সু-প্রশাসন
মনে আছে নিশ্চয়ই গত বছর করোনা শনাক্তের একেবারে শুরুর দিকের এক ঘটনা। যশোরে কয়েকজন বৃদ্ধকে কানে ধরিয়ে সে ছবি অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে পোস্ট করেছিলেন এক ম্যাজিষ্ট্রেট। বৃদ্ধদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল করোনার থাবা থেকে বাঁচতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে তারা মাস্ক পরে ছিলেন না। সারাদেশে আলোড়ন জাগায় সে ঘটনা।
এবার আরও দুই প্রশাসনিক কর্মকর্তা বড় আলোচনায় এসেছেন। প্রথম ঘটনা নারায়ণগঞ্জে। ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সামগ্রী চেয়ে জাতীয় কল সেন্টার কল করার অভিযোগ ফরিদ নামে এক বৃদ্ধকে জরিমানা হিসেবে ১০০ গরীব মানুষকে সরকারি খাদ্য সহায়তার অনুরূপ প্যাকেট বিতরণ করার শাস্তি দেন সদর ইউএনও আরিফা জহুরা। জেলে যাওয়ার ভয়ে গয়না বিক্রি ও ধার-দেনা করে ৭০ হাজার টাকার খাদ্য সামগ্রী কিনে গরিবদের মাঝে বিতরণ করেন ফরিদ। বাড়ি আছে, কিন্তু ঘরে খাবার নেই – মধ্যবিত্তের এই কান্না বোঝার চেষ্টা করেননি ইউএনও।
পরের ঘটনা বগুড়ার আদমদীঘিতে। উপজেলা পরিষদ চত্বর পার্কের বাগানের ফুলগাছ খেয়ে ফেলে এক অসহায় বৃদ্ধার ছাগল। এই অভিযোগে ইউএনও সীমা শারমিন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন। ছাগল মালিকের অনুপস্থিতিতে জরিমানা করা হয়। তিনি অভিযোগ করেন, জরিমানার টাকা দিতে রাজি না হলে, ইউএনও সপ্তাহখানেক ছাগলটি আটকে রাখার পর পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। কি ভয়ংকর! ভাবা যায় না যে, একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা এমন একটা কাজ করতে পারেন। আইন অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে হলে উপস্থিত থেকে দায় স্বীকার করতে হয়। পশুটিকে খোঁয়াড়ে দেওয়া ভালো সমাধান হতে পারত। দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে ইউএনও সীমা শারমিন অবশ্য অবশেষে তার মালিককে ছাগল ফেরত দিয়েছেন।
বিষয়গুলো আইনের প্রয়োগ যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মনোজগতের প্রকাশ। এরা কতটা অসনংবেদনশীল, কতটা দমননীতিতে আসক্ত তার ছোট কিছু নমূনা এসব ঘটনা। আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করতে হলে আগে অনুমতি নিতে হয় তার উপরের কর্তৃপক্ষের। ফলে একটা লাগামছাড়া ভাব সৃষ্টি হয়েছে তাদের মাঝে। অফিসার সাহেবদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত করতে গেলে সরকারের আগাম অনুমতি লাগবে এই আইন সাম্যের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে। সেটাও সয়ে গেছে এদেশের আপামর সাধারণ নাগরিকের। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায়, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের প্রতি আচরণ কেমন হবে, এটুকু সংবেদেশীলতাও থাকবে না? আমলাদের তদন্ত সরকারের অনুমতিসাপেক্ষ হওযায় সর্বব্যাপী দুর্নীতির ব্যাপ্তি ও গভীরতা উদ্ঘাটন করা কঠিন হয়ে গেছে। তবে কী এখন থেকে দুর্বিনীত আচরণেরও জন্য তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে?
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ঘটনার পর বেশ কয়েকজন সাবেক আমলা কলাম লিখেছেন, ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তারা বলেছেন, রোজিনার সাথে যে আচরণ করা হয়েছে, তা অনভিপ্রেত এবং জনগণের সাথে কি আচরণ করতে হয়, সেটা শেখাতে এখনকার আমলাদের নতুন করে প্রশিক্ষণ বা ওরিয়েন্টেশনের প্রয়োজন রয়েছে। ঢালাও কিছু বলা যাবে না। আমি নিজে অসংখ্য মানুষ প্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান আমলা দেখেছি। কিন্তু যশোর, নারায়নগঞ্জ বা আদমদীঘি এবং অবশ্যই সাংবাদিক রোজিনার ঘটনা বলে দেয় কোথাও কিছু একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে, যে কারণে মানুষ ও সমাজের প্রতি অফিসার মানুষদের সংবেদনশীলতা উবে যাচ্ছে।
প্রশাসনসহ দুই একটি ক্যাডার বেশি সুবিধা ও ক্ষমতা পাচ্ছে, অন্যরা বঞ্চিত হচ্ছে – এ কথা শুনতে হয় যেকোন পেশাজীবী সরকারি কর্মকর্তার সাথে কথা বললে। ২০১৪ সালে তখনকার অর্থমন্ত্রীর এক চিঠির বরাতে কাগজে নিউজ হয়েছিল। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে অর্থমন্ত্রীর চিঠির সূত্র ধরে পত্রিকায় নিউজ হয় সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপে কোন কোন বিশেষ ক্যাডার অনেক বেশি সুবিধা লাভ করছে, যা অন্য ক্যাডারদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই অতি বা অযাতিত সুবিধা বা অতি ক্ষমতা কোন কোন ক্যাডার কর্তাদের ভেতর একটা ‘উঁচু তলার বাসিন্দা’ মনোভাব জাগ্রত করছে কিনা সেটা ভাববার বিষয়।
সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা হবেন প্রজাতন্ত্রের সেবক (Servants of Republic)। তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব এ এম এম শওকত আলী এক লেখায় লিখেছিলেন, “প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নিয়ে মিডিয়ায় সব সময় কিছু না কিছু তথ্য প্রকাশ করা হলেও এ দুর্বলতা রোধে কোনো সরকারই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি”। কেন করেনি সেটা প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর নেই। আর খুব যে মিডিয়ায় আসে এসব ইস্যু তাও নয়।
মনে হচ্ছে, আমাদের আমলাতন্ত্রে ‘এলিট’ শব্দটি বেশ বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলিট বলতে এখানে শিক্ষিত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবে অগ্রসর শ্রেণির কথা বুঝি আমরা। কিন্তু এই এলিটতন্ত্র মনে হচ্ছে ক্ষমতার প্রদর্শন। আমলারা আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে মানুষকে সেবা পরিষেবা দিবেন – এটাই হল মূল কথা। কিন্তু কোন মানুষের ভুল বা অন্যায়ের প্রতি তার মনোভাব যদি হয় ‘ক্রোধোন্মত্ত’ তবে তা দুর্ভাগ্যজনক।
অতি-সরলীকরণ এক বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা আমলাতন্ত্রের ব্যাপারে সেটা করতে চাই না। কিন্তু আমলাতন্ত্রের উপরতলায় যারা আছেন তারা একটু মাঠ পর্যায় কিংবা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মধ্যম স্তরের কোন কোন কর্মকর্তার ব্যাপারে যখন অভিযোগ উঠে সেগুলো খতিয়ে দেখতে পারেন। সবকিছুকে ক্যাডার এসোসিয়েশন দিয়ে সুরক্ষা দেওয়ার নাম কাঠামোর ভেতর আবদ্ধ থাকা।
আমরা চাই চিন্তাশীল, বিদ্বান বা স্থিতধী মানুষ প্রশাসনে আসুক। চাই চাকুরি পাওয়ার পর তারা যেন উপযুক্ত শিক্ষা পান যা মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তথা প্রশাসন, আইন, প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য— সব স্তরে শিক্ষিত, দক্ষ ও সংবেদনশীল কর্মী-বাহিনীই হবে আমাদের আসল এলিট সম্প্রদায়। নিশ্চয়ই আমরা মনে রাখব যে, সু-প্রশাসনে বিনিয়োগের লাভ দীর্ঘমেয়াদি।
এইচআর/এএসএম