আলোচনার টোপ নাকি ক্রান্তিকালের চেষ্টা
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংগঠনটির মহাসচিব নুরুল ইসলাম বিবৃতি মাধ্যমে সরকারকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে এই উদ্যোগ ইতিবাচক মনে হতে পারে। কারণ দেশের ভিতরে যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে সরকার সমাধানে আলোচনার পথ বেছে নিতে পারে।ইতিপূর্বে জাতীয় সমস্যা সমাধানে শেখ হাসিনার সরকার এমন উদ্যোগ নিয়ে সফলও হয়েছেন। কিন্তু হেফাজত যে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে এই আহ্বান এবং কার্যকারণ আগেরগুলোর চেয়ে ভিৃন্নতর। কারণ সমস্যাসৃষ্টিকারী নিজে যদি সমাধান করতে চায়, তা তার কাজের মধ্যে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তারা আলোচনার জন্য সরকারের কাছে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নতর।প্রশ্নটি বিশ্বাসযোগ্যতার। এই হেফাজতে ইসলাম আলোচনা ও প্রতিশ্রুতি কিভাবে বাস্তবায়ন করে তা বাংলাদেশের মানুষ আগেও দেখেছে। আগে সমঝোতা কিংবা চুক্তিবলে সরকার সংঘাতের পথ পরিহার করে শান্তি শৃংখলাকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে।
পরিণতি কি? দেশের মানুষ একের পর এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। অতীতের রেকর্ড বলে,সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে যখন বেকায়দায় পড়ে তখনই তারা আলোচনার কথা বলে। আসলে তাদের আলোচনা-সমঝোতা ইত্যাদি প্রস্তাবগুলো ক্ষমতালাভের কল্পিত পথে সাময়িক বিরতি মাত্র। সুতরাং এই সময় আলোচনার আহ্বানে সরকার সাড়া দেবে কি না কিংবা দিলেও অতীত থেকে শিক্ষা নেবে কি না তা ভেবে দেখার বিষয়। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তাহলে আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করতে চান তারা। তার মানে তারা এখনও মনে করছেন, কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। কিংবা তারা সমস্যা সৃষ্টিকারী নন।এমন পরিস্থিতিতে সরকার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সমঝোতা করবে কেন?
হেফাজতের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসায় হামলা করা হয়েছে। উল্লেখ নেই রেললাইনে আগুন দেওয়া, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান মিলনায়তন পুড়িয়ে দেওয়া, সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা, প্রেসক্লাব ধ্বংস করার মতো নৃশংসতার কথা। তবে একটা লাইন লিখেছেন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন তারা। মাদ্রাসায় হামলা করা,তৌহিদী জনতাকে উস্কানি দেওয়ার তদন্ত করতে আহ্বান জানিয়েছে হেফাজত। হয়তো বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবের প্রসঙ্গেই তারা এমনটা বলে থাকতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে- কারা এসব ঘটিয়েছে সেটা তাঁরা জানেন না? আর কে উস্কানি দিয়েছে সেটাও কি তাদের জানা নেই?
সাধারণ মানুষ পত্রিকা মাধ্যমে জেনেছে , ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার আগে হেফাজতে ইসলামির আমির হাটহাজারিতে প্রকাশ্যে ‘রক্তের বদলা নেয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন। মহাসচিব হিসেবে নিশ্চয়ই তিনি তাঁর আমিরের সেই আহ্বান সম্পর্কে জ্ঞাত আছেন। তাহলে কোন কারণে তিনি উস্কানিদাতা কে সেটা বের করতে তদন্ত করার আহ্বান জানান। আবার কারা রেললাইনে আগুন দিয়েছে, ব্রিজ ভেঙ্গেছে,উন্নয়ন মেলায় আগুন দিয়েছে, টোলপ্লাজা ও ভূমি অফিসে আগুন দিয়েছে, এর তো শত শত ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, কারা ছিলো সেসব তাণ্ডবে? তিনি বলেছেন, মাদ্রাসা আক্রান্ত হয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবে এবং তদন্ত ছাড়া তার বক্তব্যের সূত্রেই বলা যায়, কথিত আক্রমনের প্রতিশোধ নিতেই এই তাণ্ডবগুলো চালানো হয়েছিলো। তাহলে কারা এসব কাজ করেছে, বের করতে কি তদন্তের প্রয়োজন হয়?
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটার জন্য হেফাজতের আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিলো, বলে প্রকারান্তরে স্পষ্ট করে দিলেন,‘অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনে তারাই যুক্ত ছিলেন’।প্রকারান্তরে দায় স্বীকার করে তাঁরা আগামীতে আরও সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন?তাঁরা কি তাদের ওয়াদা পালন করেন? শাপলা চত্বরের ঘটনার সূত্রে চিটাগাং রোডে মিথ্যাচার করে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছিলো তারপরও তাদের এমনই সুরে কথা বলতে শোনা গেছে। সেই সুরেই হয়তো সরকার নরম হয়ে রাষ্ট্রীয় আইন অমান্যকারী কওমী মাদ্রাসায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের স্নাতকোত্তর মর্যাদা দিয়েছিলো। তারাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমী জননী উপাধি দিয়েছিলো। এর চেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি আর কি হতে পারে?
কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ আগমনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে স্বাধীনতা দিবসকে বেছে নেয়। জ্বালাও পোড়াওয়ের যে উল্লাস সেদিন মানুষ দেখেছে সেই বিষয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এই কি প্রতিশ্রুতি পূরণ? অন্যদিকে তারা ফলাও করে প্রচার করছে, স্বাধীনতা দিবসে তাদের কর্মসূচি ছিলো না। প্রশ্ন হচ্ছে কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের উস্কানি দিয়ে যদি বলা হয় কর্মসূচি ছিলো না তা কি ধোপে টিকে?
তারা যে প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করবে তা বোঝা যায়, বিবৃতিতে গণহারে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ থেকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এখন তাদের অধিকাংশই যদি তাণ্ডবে যুক্ত থাকে তাহলে কি তাদের আইনের আওতায় আনা যাবে না? সরকারি বক্তব্যেও একাধিকবার বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে একমাত্র সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ফলে বিবৃতিতে উল্লেখিত গণহারে বিষয়টি প্রশ্নবোধক। আবার এভাবেও বলা যায়- সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত থাকা লোকজন সবাই হেফাজতে ইসলামি বাংলাদেশ হওয়ার কারণে তাদের এমনটা মনে হতেই পারে। যেন গণহারেই গ্রেফতার করা হচ্ছে।
হেফাজত মহাসচিব বলেছেন,‘আমরা সরকারের উদ্দেশ্যে বলবো, কোথাও যদি কোনও সমস্যা হয়ে থাকে কিংবা হেফাজতের কর্মসূচিতে তৃতীয় কোন শক্তি যদি সুযোগ নিয়ে থাকে, অথবা কেউ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে থাকে, তাহলে সরকার তাদের খুঁজে বের করুক। আমরা সরকারকে এই ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবো ইনশাআল্লাহ।’ যদি শব্দ ব্যবহার করে তিনি স্পষ্টত ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছেন। এতবড় তাণ্ডবের পরও তিনি বলছেন ‘কোথাও যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে’।তার মানে এতসব ঘটনাকে তিনি স্বীকারই করতে চাইছেন না।
রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করছে কিনা সে বিষয়ে তাদের সংগঠনভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য কি হেফাজত শুনেনি? হেফাজতের একাধিক নেতা একের পর এক হেফাজত থেকে পদত্যাগ করেছে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হেফাজতের আন্দোলনকে পরিচালিত করার জন্য। তারা আগেও নেতাদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সুতরাং হেফাজতের আন্দোলন যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পরিচালিত তা হেফাজত নিজেরাই জানে এবং নেতাদের একটি অংশের বক্তব্যে তা স্পষ্টও। তাদের প্রতিটি কর্মসূচি রাজনৈতিক, কিন্তু মুখে বলছে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন চালাচ্ছেন।
এদিকে হেফাজতের শীর্ষনেতাদের অধিকাংশই কোনো না কোনো দলের নেতা। তারা হেফাজতের নেতা হিসেবে আন্দোলন করার পূর্বে নিজেদের দলীয় পরিচয় বিলুপ্ত করে আসেননি। অন্যদিকে হেফাজতভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শও প্রায় একই। প্রকৃতিও একইরকম। সুতরাং হেফাজত নিজেই তো অরাজনৈতিক আবরণে রাজনৈতিক সংগঠন। সেখানে তৃতীয় পক্ষ যদি ঢুকেও তাহলে ওই তৃতীয় পক্ষই রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত নয়, হেফাজত নিজেই রাজনৈতিক উদ্দেশে পরিচালিত। সেই প্রমাণ তারা ২০১০ সাল থেকে একের পর এক দিয়ে আসছে।
শাপলাচত্বরের নেতা বাবুনগরী বরাবরই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাশি মানুষ। তিনি যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠনকে পরিচালনা করেন, তার প্রমাণ শাপলা চত্বরের সন্ত্রাস। পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে ওই সময় তিনি বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা পেয়েছিলেন। ( ওই সংবাদে উল্লেখ ছিলো, এই টাকাসহ প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বাবুনগরী।- দৈনিক সমকাল, ৪ এপ্রিল ২০২১)
মামুনুল হক যেসব ওয়াজ মাহফিলের নামে সমাবেশ করে থাকেন সেখানে প্রতিটি বক্তৃতাতেই রাজনৈতিক আক্রমন থাকে। সরাসরি গালি এবং উস্কানিও থাকে। তেমনি অন্য নেতাদেরও দেখা যায়। সুতরাং হেফাজত এখনও যদি বলে, তারা অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কাজ করছে, তাহলে সেটা আদৌ সত্য কিনা সেটাও ভাবতে হবে। আলোচিত বিবৃতিটিও রাজনৈতিক বিবৃতিরই উদাহরণ। তার বক্তব্য ভাষার প্রয়োগ সবই তার প্রমাণ বহন করে।
তাই এমনটা বলার সুযোগ নেই, এই হেফাজত সুযোগ পেলে আরেকটা নাসিরগর,শাল্লা কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া তৈরি করবে না। সবই ঘটেছে শাপলাচত্বর ঘটনার পরবর্তীকালের সমঝোতা কার্যকর থাকাকালে। সরকারকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো এবং পরবর্তীকালে তাদের কার্যক্রম সবিস্তারে বিশ্লেষণ করেই সরকার এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। এমনও আলোচনা হচ্ছে- হেফাজতের এই আলোচনার টোপটি তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের প্রস্তুতির জন্য সময় চাওয়া। কেউ কেউ বলছেন- আসলে দেশব্যাপি অভিযানে তাদের যে ক্রান্তিকাল চলছে, সেই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য প্রচেষ্টা মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।
এইচআর/জেআইএম