এভাবেও বিশ্ববিদ্যালয় চলে!
আমরা চাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বমানের হোক। কিন্তু আমরা উপাচার্য পাই আবদুস সোবহানদের মত। আমরা চাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণায় সেন্টার অব এক্সসিলেন্ট হোক। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাস সমূহে পুলিশ ডেকে জীবন বাঁচাতে হয়।
গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে দৃশ্য দেখা গেল এরপরও এটিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলা যায় কিনা, পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়া উপাচার্যকে শিক্ষক বলা যায় কিনা, যাবার প্রাক্কালে নিয়োগের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৪১ জনকে নিয়োগ দেওয়া এবং সেটাকে কেন্দ্র করে মারপিট হওয়াকেও ক্যাম্পাস সংস্কৃতি বলা যায় কিনা – সে নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে।
কিন্তু আমরা কেবল এটুকুই বুঝতে পারছি, এভাবেও বিশ্ববিদ্যালয় চলে। ২০১৭ সালের ৭ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দ্বিতীয়বার নিয়োগ পান ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। উপাচার্য পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুর্নীতির নানা অভিযোগে তাকে বারবার সংবাদ শিরোনাম করেছে। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন করে নিজ মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য দিয়ে অবসরগ্রহণ, বিভিন্ন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিসহ বিস্তর অভিযোগ নিয়ে বিদায় নিলেন তিনি।
এর আগে ২০১৯ সালে আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এ বছর জানুয়ারিতে দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) উপাচার্য প্রফেসর ড. মু. আবুল কাশেম মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮ দিন আগেই গোপনে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে চলে যান।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এভাবে পালাতে হয় কেন? প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের এমন মনোভাব কেন সৃষ্টি হয়? উপাচার্যরা উৎখাত হন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে, কিন্তু সমস্যাকে কখনও উৎখাত করা সম্ভব হয় না। কেন হয় না সে নিয়ে কথা বা ভাবাও হয় না।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা আলোচনা করতে গেলে রাজনৈতিক দল, বিশেষ শাসক দল ও এর ছাত্র সংগঠনের ভুমিকা আলোচনায় আসবেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্যের বিদায় বেলায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে নিয়োগ নিয়ে। অনেকেই বলবেন, ছাত্রলীগ নিয়োগ পেয়েছে বলেই এত কথা হচ্ছে। কিন্তু তারা ভেবে দেখছেন না যে, নিয়োগের বিরোধিতা করে যারা ক্যাম্পাসে মহড়া দিয়েছে তারাও ছাত্রলীগেরই। তারা ভেবে দেখবেন না, নিয়োগ ঠিক বা বেঠিক বা কারা পেল বা পেল না তার চাইতে বড় প্রশ্ন এই নিয়োগ কেন এমন গোলযোগের ভেতর দিয়ে হতে হল?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যতই মুখে বলি যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিমুক্ত হোক, সেটা হয় না। এমনকি রাজনীতিকরাও মাঝে মাঝেই এমন সদিচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বাস্তব বড় গোলমেলে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবেই। কিন্তু সেই রাজনীতি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের চাইতে বড় হয়ে দেখা দিবে? কেন এমন পরিস্থিতি হবে যে, শিক্ষকরা পাঠদান ও গবেষণার চেয়ে দলাদলি বেশি করবেন? কেন লেখাপড়ার ভুবনে ছাত্রছাত্রীরা দাঙ্গা হাঙ্গামায় নিয়োজিত থাকবে? ক্যাম্পাসে যেন ‘বহিরাগত’রা না আসে, শিক্ষক নিগ্রহ বন্ধ হয়, পুলিশ না ডাকতে হয়। তা হলেই প্রতিষ্ঠানসমূহ সুন্দর থেকে সুন্দরতর হবে।
অনেক দিনতো হল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীও উদযাপিত হল। বড় স্বপ্ন দেখছি আমরা। সেখানে আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে চললে বড় স্বপ্নের বড় বাস্তবায়ন হবে কি করে? গায়ে জ্বর আসলে প্যারাসিটামল খেয়ে সাময়িক ভাবে জ্বর কমিয়ে ফেলি। ভিসিকে সরিয়ে দেওয়া, পুলিশ পাহারায় নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া সেইরকম প্যারাসিটামল ট্রিটমেন্ট, রোগের চিকিৎসা নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করতে, ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের স্বার্থে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু এখন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আইন কার্যকর নয়। যাদের জন্য কার্যকর আছে সেগুলোও এর মর্মার্থ থেকে অনেক দূরে। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা এখন অনেক বেশি সরকারি। সরকারের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে, শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পান। সমস্যা এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয় ‘স্বশাসিত’ থাকবে, এই ধারণাই আর এখন নেই। দলবাজি রাজনীতি এবং সেই রাজনীতিতে সরকার দলীয় শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির ভেতর নানা গ্রুপিং এমন এক জটিলতার সৃষ্টি করেছে যে, এগুলো এখন আর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানতো দূরের কথা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই থাকছে না।
শুরুটা হয় কে উপাচার্য হবেন তা নিয়ে। এরপর থাকে ক্যাম্পাসের ভেতরে বাইরের নানা পদ পদবী। শিক্ষক ও কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ, ক্যাম্পাসের ভেতর নির্মাণ কাজ– এসব নিয়ে এমন গ্রুপিং আর লবিং শুরু হয় যে, লেকচারার থেকে উপাচার্য পর্যন্ত সবাই যে যার জায়গা থেকে শুধু পাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের বড় ও পাতি নেতারা ব্যস্ত থাকেন কার পকেটে কত অর্থ পকেটে আসল তা নিয়ে।
এখনকার সমস্যা এই মডেলটাই। গোটা ব্যবস্থাটাই একটা ছকে বাঁধা পড়ে গেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকার মত উন্নত দেশেও আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর জন্যে তার প্রশাসনকে পদে পদে সরকারি সাজতে হয় না, সারিদিন রাজনীতি, দলবাজি আর গ্রুপিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় না। আমাদের উপাচার্যরা নিজেদের সেখানে নিয়ে গেছেন যেকোনভাবেই হোক। এই মডেলেই চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি আসে শিক্ষকদের মাধ্যমে। তাদের মূল কাজ গবেষণা আর পাঠদান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক থেকে অধ্যাপক সবাই গবেষণা ও ক্লাসে পড়ানো ছাড়াও আরও অনেক কাজ করেন। তারা প্রশাসনিক নানা কাজ পরিচালনা করেন, শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল তত্ত্বাবধান করেন, ক্যাম্পাসে সুষ্ঠূ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখার চেষ্টা করেন। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য। কিন্তু রাজনৈতিক দলাদলিতে আজ সব কদর্য।
আমাদের শিক্ষকরা, উপাচার্যরা যদি স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে চান, তাহলে সেটা পরিষ্কার করুন। জনগণের টাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেতাই করার অধিকার আপনাদের নেই। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলে না।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস