আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা

ড. হারুন রশীদ
ড. হারুন রশীদ ড. হারুন রশীদ , ডেপুটি এডিটর (জাগো নিউজ)
প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০২১

এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো...

যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক

এসো এসো...
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশ রাশি
শুষ্ক করি দাও আসি
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক, দূরে যাক যাক
যাক
এসো এসো...

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উৎসব প্রিয় বাঙালির মন ভালো নেই। করোনা মহামারি তাদের এক ঘরে করেছে। সেই যে এক বছর আগে মরণ থাবা বসিয়েছিল প্রাণঘাতি ভাইরাস কোডিভ-১৯। এখন তা নানা মাত্রায় বেড়ে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মৃত্যু আর বিভীষিকার মধ্যে আমাদের নিত্য বাস। এমন কোনো দিন নেই যেদিন কারও না কারও প্রিয়জন হারানোর মর্মন্তুদ খবর শুনতে হয় না। হাসপাতালে রোগীর ঠাঁই হচ্ছে না। প্রতিটি বাড়িই যেন এক একটি হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। মুমূর্ষু রোগীর শ্বাস নেয়ার জন্য অক্সিজেনের সংকট। অত্যন্ত ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাস যেন আমাদের সবটুকু জীবনানন্দ কেড়ে নিয়েছে।

দুঃখজনক হচ্ছে, এ বড় দুর্যোগও আমাদের কিছু শেখাতে পাচ্ছেনা। যেখানে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মত সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানলেই প্রাণঘাতি ভাইরাসকে কাবু করা যায় সেটি মানার কোনো বালাই নেই। যত মৃত্যু বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীনতা। বাধ্য হয়ে সরকার এবার সপ্তাহজুড়ে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে দেশব্যাপী। ফলে এবারের নববর্ষ শুরু হচ্ছে গৃহবন্দী অবস্থায়।

দুই.
বাঙালির যে কয়টি উৎসব আছে তার মধ্যে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠান। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি বয়সের মানুষ এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। গ্রামগঞ্জ তো বটেই নাগরিক জীবনেও জায়গা করে নিয়েছে এই উৎসব। রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরে সঙ্গীতে বর্ষবরণের আয়োজন, চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই এক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ বলে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।

নানা রঙবেরঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে সকল বয়সী মানুষজন অংশ নেয় এই উৎসবে। বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। থাকে পান্তা ইলিশ খাওয়ার আয়োজন। সবমিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দ উৎসবে মাতে এদিন সমগ্র বাঙালি জাতি। বৈশাখে এখন কেনাকাটার ধুমও পড়ে যায়। সরকার বৈশাখী ভাতাও চালু করেছে উৎসবের গুরুত্ব বিবেচনায়। এটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে উৎসবে। এছাড়া বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।

সারাবিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও নাগরিক জীবনের এবং সরকারি কর্মকাণ্ডের সবকিছু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে। তারপরও বাঙালির গভীর মানসে বাংলা নববর্ষের স্থান অনেক উঁচুতে। বাঙালির মনপ্রাণজুড়ে রয়েছে বাংলা নববর্ষ। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতী, কামার-কুমোরসহ নানা পেশার মানুষ যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে আনন্দ উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে।

ব্যবসায়ীরা এখনও হিসাবের নতুন খাতা- ‘হালখাতা’ খোলেন বৈশাখের প্রথম দিনে। এ জন্য মিষ্টান্নেরও আয়োজন থাকে। নববর্ষ উপলক্ষে দেশে গ্রামেগঞ্জে নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে কিংবা বটগাছের ছায়ায় মেলার আয়োজন করা হয়। দোকানিরা মুড়ি, মুড়কি, পুতুল, খেলনা, মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশিসহ বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসে।

এভাবে বৈশাখ আসে আমাদের প্রাণের উৎসব হয়ে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা সনের উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত এই দেশের মানুষের জীবনধারা এবং প্রকৃতির অবস্থার সঙ্গে ফসলের মৌসুম এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন তারিখ তথা পঞ্জিকার প্রবর্তন হলেও এ নববর্ষ উৎসব বাঙালির চিন্তা চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। এটা এমন একটা উৎসব যাকে মুসলমান, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীসহ সকলেই সার্বজনীনভাবে প্রাণের আনন্দে বরণ করে নেয়।

তিন.
এবারের নববর্ষে এসবের কিছুই হচ্ছে না। জীবন বাঁচাতে যেমন জীবিকাকে বিসর্জন দিতে হচ্ছে তেমনি উৎসবের আনুষ্ঠানিকতাগুলোও দিতে হচ্ছে বাদ। জীবন থেমে থাকবে না। করোনাকালের মহাসংকট কাটিয়ে নিশ্চয়ই আবার জমবে মেলা, বটতলা হাটখোলা। কেননা বাংলা নববর্ষ অসুর দূর করে সুর সঙ্গীতের, মেলা ও মিলনের আনন্দ ও উৎসবের, সাহস ও সংকল্পের। দুঃখগ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ার দিনও পহেলা বৈশাখ। দেশের কল্যাণে সকলেই এক কাতারে শামিল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার অগ্নিশপথ নেওয়ার দিনও এটি।

পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বৈশাখের চেতনায় সিক্ত হতে হবে। সকল বাধাবিপত্তি ও বিধিনিষেধ উজিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দূর করতে হবে সকল কলুষতা। এবারের বৈশাখে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটুক। করোনামুক্ত হোক বিশ্ব। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্বাগত ১৪২৮ বঙ্গাব্দ।

এইচআর/জেআইএম

পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বৈশাখের চেতনায় সিক্ত হতে হবে। সকল বাধাবিপত্তি ও বিধিনিষেধ উজিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দূর করতে হবে সকল কলুষতা। এবারের বৈশাখে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটুক। করোনামুক্ত হোক বিশ্ব। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্বাগত ১৪২৮ বঙ্গাব্দ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।