তোষণ-বিভাজনে পর্যুদস্ত মহান সেবাঙ্গন
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
কিছু কিছু সেবাখাত রয়েছে যেগুলো একান্তই মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোন হুমকির মুখে এ সকল সেবাখাতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দায়িত্ব পালনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে এসকল পেশায় জনকল্যাণের চেয়ে জন-অকল্যাণ সাধিত হয় বেশি। তাই যে কোন জনকল্যাণমুখী সেবা অঙ্গণে পেশাদারী দায়িত্ব পালন করা সহজ কাজ নয়। এজন্য উন্নত বিশ্বে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সেবাদাতাদেরকে নিজেদের কর্মক্ষেত্রের সাথে শিক্ষা ও দক্ষতার সাথে সাযুয্য রেখে বাছাই করে কর্মে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে সিংহভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার সাথে পেশা পছন্দের কোন হিসেব মেলানো দুস্কর। শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যত্যয় দেখা গেলেও অন্যান্য পেশা পছন্দের ক্ষেত্রে ব্যাপক গরমিল লক্ষ্যণীয়। শিক্ষকতা, পুলিশিং, সাংবাদিকতা, এমনকি অপরাধ সংশোধনী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই কোন বিশেষ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে যথার্থ ও উপযুক্ত প্রার্থীকে কাজে নিয়োজিত করা যায়। কারণ সিংহভাগ চাকুরি ও নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করা হয় প্রচলিত কিছু সাধারণ পদ্ধতিতে, যথার্থ প্রার্থীর মননশীলতা চিন্তা করে নয়।
এছাড়া পদোন্নতি লাভের ক্ষেত্র উপরের দিকে সংকুচিত থাকায় একই শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এ নিয়ে চরম বিপত্তির ঘটনা প্রায়শই: লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠে। যা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ক্ষমতার দৌড়, লম্ফ-ঝম্ফ, দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদিকে উস্কে দেয়। এরপরও কাজ না হলে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশের প্রবণতা তৈরী করা হয়। কাজ করা নয়, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা নয়- বরং তোয়াজ ও তোষণের মাধ্যমে কে কাকে ডিঙ্গিয়ে বসের মন যুগিয়ে, ফাঁকি দিয়ে সময় পার করবে -সর্বত্র সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
এর মাঝে শুরু হয় সহকর্মীদের সাথে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অসহযোগিতা, অবিশ্বাস ও ল্যাং মারা প্রবণতা। এভাবে একটি সেবাদানকারী কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠে কুরুক্ষেত্র। তাইতো নিয়োগ প্রাপ্তির পর একজন ব্যাক্তির জবাবদিহিতা ও তাঁকে নিয়ন্ত্রণের একটি গতিশীল সেবাদান প্রক্রিয়া তৈরী করা সম্ভব হয়ে উঠে না। আমাদের অনেক বস্ চাটুকারদেরকে পছন্দ করেন। একই অফিসে কর্মরত কারো কোন অধস্তন কেউ একদিন তোয়াজ করে সামনে না এলে বা নিজের কাজ ফেলে তার অফিসে পা না মাড়ালে তাকে সন্দেহ করা হয়। তাই নিজের অবস্থান বাঁচাতে মরিয়া হয়ে অনেকে বাহ্যিকভাবে আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকেন।
বলাবাহুল্য এরূপ চরিত্রের রূপায়ণ ঘটেছে আমাদের সিংহভাগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। ফলে লিখিত নীতি-মডেল যাই থাক না কেন এগুলোই এখন সকলের জানা অলিখিত ব্যবস্থা। এভাবে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে দল, উপদল, এলাকাপ্রীতির দল, এলামনাসের দল, আত্মীয়-স্বজনের দল আরো কতকিছু! এগুলো সহকর্মীদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঘোষণা দিয়ে সৃষ্টি হলেও অনেক সময় স্বার্থ হরণ ও বিভেদ সৃষ্টিতে বেশী ভুমিকা রাখছে। বঞ্চনা, মনোমালিন্য, প্রতিহিংসা ইত্যাদির কারণে পালিত ধর্মঘট, কর্মবিরতির ফলে প্রতিষ্ঠানের আয় ও কাজের মান নিচে চলে যাচ্ছে।
শুধু কাজের মান নিচে চলে যাওয়াই নয়- দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ার ফলে লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে বহিরাঙ্গনের অপরাধ জগতের সাথে তাদের অনেকের সখ্য গড়ে উঠে। অন্যায়ের সাথে আঁতাত করে নিজের নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে কেউ কেউ একসময় অমানুষ হয়ে উঠে। কেউ মাদকাসক্ত হয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে খুন করতে দ্বিধা করে না- এমন উদাহরণও তৈরি হয়েছে।
কোন কোন সময় নানা হুমকি-ধামকিতে অথবা লোভে পড়ে এ সবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে ‘ইয়েলো জার্নালিজম’। কেউ কেউ কারো ‘পোষা’ উপাধি পেয়ে নিজের উপরই শুধু নয়- গোটা মহান পেশার উপর কালিমা লেপে ফেলেন। যা যে কোন জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এছাড়া বিভিন্ন দলীয় পরিচয়ে সংবাদপত্র ছাপানো হলে তা সাধারণ মানুষের কাছে ‘সিলমারা’ মনে হয়। সাধারণ জনগণ যারা রাজনৈতিক অতি মাখামাখি পছন্দ করেন না তাঁরা এসকল সংবাদে সন্দেহ পোষণ করেন। আমরা জানি লেবু বেশি চিপলে তেতো লাগে। কোন কিছু অতিরঞ্জন করে বার বার প্রচার করলে জনমনে তেতোভাব চলে আসে।
বলা হয়, শিক্ষক ও সাংবাদিকগণ সাদা কাপড়ের মত। তাঁদের কোন কিছুতে লোভ থাকতে নেই। আজকাল কিছু শিক্ষক ও সাংবাদিক নেতার এথিকস্ উপেক্ষা করে শুধু রাজনৈতিক অতি তোয়াজ-তোষণ করা বক্তব্যসম্বলিত লেখাগুলোর বাহার দেখলে অনেকের তা-ই মনে হতে পারে। হয়তো এ কারণে আক্ষেপ করে আমার একজন প্রিয় সাংবাদিক লিখেছেন, “সাংবাদিকরা দালালি ছাড়ুন, দালালরা সাংবাদিকতা ছাড়ুন।” তিনি আসলে খুব সাহস করে দুঃসাহসী কথাটা লিখেছেন যা সবার কল্যাণে কাজে আসতে পারে। কারণ দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত সাংবাদিকগণের নিজেদের মধ্যে অনৈক্য বিরাজ করায় যে কেউ একটু ছুঁতো পেলে গোটা সংবাদ অঙ্গনকে দ্রুত হেনস্তা করতে দ্বিধা করছে না। এছাড়া নিজেদের মধ্যে অহেতুক ফাটল তৈরি করার প্রবণতা বেশি থাকায় তাঁদের দুর্বল দিকগুলো অনুসন্ধান করে সরকার বা মানুষ সাংবাদিকগণকে গুরুত্ব দিতে চায় না।
আমরা জানি, সংগঠন করা ও সংগঠিত হবার অধিকার আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু এর মধ্যে নৈতিকতার চর্চা না থাকায় ভোগান্তি তৈরি করা হচ্ছে- যেটাকে মোটেও সংবিধান সমর্থন করে না। যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেটা হলো- পেশাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যদের মধ্যে অতি রাজনীতিকায়ন। সরাসরি চলমান রাজনীতির সাথে যুক্ত না হলে তাঁদের যেন কোথাও ঠাঁই নেই- এই ভয়ে তটস্থ থাকেন সবাই। পদোন্নতি, বদলি, আবাসন, পরিবহন ইত্যাদি সুবিধা পাবার জন্য দলীয় রাজনীতির দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই। কারণ, পদোন্নতি পাবার জন্য একাডেমিক ও কর্মঅভিজ্ঞতার সনদ সিংহভাগ ক্ষেত্রে কোন বিবেচ্য বিষয় নয়।
আমরা জানি যেখানে রাজনীতি চর্চার বিষয় থাকে সেখানে নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিশেষ করে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের পদগুলোর সংখ্যা সীমিত থাকায় সেগুলো সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত বলে আমি মনে করি। এতে রাজনীতি আরো বেড়ে যেতে পারে বলে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। তবে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়লে মানুষের মধ্যে হীমন্যতাবোধ কমে যায় এবং অপরের অধিকার ক্ষুণ্ণ না করে মর্যাদার সাথে সমুন্নত রাখার প্রবণতাও সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সে বোধ জাগ্রত হলে উচ্চপদে পদোন্নতি নিয়ে কারো মধ্যে আর কোন ক্ষোভ তৈরী হবে না। পদলাভের জন্য দৌড়-ঝাঁপ, তোয়াজ-তোষণ করে নেতাদের কাছে ধরনা দেয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে এবং যোগ্য ও ভাল মানুষ উচ্চপদে যেতে পারবে। এতে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও পদোন্নতিজনিত হতাশা বহুলাংশে কমে যাবে।
সম্প্রতি স্বায়ত্ত্বশাসিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষপদে আসীনদের দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় চলছে। এর মূল কারণ হলো ঐ সকল বড় বড় পদে নিয়মিত নির্বাচনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া। আগেকার দিনে ভিসি পদে নির্বাচিত হতে হলে সিনেট থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে কমপক্ষে তিনজনের একটি প্যানেল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হতো। কিন্তু এখন সেটা না করে প্রার্থীগণ ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রদর্শন করে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দেন। ফলত যার খুঁটির জোর যত বেশি তিনি তত সুবিধা নিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতা লাভ করেন। যার ফলে শত দুর্নীতি করলেও তাঁকে ঠেকায় কে? কারণ, তাঁর নিয়োগদাতার খুঁটি যে আরো বড়, আরো বেশি শক্ত! শত লেখালেখি বা আন্দোলন করেও তা টলানো দুস্কর! চিরচেনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি তাহলে দুর্নীতির ‘ব্রিডিং ফিল্ড’ হয়েই থাকবে?
এ ছাড়া সরকারি উচ্চপদে যেহেতু পদসংখ্যা কম এবং প্রার্থী বেশি সর্বোপরি সরকারি প্রতিষ্ঠানেও যেহেতু রাজনৈতিক পরিচয়ধারী সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে, সেহেতু সেগুলোতেও স্বায়ত্ত্বশাসিত বড় চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন পদের মত সর্বোচ্চ ৩-৪ টি পদে সরাসরি কর্মরত সদস্যদের ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকা উচিত। তাহলে সেখানেও গণতন্ত্র চালু হবে এবং কর্মরতদের মধ্যে রেষারেষি ও ল্যাং মারার প্রবণতা বন্ধ হবে। তা না হলে তোষণ-বিভাজনে পর্যুদস্ত সেবাখাত ও সংবাদ অঙ্গন আমাদেরকে চিরদিন চেয়ে চেয়ে দেখতে হতে পারে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। [email protected]
এইচআর/জিকেএস