লড়াই অর্থনৈতিক ভাইরাসের বিরুদ্ধেও

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ১৭ এপ্রিল ২০২১

অনেককেই মেরে ফেলছে করোনা ভাইরাস। আরও কতজনকে যে মারবে আমরা জানি না। কিন্তু সংক্রমণের বিস্তার ঘটতে কি যে করা যায় সে নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। কেউ বলছেন এমন কোমল, ঢিলেঢালা এক সপ্তাহের লকডাউনে কিছু হবে না, কঠোর লকডাউন লাগবে দুই থেকে তিন সপ্তাহের। আবার অনেকে একেবারেই লকডাউন বিরোধী। একথা মানতেই হবে যে, করোনা ভাইরাসের সাথে যে আমাদের বড় লড়াইটা করতে হয় অর্থনৈতিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে সেটা একটা বড় ভাবনার জায়গা।

গত বছর যখন করোনা এল, তখন অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভাল ছিল। কিন্তু ভাইরাসের জেরে টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি এবং এর প্রভাবে আর্থিক ক্ষতির ধাক্কা মোকাবেলা করতে হয়েছে। সেটা থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয়ে যেই না আবার শুরু হল অর্থনীতি পুনঃরুদ্ধারের কাজ, তখন এবার আবার আঘাত হানল করোনা ভাইরাসের আরও এক আগ্রাসী রূপ। ফলে আবারও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন সংকটের আভাস, আবারও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা এবং আবারও বেকারত্ব বাড়ার শঙ্কা। রোজগার বন্ধ হওয়ায় মানুষের হাতে টাকা আরো কমে যাবে এবার৷

অর্থনীতি এই বদ্ধ দশা থেকে বেরোবে কীভাবে? সংক্রমণ রোধ করতে মানুষে মানুষে সংযোগ কমাতেই হবে। তাই কড়া লকডাউনের বিকল্প নেই বলেই দাবি করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বাংলাদেশে নিজস্ব ধরনের যে লকডাউন হচ্ছে তা দিয়ে অবশেষে কি অর্জিত হবে, সে নিয়ে বড় জিজ্ঞাসা আছে। এটা না হচ্ছে লকডাউন, না হচ্ছে পরিকল্পিত কোন ব্যবস্থা।

করোনা দুর্যোগের চেয়ে অর্থনৈতিক দুর্যোগটা বেশি মারাত্মক হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। গতবার করোনার সময়ে সাধারণ ছুটির জেরে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সেই কাজ হারানো শ্রেণির অবস্থা ভাল হওয়ার আগেই আবার শুরু হল বড় সংক্রমণ। করোনা পরিস্থিতিকে সময় মতো নিয়ন্ত্রণ না করতে পারায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যাকে যে অঙ্কের মধ্যে আমরা বেঁধে ফেলতে পেরেছি বলে দাবি করেছিলাম তা আসলে হয়নি।

যে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা বলছি, ইতিমধ্যেই যে অনেকের ঘরে তা হানা দিয়েছে, সে কথা আমরা জানি। কিন্তু জেনে রাখা দরকার যে, এই করোনা আরও অনেকদিন থাকবে। তাই দেশব্যাপী এই সাত দিনের আধা-আধি লকডাউন নাকি সংক্রমণ যেখানে বেশি সেসব জায়গা চিহ্নিত করে এলাকাভিত্তিক লকডাউন বা বিধিনিষেধে যাবে সরকার তার একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। এবং করোনা সঙ্কট মিটে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কেমন হবে তার একটা ভাবনাও এখনই করে রাখা দরকার।

আমরা দেখেছি যুক্তরাজ্যের মত উন্নত দেশেও করোনার প্রথম ধাক্কায় লকডাউনের সময় ২৫ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নগদ সাহায্য পেয়েছে মানুষ যেন তার ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে না যায়। এগুলো করতে হয় পরিকল্পনা করে এবং সেটা করতে তথ্য উপাত্ত লাগে। আমরা লকডাউনে যাব, সব বন্ধ করে দিব, আবার কোন কোন মহল চাপ দিলে খুলে দিব– এটা কোন ব্যবস্থাপনার চিত্র নয়।

যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা খারাপ হতে বাধ্য। সরকারি হিসেবে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র যার মধ্যে ১১ শতাংশ অতি দরিদ্র। সংখ্যার হিসেবে প্রায় দুই কোটি মানুষ। করোনার কারণে আরও নতুন সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই যুক্ত হয়েছে। অসংগঠিত খাতের বিপুল মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। রিকশাওয়ালা থেকে ফুটপাতের হকার, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী ও ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পড়েছে বড় বিপদে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাতারে যারা তাদের অবস্থাও সঙ্গীন।

গতবার করোনা পরিস্থিতিতে ৫০ লাখ মানুষকে নগদ সহায়তা দিতে গিয়ে ৩৭ লাখকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই তালিকাটি আরও আপডেট হতে হবে এবং একইসাথে স্বচ্ছ হতে হবে। মুশকিল হল আমাদের মনোজগতে খাদ্য সহায়তার যে ধারণাটি আছে সেটি ত্রাণকেন্দ্রিক। এভাবে খাদ্য সহায়তা ব্যক্তি বা সংগঠন থেকে হলেও পরিকল্পনা করে এগুতে হবে সরকারকে এবং সেখানে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অনেক বড়। অতি দরিদ্রদের জন্য খাদ্য প্যাকেজটি কেমন হবে সেটা নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করে করতে হবে।

আমরা জানি বড় ঝুঁকিতে আছেন রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, হকার, নিম্নস্তরের কর্মচারীরা। শুধু ঢাকা শহরেই আছে ১১ লাখ রিকশাচালক। তাদের উপর নিভরশীল প্রায় ৫০ লাখ মুখ। পরিবহন খাতে সারাদেশে আছে ৭০ লাখ শ্রমিক। ঢাকাসহ বেশিরভাগ বড় শহরে নিম্নবিত্ত মানুষ বাস করেন বস্তিতে। এসব বস্তিবাসীর ৪০ শতাংশের জীবিকা অস্থায়ী। এগুলো আমাদের নিজস্ব বাস্তবতা।

অনেকেই বলবেন এত সমস্যার পরও চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। কিন্তু শুধু সেটা ঠিক থাকলেই হবে না। মানুষের সামর্থ্যও থাকতে হবে। লকডাউন অনেকদিন চালানো যাবে না, এটা হল বাস্তবতা। করোনার প্রথম ধাক্কায় মানুষ সঞ্চয় ভেঙ্গে খেয়েছে। এবার দ্বিতীয় ধাক্কায় কিভাবে চলবে? যাদের সঞ্চয় নেই, তারা ইতিমধ্যেই সমস্যার মুখে পড়তে শুরু করেছেন।

তাদের কাজ যেন থাকে সে চেষ্টাটাই বড় উদ্যোগ হবে। মানুষকে বুঝতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি, সরকারকে তার সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মানানোর মাধ্যমে। পাশাপাশি করোনা চিকিৎসাও সহজ লভ্য করতে হবে সরকারকে। ভাইরাসের কারণে অর্থনীতিটাই যেন যেন লকডাউনে না পড়ে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

আমরা জানি বড় ঝুঁকিতে আছেন রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, হকার, নিম্নস্তরের কর্মচারীরা। শুধু ঢাকা শহরেই আছে ১১ লাখ রিকশাচালক। তাদের উপর নিভরশীল প্রায় ৫০ লাখ মুখ। পরিবহন খাতে সারাদেশে আছে ৭০ লাখ শ্রমিক। ঢাকাসহ বেশিরভাগ বড় শহরে নিম্নবিত্ত মানুষ বাস করেন বস্তিতে। এসব বস্তিবাসীর ৪০ শতাংশের জীবিকা অস্থায়ী। এগুলো আমাদের নিজস্ব বাস্তবতা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।