করোনা টিকা তৈরিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা দেখানোর সুযোগ আছে

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:৩২ এএম, ১১ মে ২০২১

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ কমছে না। আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য পর্যাপ্ত প্রতিরোধক টিকা ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে। অল্প সময়রের মধ্য ওই দুই দেশ করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন খারাপ অবস্থা চলছে আমাদের নিকট প্রতিবেশি দেশ ভারতে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ক্ষতিকর বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। রাজ্যে রাজ্যে চলছে মৃত্যুর মিছিল। অক্সিজেন সংকট পরিস্থিতি নাজুক করে তুলেছে। হাসপাতালে জায়গা নেই। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। চিতার আগুন নিভছে না। ভারত বর্তমানে বিশ্বে করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে। নেপালেও করোনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। বাংলাদেশেও করোনার ভারতীয় ধরনের রোগী শনাক্ত হওয়ায় উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

ভারতের করোনা সংকটের জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর দায় চাপিয়েছে খ্যাতিসম্পন্ন মেডিকেল জার্নাল ‘দ্য ল্যালসেট'। ৮ মে এই জার্নালের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে রাখঢাক না করেই বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির সরকারই দেশে কোভিড বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। ল্যানসেট লিখেছে, বহুবার সতর্ক করা স্বত্ত্বেও সরকার কুম্ভমেলার মতো ধর্মীয় উৎসব পালন এবং পাঁচ রাজ্যে ভোট প্রচারের মতো অতিসংক্রামক অনুষ্ঠান করতে দিয়েছে, যা সুপার স্প্রেডারের কাজ করেছে। মোদি সমালোচকদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছেন। খোলামেলা আলোচনাও করতে চাননি। পরামর্শ নেননি। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।

বিজ্ঞাপন

মোদি সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো ল্যানসেটের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে কড়া কোনো বার্তা দেওয়া হবে ( মোদির প্রচার কর্মীরা একাজে ওস্তাদ) কিন্তু তাতে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি অতি বেশি সংক্রামক হওয়ায় টিকার সুরক্ষাও এড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। কীভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউযের চেয়ে বেশি প্রাণঘাতী বলে মনে করা হচ্ছে। সংক্রমণ রোধের জন্য কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে করা হলেও জনগণের মধ্যে একধরনের বাধা না মানার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কোনো রকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঝুঁকি নিয়ে এবং অতিরিক্ত ব্যয় করে ঢাকা ছেড়ে যেভাবে গ্রামে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তাতে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ উদযাপনের যে মানবিক আবেদন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেখেছেন, তা উপেক্ষা করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ যেন পণ করেছেন, মরবো তবু ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবো না। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

দুই.
করোনার টিকা নিয়েও বাংলাদেশে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের চুক্তি করে বাংলাদেশ কিছুটা স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু এখন নিজেদের দেশে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সিরাম টিকা সরবরাহ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশ বিপাকে পড়ছে। এখন অন্য দেশ থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় পরিমাণ টিকা যথাসময়ে পাওয়ার বিষয়টি একনো নিশ্চিত হয়নি। সিরামের টিকার প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন তাদের অনেকেরই দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ টিকার মজুদ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। চীন বা রাশিয়া থেকে যদি টিকা পাওয়াও যায় সে টিকা সিরামের প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন, তারা নিতে পারবেন কি না তা নিয়েও কোনো সর্বসম্মত মত পাওয়া যায়নি।

টিকা প্রাপ্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ার পর যখন স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা দৌড়ঝাঁপ করছিলেন, তখন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুএকটি প্রতিবেদন অনেককেই উৎসাহিত করেছিল।

গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের যেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে, তেমনি ব্যর্থতার পাল্লাও কম ভারী নয়। সাফল্যের মধ্যে আছে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বেশ সমৃদ্ধ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে অনেক দেশে আমরা ওষুধ রপ্তানি করছি। আর ব্যর্থতা হলো, স্বাস্থ্য খাতের অনেক সফল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখে চলে এসেছে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের অবহেলা, অনিয়ম, অদক্ষতা ও ভ্রান্ত নীতির কারণে। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ছয় ধরনের টিকা উৎপাদন করত, যার মধ্যে ছিল গুটিবসন্ত, কলেরা, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড ও জলাতঙ্ক রোগের টিকা। এর মধ্যে গুটিবসন্ত নির্মূল হওয়ায় এই টিকার উৎপাদন বন্ধ করা যৌক্তিক। কিন্তু অন্যান্য টিকার উৎপাদন কেন বন্ধ করা হলো? ১০ বছর আগেও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট জলাতঙ্ক রোগের টিকা উৎপাদন করেছিল। এরপর সব ধরনের টিকা উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বুদ্ধিতে। সংস্থাটি যদি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কোনো পরামর্শ দেয়, তাহলে আমরা তা গ্রহণ করব কেন? আমরা যত দূর জানি, সেকেলে প্রযুক্তির স্থলে কারখানাগুলোয় আধুনিক প্রযুক্তি আনার তাগিদ দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মাথাব্যথার জন্য মাথাটাই কেটে ফেলাকে ভালো মনে করেছেন। ২০০৬-২০০৭ সালে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের যে বৈঠক হয়, তাতে সেরামের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে একটি আধুনিক টিকা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার রূপ রেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের টিকা উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতেই বেশি আগ্রহ।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

দেশে টিকা উৎপাদনের জন্য একটি উন্নত কারখানা যে খুব প্রয়োজন, করোনা সংকট তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি অনেক উন্নয়নশীল দেশও করোনার টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়।

কিন্তু বাংলাদেশ সে পথে না গিয়ে টিকা সংগ্রহের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, তথা শুধু একটি উৎসের ওপর নির্ভর করে। ওই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ৩ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের চুক্তি হলেও এ পর্যন্ত উপহারসহ এক কোটির সামান্য কিছু বেশি ডোজ মাত্র পাওয়া গেছে । যদিও প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহের কথা ছিল। এখন আবার তা পুরোপুরি বন্ধ ভারত সরকারের নির্দেশনায়। এমন অবস্থায় সরকারের হুঁশ ফিরেছে এবং চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে। রাশিয়া শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তি দিতে রাজি আছে।

চীন ও রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ যদি টিকা পায়ও, তাতে মোট চাহিদার একাংশ পূরণ হবে মাত্র। সরকার বলেছে, জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলে ৮০ শতাংশ হবে কমবেশি ১৩ কোটি। প্রতিজনকে দুই ডোজ টিকা দিলে মোট ২৬ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন হবে, যা স্বল্প সময়ে বাইরের উৎস থেকে সংগ্রহ করা কঠিন। অথচ দেশে টিকা উৎপাদন করা হলে তার খরচ কম পড়বে। দেশের অনেক সাশ্রয় হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশও টিকা বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদন করতে হলে উচ্চতর প্রযুক্তি দরকার হয়। বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সে ধরনের প্রযুক্তি নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, প্রযুক্তিগতভাবে দেশ পিছিয়ে রয়েছে। কারণ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য যে গবেষণা ও তহবিল দরকার তা বাংলাদেশের নেই। কিন্তু আমরা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুও বানাচ্ছি। আমাদের দেশের ওষুধ বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তাহলে কেন পারব না।

উন্নত দেশগুলোকে প্রযুক্তি ও কাঁচামাল সরবরাহ করতে রাজি করিয়ে টিকা উৎপাদনে তো কোনো বাধা নেই। আসলে প্রয়োজন ইচ্ছা আর সবকিছুতে মুনাফা না করার মানসিকতা।

বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক তাদের উৎপাদিত করোনাভাইরাস টিকা মানবদেহে পরীক্ষা চালানোর অনুমতির জন্য আবেদন করেছে অনেক আগে। অন্য দেশের সরকারও গ্লোব বায়োটেকের এই উদ্যোগে থাকতে চাইছে। কিন্তু আমাদের এক্ষেত্রে শুধু চিঠি চালাচালি চলছে।

বিজ্ঞাপন

অনেকেই মনে করেন, স্বদেশের সক্ষমতা কাজে লাগালে বাংলাদেশে এত বেশি পরিমাণ টিকা উৎপাদন সম্ভব যে শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং নিজের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। কিন্তু নিজেদের সক্ষমতার ওপর আস্থা রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো মহলের বিশেষ বাণিজ্যিক স্বার্থের সংঘাত থাকলে জটিলতার জট সহজে খুলবে না। এই বিষয়টির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে নজর দিলে ভালো হবে বলে অনেকেই মনে করেন। রাশিয়ার টিকা বাংলাদেশেই উৎপাদনের সক্ষমতা অন্তত দুটি কোম্পানির রয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত ‘কোর কমিটি' মত দিয়েছে। গ্লোব বায়োটেকের টিকা নিয়ে কারা, কোথায় গিট্টু বাঁধছে, তা একটু খতিয়ে দেখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী এমন কাউকে দিন যার মাথা বিশেষ কারো কাছে বন্ধক দেওয়া নেই। টিকা নিয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার একটি সুযোগ বাংলাদেশের সামনে আছে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।