দখলদার ইসরায়েল ও মুসলিম প্রধান দেশগুলোর ভূমিকা
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যাবে না। এমনকি নিছক নিন্দাসূচক কোনো বিবৃতিও না। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রে ভেটো প্রদানের পর তা স্পষ্ট হয়ে গেছে, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটি এমনটাই চায়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের আগ্রাসী তৎপরতাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়েছেন, তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে এই কথা বলে। জাতিসংঘের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো কৌশলে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা মনে করেন, ফিলিস্তিনে মানবাধিকার নির্বাসিত হওয়ার পেছনে মূলত পশ্চিমা দেশগুলোই দায়ী।
হ্যাঁ, ইসরায়েলিদের আগ্রাসী তৎপরতার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু শক্তিধর দেশের মদদ আছে তা অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু জেরুজালেম, আল-আকসা মসজিদের মতো পবিত্র স্থানগুলোর নিরাপত্তার সঙ্গে যেখানে মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ জড়িত সেই মুসলমান প্রধান দেশগুলো কী করছে? মানবতাবিরোধী, জেরুজালেম ও আল-আকসা মসজিদের হুমকি ইসরায়েল বিষয়ে তারা কি আগের মতো প্রতিবাদী অবস্থানে আছে?
পশ্চিমা দেশ ছাড়াও দুনিয়ায় আরও দেশ আছে, জাতি আছে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলে এমন জাতিও আছে। বিশেষ করে আরব দেশগুলো কি করছে? আছে ওআইসি’র মতো সংগঠন ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ্য দেশগুলোর ভূমিকা কি? এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসরায়েলের এবারকার আগ্রাসী তৎপরতার পর মুসলিম প্রধান দেশগুলো যেন কুলুপ এঁটে বসে আছে। শিশু ও নারী নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডকেও তারা জোরালো প্রতিবাদ করছে না। ইসলামকে প্রাণের বিনিময়ে সেবা করার হুঙ্কার যারা ছাড়েন, তাদের ভূমিকা কি ইসরায়েলের এই আগ্রাসী কাণ্ডের পর? একটু হতাশাই প্রকাশ করতে হয়। যারা কথায় কথায় মুসলিম উম্মাহ বলে আওয়াজ দেন, তাদের নীরবতা প্রশ্নাতীত নয়। সমালোচনা হচ্ছে- মুসলমানদের এই নীরবতা দখলদার ইসরায়েলিদের উৎসাহ দিচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আসলে মুসলিমরা কি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও শান্তি চায়? কি বলে নিকট অতীতে আরব দেশগুলোর ইসরায়েল সম্পর্কিত নীতি-নৈতিকতা।
আরব দেশগুলোর নীতি-নৈতিকতা বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে, ওখানে মানবতা মার খাচ্ছে ক্ষমতা আর আধিপত্যবাদের কাছে। একের পর এক দেশ ইসরায়েল নামক আগ্রাসী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে নির্লজ্জভাবে। কোনো কোনো দেশ আবার দ্বিমুখী ভূমিকায়ও অবতীর্ণ। একদিকে ইসলাম রক্ষায় সর্বোত শক্তি ব্যয়ের কথা বলছে, অন্যদিকে ইসলাম ও মানবতাবিরোধী ইসরায়েলের সঙ্গেও নতুন করে আত্মীয়তা করছে। যেমন জর্ডান ও মিসর ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবতাবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইসরায়েলের কোলে স্থান করে নিয়েছে অনেক আগেই। তারা বলছে, তারা ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত দাবির সমর্থনে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। অন্যদিকে যারা ফিলিস্তিন দখল করে ওই দেশের মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করছে সেই ইসরায়েলকে বানিয়েছে বন্ধু। অথচ কিছু দেশ তো ইসরায়েলিদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দাগ বহন করছে দশকের পর দশক। ১৯৬৭ সালে মিসরের সিনাই দখল করে নিয়েছিল সেই ইতিহাসকে ভুলে গিয়ে মিসর কীভাবে আবার সম্পর্ক স্থাপন করে ইসরায়েলের সঙ্গে সেই প্রশ্নটি অধরাই রয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলিরা প্রিয় মিসরের কিছু এলাকায় ড্রোন হামলা করার পরও তাদের সম্পর্ক অটুট থাকে তাও ভেবে দেখার বিষয়। সিনাই অঞ্চলে শুধু ড্রোন হামলাই নয়, হেলিকপ্টার, জেট বিমান হামলা হলো প্রকাশ্যে। মিসর কি এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া ওইভাবে প্রকাশ করেছে? এ নিয়ে তো পশ্চিমা বিশ্বে মুখরোচক খবরও প্রকাশ হয়েছে সেই সময়। এমন সংবাদও হয়েছে যে মিসরের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেই নাকি ইসরায়েল মিসরে বিমান হামলা করেছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী মিসরের সিনাইয়ে ইসলামি বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশেই ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে, তাদের মিত্র মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল- সিসির সম্মতিক্রমে। এই সংবাদের বিশ্লেষণ করলে এমনটা ধারণা হতে পারে, মিসর তার অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ইসরায়েলের সাহায্য গ্রহণ করেছে।
সঙ্গত কারণেই বলা যায় সেই মিসর কি আর ফিলিস্তিনিদের দুঃখ দুর্দশায় এগিয়ে আসতে পারে? সিনা এলাকায় ইসলামি বিদ্রোহী গ্রুপের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কি তাদের উদ্দেশ্য কি এমন আলোচনা করার আগে বুঝতে হবে, প্রেসিডেন্ট আল–সিসি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাই শুভ করলেন না কি? এর পেছনে যে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা কাজ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পাশাপাশি ইসরায়েলের স্বার্থও জড়িত। সিনাইয়ের এই বিদ্রোহীরা ইসরায়েলকে শত্রু মনে করে ইসরায়েলি সীমান্তে হামলা করতো। তাদের দমন করে ইসরায়েল যতটা না তাদের মিত্র আল–সিসিকে সন্তুষ্ট করেছে তার চেয়ে বেশি তাদের সীমান্তকেও নিরাপদ করেছে। প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বলা যায়, মিসর আসলে ইসরায়েলের প্রকৃত বন্ধু হিসেবেই ভূমিকা পালন করেছে। এখন তারা যখন ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে বিশেষ করে হামাসদের নিধনে লিপ্ত আছে, তখন প্রেসিডেন্ট আল–সিসি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে এটা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়।
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ কয়েক বছর ধরেই তলে তলে ইসরায়েলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে এটাও অজানা নয়। জর্ডানে ইসরায়েলের দূতাবাসও আছে। সৌদি আরব কি নরঘাতক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা পালন করছে? সৌদি আরব কি ইসরায়েলকে তাদের অন্যতম মিত্র ভাবতে শুরু করেছে? আঞ্চলিক শক্তি পরীক্ষায় বিশেষ করে ইরান বিরোধিতার সূত্র ধরে শত্রুর শত্রু হিসেবে ইসরায়েলকে সৌদি আরব আপন ভাবতে শুরু করেছে? ইসরায়েল ঘনিষ্ঠতার পেছনে আবার মুসলমানদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাও কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নীপ্রধান দেশগুলো শিয়া প্রধান ইরানের পারমাণবিক শক্তিধর হওয়াকে ভালো চোখে দেখছে না। যে কারণে তাদেরও দেখা যায় সৌদি আরবের পথে হাঁটতে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রসঙ্গটিও একই সূত্রে গাথা বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ ইরানকে চাপে রাখার ক্ষমতা ইসরায়েল ছাড়া সুন্নী দেশগুলোর তেমন একটা নেই। সুতরাং কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতা লাভ করে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে। এমন অবস্থায় তাদের পক্ষে ইসরায়েলের বিরোধিতা করার নৈতিক অধিকার কি থাকে?
মুসলমান সংখ্যাধিক্যের দেশগুলোর যদি হয় এ অবস্থা তাহলে শুধু মানবতার কথা বলে অন্যদেশগুলোর পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করাটা কেমন মনে হয়? জেরুজালেম আল-আকসা মসজিদ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্থান। তাই মাথা উঁচিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকুক এটা মুসলমান হিসেবে সবারই কাম্য হওয়ার কথা। তাই বলতে হয়, ক্ষমতা যদি প্রধান লক্ষ্য হয় তাহলে মানবতা সেখানে মার খাবেই।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।
এইচআর/জেআইএম