতি ভালোবাসার বর্ষণে আমাদের শহুরে জনজীবন কেমন হয় তা নিশ্চয় সবার জানার কথা। যারা প্রতিদিন জীবিকার অন্বেষণে ছোটেন তাদের যে নাকানি চুবানি খেয়ে ঘরে ফিরতে হয় তা নিশ্চয় ভুলে যাওয়ার কথা নয়!
করোনা করোনা করে ঘরের বাইরে বেরুইনা বললেও থেমে নেই আমাদের জীবন জীবিকা। পথে আমরা চলছি রোজ কিন্তু কে রাখে আমাদের ভোগান্তির খোঁজ! না আমি কোনো দলাদলি কিংবা কথায় কথায় রাজনীতি টানা পাবলিক নই। আমি আগে নিজের দোষগুণ খুঁজে দেখি তারপর না হয় উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে দেব কি দেব না তা নিয়ে ভাবি! সাহিত্যিক মানুষ আমি সাহিত্যের মধ্যেই মুখ ডুবিয়ে, নাক ডুবিয়ে রাখাই আমার কাজ। কিন্তু যাদের কাজ তারা যখন সে কাজটি সমাধান করেন না তখন কলম ধরার এই কঠিন সমালোচনার কাজটিও ওই কাজের বেহুদা কাজি হয়ে আমি করতে বসলাম! আজকাল একটু কাজে ওকাজে ঘরের বাইরেও বেরোতে হয় বলেই একাজে সেকাজে একটু নাক ডুবালাম।
প্রতি বছর সড়ক, মহাসড়ক, সেতু নির্মাণ কিংবা উন্নয়নের যে কোনো নির্মাণের কথাই বলি না কেন তা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক কিংবা কাকতালীয় হোক সব এই বর্ষাকালেই যেন পড়ে। তাই আমরা সাধারণ নাগরিক না পারি কইতে, না পারি সইতে। ভোগান্তি মাথায় নিয়েই চলি। কিন্তু ক’বছর ধরে উড়াল সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল এবং নানা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রধান প্রধান সড়কের শরীরের অবস্থা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত তার দেহের ওপর হাতুড়ি শাবল দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। বর্ষার জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি লাভের জন্যও কম চেষ্টা হয় না তবু মুক্তি মেলে না আমাদের!
অনেকে খাল ভরাট, নদী ভরাট দখলদারিত্ম্যের প্রতাপ বলেন বা বলবেন। কিন্তু এসব কারা করছে? এই আমরাই তো নাকি? আমরা কি আদৌ সচেতন নাগরিক? রাস্তার ওপর আমাদের হাটবাজার কিছুতেই দমছে না। ফলে পলিথিন, কাগজ, ডাবের খোসা, কলার খোসা, সবজির আবর্জনা ঠেলে ঠেলে সেই ড্রেনেই ফেলছি। রাস্তার ওপরে,পথচারীদের সংকীর্ণ জায়গা টুকুতে যত্রতত্র ভাবে গজিয়ে ওঠা টং দোকান, খাবার রেস্তোরাঁ, ফলের ও ফুলের দোকানগুলোর নিচে ড্রেনের চলাচল বন্ধ, পলিথিন আর নানা রকম বর্জ্য ফেলে ড্রেনের চলার পথ যে বন্ধ করছি তা নিয়ে আমাদের সাধারণ মানুষের যেন মাথাব্যথা নেই! অকাজটা যখন আমরাই করছি তাই ভোগান্তির দায়ভার আর অন্যকে দেই কেন?
প্রতিদিন প্রত্যুষে পরিছন্ন কর্মীরা খুবই নিষ্ঠার সাথে সড়ক ঝাড়ু দেন! মাশাল্লাহ ঝাড়ু দিয়ে ময়লার স্তূপ ঠেলে ঠেলে সেই রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে থাকা ক্ষুদ্র জানলার ভেতর ঠেলে ঠেলে তারা জানলার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছেন সুন্দর ভাবে! তাদের ওই সূক্ষ্ম জ্ঞান নেই আর আমরা যারা দেখি তাদেরও এসব থামাবার জ্ঞান যখন নেই তখন আর আকাশ থেকে ঝরা রহমতের পানির ওপর রাগ করে লাভ কি!
এবার আরেকটু উঁচু ধাপে যাই। যারা বাসাবাড়িতে থাকেন তারা জানালা গলিয়ে অনায়াসে ময়লাটা এখানে সেখানে ফেলেন, গৃহকর্মীরা কষ্ট করে বিন খুঁজতে যায় না তারা টুক করে পথের ড্রেনে কিংবা জলাশয়ে ফেলে দিচ্ছে। তাই এদের জবাবদিহিতায় যখন আমরা নেই তখন পচা দুর্গন্ধ বলে নাক চেপে আর লাভ কি? আমাদের কর্ম দোষেই আমরা দোষী। জমি দখল, খাল, বিল, জলাশয় সব যত্রতত্র ভরাট করে নিজেদের মৃত্যু নিজেরাই ডাকছি । তাই অসুখের গোড়া ঠিক না করে মৃত্যু পথযাত্রীর পেছনে ডাক্তার আর পথ্য বেটে খাইয়ে কি লাভ হবে, এ যে হবে কেবল আমাদের মনের সান্ত্বনা। তাই চাই জনসচেতনতা।
এ তো গেল রাস্তা, ড্রেন কিংবা খালের মতো জলাশয়ের কথা এবার একটু নদীর কথায় ফিরি। আমাদের শহরকে ঘিরে রাখা তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা কেমন আছে? যারা এই নদীর পাশ ঘেঁষে থাকেন বা চলেন তারা জানেন তবে তারা নিত্যদিন থাকতে থাকতে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বলে এ নিয়ে হয়তো কথা বলেন না। এই নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য কলকারখানার বর্জ্য কোথায় যাচ্ছে? আমি পরিবেশবিদ নই, সাধারণ মানুষের সাধারণ চলার কথা বলি।
এবার একটু সদরঘাটের নৌযানের কথায় আসি। প্রতিদিন এখানে কতশত বিশাল দৈত্য দানবের মতো লঞ্চ স্টিমারগুলো চলা চল করে। এই নৌযানের হাজার হাজার মানুষের ব্যবহার্য ময়লা-আবর্জনা এই নদীগর্ভে ফেলা হয়। প্রতিদিন এই যন্ত্রদানবকে যখন গোসল করানো হয় তখন এর পেটে গায়ে যে কি পরিমাণ ময়লার স্তূপ জমা থাকে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সেখানকার পরিছন্নকর্মীরা শৌখিন যাত্রীর ব্যবহার্য প্লাস্টিক পানির বোতল, খাবারের প্যাকেট পরিষ্কার করে এই নদীতেই সব ফেলছে। আহ নদীগুলো মুখ্য সুখ্য বোবা তাই কিছু বলে না! কিন্তু ওদের পরানে যখন আর সইবে না তখন কিন্তু ওরা চিৎকার করে উঠলে আমাদের ঘরে বসে থাকারও সময় হবে না। এখন তো পানি দূষিত, পরিবেশ দূষিত বলে কেউ কেউ স্লোগান দিচ্ছে কিন্তু প্রকৃতি যে ফুঁসে উঠতে জানে তা আমরা কি বার বার ভুলে যাই? সে ফুঁসে উঠলে আমাদের রক্ষকর্তাও বুঝি আর আমাদের রক্ষা করতে আসবেন না!
প্রকৃতি থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে আর কবে আমাদের হুঁশ জ্ঞান আসবে আমার জানা নেই। রাস্তাঘাটে থু থু কাঁশি কফ ফেলে ফেলে আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত করেছি। এখন মাস্ক পরায় তবু আমাদের পথঘাট এই কলুষতা থেকে সামান্য রেহাই পাচ্ছে বোধহয়। আমরা সচেতন না হলে আমাদের আর রেহাই মিলবে না। একে অন্যের দোষ না ঘেঁটে নিজেদের দোষ নিজেরা ঘেঁটে একটু সচেতন হলে এবং কার কি দায়িত্ব তা না ভেবে নিজেরাই দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারলে হয়তো আমাদেরই ভালো। আমাদের সেই সচেতনতা, দেশাত্মবোধ জাগ্রত হক এই প্রত্যাশা! নিজেরা বাঁচি, দেশ বাঁচুক, প্রকৃতি বাঁচুক, বাঁচুক গোটা বিশ্ব।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/জেআইএম