সাংবাদিকের বিপন্নতা যেন না বাড়ে
সবকিছু ঠিকঠাক মত হলে সাংবাদিক রোজিনা এখন জামিন পেয়ে তার সন্তানের কাছে থাকতেন। স্বামী এবং স্বজনদের কাছে থাকতেন। থাকতেন সহকর্মী পরিবেষ্টিত। কিন্তু বাংলাদেশ সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলে না। চলে না বলেই খুনের মামলার আসামির জামিন হলেও রোজিনার হয় না। ঠিকঠাকমতো হয় না বলেই সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত জায়গায় জনগণের হয়ে কাজ করে যে সাংবাদিক তাকে নির্যাতিত হতে হয়।
এখন অপেক্ষা কাল কী রায় আসে। শুনানি হলো, কিন্তু রায় কেন সেদিনই হলো না, সেই প্রশ্ন করলেও এখন নিশ্চয়ই নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে থাকা কোন একটি গোষ্ঠী যারা রোজিনা কাণ্ড ঘটিয়ে সরকারকে গণমাধ্যমের তথা জনগণের মুখোমুখি করতে চায়।
বিষয়টি শুধু এটুকুই নয়। এর ব্যাপ্তি অনেক বেশি। রোজিনা ইসলাম দেশের একজন প্রথিতযশা অনুসন্ধানী সাংবাদিক। দেশ বিদেশের বেশ কিছু বড় পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন তার রিপোর্টিং-এর জন্য। করোনাকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের যে অস্বাস্থ্যকর দশা আমরা দেখেছি তার অনেকগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে রোজিনার অসংখ্য রিপোর্টে। এসব রিপোর্ট এতটাই বস্তুনিষ্ঠ ছিল যে, মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর কোন প্রতিবাদও কখনও করতে পারে নি।
সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে সরকার, তাতে বিরক্তির কারণ থাকতে পারে, তবে নতুনত্ব কিছু নেই। নতুনত্ব এই যে এরকম কাজ যখন আমলারা করে। রোজিনা যদি সাংবাদিকতার নীতি বিরুদ্ধ কোন কাজ করে থাকেন তাহলো আইনানুগ অনেক পথ ছিল। সেই পথ অনুসরণ না করে কেন তাকে ছয় ঘন্টার মত আটকে রাখা হলো, বারবার অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল না সেই প্রশ্নের উত্তর স্বচ্ছভাবে না দিলে বলতে হবে রোজিনা ইসলাম সেদিন সচিবালয়ের ভেতরে আমলাতান্ত্রিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এবং সে কারণে এটি ছিল একটি হেফাজতে নির্যাতন।
তথ্যমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, সে জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী রোজিনা ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আমরা মনে করি ‘ন্যায়’ শব্দটি আলাদা করে উচ্চারণের প্রয়োজন নেই। বিচার পাওয়াটাই একজন নাগরিক প্রতি বিচারবিভাগের ন্যায্য আচরণ।
রোজিনা প্রথম আলোতে কাজ করেন। সচিবালয়ে তার আটকের দিন কেন পাঁচ ঘন্টা প্রথম আলো কোন নিউজ আপলোড করল না সেটি বড় ধোয়াশার সৃষ্টি করেছে। এবং পুরো ঘটনায় সম্পাদকের অনুপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। তবে পরে জানা গেল তিনি কোভিড আক্রান্ত। প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম রোজিনার ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোতে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সবার মত তিনিও ঘটনার বিশ্লেষণ এবং তার প্রতি আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন, তার মুক্তি চেয়েছেন। কিন্তু একদিন পরই সেই ডেইলি স্টারেই রোজিনার বিরুদ্ধে বিষোদগারে ভরা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন ছেপেছেন তিনি। শুধু তাই নয় এর পক্ষে তিনি যুক্তিও দেখিয়েছেন।
রোজিনার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত সাংবাদিকদের বয়কটের কারণে যে বক্তব্য স্বাস্থ্যমন্ত্রণায় প্রচার করতে পারে নি, সেটাই উঠে এল বিজ্ঞাপনে। যে সম্পাদকরা এটা করলেন, তারা তারাই ভেবে দেখবেন ঠিক করেছেন কিনা। তবে প্রত্যাশা বেশি যেখানে, সেই ডেইলি স্টার এবং তার সম্পাদকের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হয় নি। আগেরদিন রোজিনার প্রতি আচরণের নিন্দা জানিয়ে পরদিনই অর্থের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন ছাপানো আবার তার পক্ষে যুক্তি দেখানো সবার কাছে মনে হয়েছে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের জাগা থেকে একটি ভুল কাজ। যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য পাঠককে জানানো তার দায়িত্ব মনে করেন তাহলে তিনি তা নিউজ আকারে ছাপতেন, বিজ্ঞাপন হিসেবে নয়।
আমাদের আমলাতন্ত্র কতটা প্রগতি বিরোধী, কতটা উন্নয়ন বিরোধী এবং কতটা পশ্চাতপদ, তাদের মনোজগতে যে এখনও ঔপনিবেশ তার প্রমাণ রোজিনার বিরুদ্ধে একশ বছরের পুরোনো এই অফিশিয়াল সিক্রেটস এক্ট এ মামলা করা। ২০০৯ সালে এই সরকারের উপহার দেওয়া তথ্য অধিকার আইনের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এই অফিশিয়াল সিক্রেটস এক্ট। কিন্তু ২০১৮ সালে এই পুরোনো আইনকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মোড়কে। তখন সাংবাদিক ইউনিয়ন, সম্পাদক পরিষদের তরফ থেকে প্রতিবাদ করা হলে আইনমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী বলেছিলেন এই আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হবে না। কিন্তু আজ হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই প্রথম কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ হল। তবে কি বলব আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করল?
গণতন্ত্রের একটি মূল উপাদান সংবাদ। সাংবাদিকরা কাজ করেন মানুষের হয়ে। তাই তার কণ্ঠরোধ করা মানে হল জনগণের মত প্রকাশের জায়গাকে সংকুচিত করা। সরকারের ভেতরে অবস্থান করে কোন গোষ্ঠী যদি সরকারকে সে অবস্থানে নিয়ে যেতে চায় তাহলে সেটা দেখা সরকারেই দায়িত্ব।
সংবিধান বাকস্বাধীনতাকে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দিয়েছে। সংবাদের স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার। দেশের নিরাপত্তার অজুহাতে সেই স্বাধীনতাকে খর্ব করবার, তাকে নিয়ন্ত্রণ করবার যেকোন চেষ্টা যেমন ভ্রান্ত, তেমনই বিপজ্জনক। আবার একথাও ঠিক যে সাংবাদিকদেরও, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবাদমাধ্যমকেও তা মনে রাখতে হয়। সরকারের কাজের নজরদারি করা, তার সাফল্যের বিচার করা সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। সমস্যা হলো উভয়েই যখন উভয়ের বিচারক হয়ে ওঠে। সমালোচনা সাংবাদিকের দেশদ্রোহিতা বলে প্রতিপন্ন হওয়া যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি সাংবাদিকও নিশ্চয়ই তার জন্য প্রযোজ্য নীতি নৈতিকতার পথ থেকে সরে আসবেন না কখনও।
নির্ভীক ও তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ পরিবেশন ছাড়া নাগরিকদের পক্ষে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়। আমরা সেই পরিবেশটা চাই। সাংবাদিকের বিপন্নতা বাড়ে এমন কোন কাজ কোন পক্ষ থেকে যেন না হয়।
এইচআর/এএসএম