পৃথিবী আবার মুখর হোক
প্রফেসর এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ
এই কোভিড ক্লান্তিকালে সারাবিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায় ইস্টার সানডে পালন করছেন। খ্রিস্টান বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো ইস্টার সানডে বা হ্যাপি রাইসেন ডে। যদিও আত্মিক দিক দিয়ে ইস্টার সানডে প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক প্রভু যিশু খ্রিস্টকে বিপথগামী ইহুদী শাসকগোষ্ঠী তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন শাসন ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল। মৃত্যুর তৃতীয় দিবস রবিবারে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন যিশু খ্রিস্ট। মৃত্যুঞ্জয়ী যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থানের ওই রবিবারটি ইস্টার সানডে নামে পরিচিত।
পূণ্য শুক্রবারের বিষদগাথা পার হওয়ার তৃতীয় দিনে আজ বিজয়গাথা। আমাদের জীবনে প্রভু যিশু’র পুনরুত্থান একটি প্রধান ও অর্থবহ ঘটনা। খ্রিস্ট ধর্মের বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রে রয়েছে এই পুনরুত্থান উৎসব। যিশুর পুনরুত্থান খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ধর্মীয় উৎসব। যিশু খ্রিস্ট মানুষের পাপের জন্য মুক্তির নিমিত্তে রক্ত ঝরিয়েছিলেন এবং হত হয়েছিলেন। তাই আজ প্রচলিত কাব্যিক ভাষার সেই সুর হৃদয়ে বাজছে;
‘বাংলা, বাংলা মোদের জন্মভূমি বাংলাদেশ।
কোটি কোটি সন্তান পায়নি কো পরিত্রাণ
হাহাকার করে অবিরত।
সুনয়নে কে দিল গো আঁখিজল
নয় কি সে শয়তান, নয় দিয়াবল
পাপানলে চারিধার, করেছে হে ছারখার
কে নিভাবে এ আগুন, কে নিবে ব্রত।
চেয়ে দেখ একবার বঙ্গমাতা
সম্মুখে তোমার কে ক্রুশেতে গাঁথা
তোমার তরে কত রক্ত ঝরে
কত রক্ত ঝরে,
তবে তরে বহে অবিরত।’
রক্ত! রক্ত! কত রক্ত ঝরে! রক্ত বিনে মুক্তি নেই। স্বাধীনতার মাস পার করে আমরা এখন একাত্তরের এপ্রিলে বয়ে যাওয়া শহিদদের রক্ত স্রোতের সময় পার করছি। ত্রিশ লক্ষাধিক শহিদের রক্তে রঞ্জিত বাংলার মাটিতে আজও আমি রক্তের ঘ্রান পাই। রক্তে কেনা বাংলায় আজও দিয়াবল রাজত্ব করছে। তারাইতো দিয়াবল যারা রক্তের মূল্য বোঝেনা। রক্তের মূল্যায়ন করেনা। তাদের জন্যই আমার এই বার্তা।
চল্লিশ দিনের রোজা পালন শেষে এ ইস্টার সানডে বিশ্বের সকল খ্রিস্টভক্তদের জীবনে বয়ে আনে নির্মল আনন্দ ও শান্তি। গভীর রাত থেকেই শুরু হয়ে যায় ইস্টার সানডে উদযাপন। এই দিন গভীর রাতে প্রতিটি চার্চে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান খ্রিস্টভক্তরা চার্চে গিয়ে উপস্থিত হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত অবস্থান করেন। তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে ইস্টার সানডের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। খ্রিস্টভক্তরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কীর্তন করে রাতের বাকি সময় পার করে দেন।
খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ইস্টার সানডে গোটা বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য একটি আনন্দের বিষয়। তিনি পাপতাপীর নিমিত্তে ক্রুশে সমর্পিত হয়েছিলেন। শত্রুদের দ্বারা প্রভু যিশু প্রহারিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, যন্ত্রণাভোগ এবং সর্বোপরি ক্রুশের ওপর জীবন সমর্পণ করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই মৃত্যু ছিল ক্ষণস্থায়ী। তিন দিনের পরেই তিনি মহা গৌরবে তাঁর পরাক্রম অসীম শক্তির পরিচয় দান করলেন। তিনি বেঁচে উঠলেন। কিন্তু যিশুর পুনরুত্থানের অনেক তাৎপর্য রয়েছে। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো যিশুর পুনরুত্থানের সার্থকতা যোগায়।
১. খ্রিস্টের পুনরুত্থান আমাদেরকে প্রচার করার জন্য সাহস জোগায়। যিশুর সময় থেকে, ঈশ্বরের শত্রুরা প্রচার কাজ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন জঘন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে যেমন, ধর্মভ্রষ্টতা, উপহাস, দৌরাত্ম্য, নিষেধাজ্ঞা, অত্যাচার এবং মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু, বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল: “যে কোন অস্ত্র তোমার বিপরীতে গঠিত হয়, তাহা সার্থক হইবে না।” (যিশা. ৫৪:১৭) শয়তান যে-ব্যক্তিদের ব্যবহার করে, তাদের আমরা ভয় পাই না। যিশু তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের সাহায্য করছেন। (মথি ২৮:২০) আমরা আত্মবিশ্বাসী হতে পারি, কারণ আমাদের শত্রুরা যা-ই করুক না কেন, তারা কখনোই আমাদের থামাতে পারবে না! দু-জন খ্রিস্টান ভাই সাহসের সঙ্গে প্রচার করছেন যিশুর পুনরুত্থান আমাদেরকে প্রচার করার জন্য সাহস জোগায়।
২. যিশুর পুনরুত্থান তাঁর সমস্ত শিক্ষাকে সত্য বলে প্রমাণ করেছিল। একজন বাইবেল পণ্ডিত লিখেছিলেন, খ্রিস্ট যদি পুনরুত্থিত না হয়ে থাকেন, তাহলে খ্রিস্টানরা হচ্ছে এমন বোকা লোক, যারা একটা বিরাট মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করে। পৌল লিখেছিলেন, যিশু যদি পুনরুত্থিত না হয়ে থাকেন, তাহলে খ্রিস্টানদের প্রচার কাজ এবং তাদের বিশ্বাস ব্যর্থ হয়ে যেত। সত্যি বলতে কী, সুসমাচারের বিবরণগুলো কেবল এমন এক বেদনাদায়ক কাহিনি হয়ে যেত, যে-কাহিনিতে একজন ভালো ও বিজ্ঞ ব্যক্তিকে তাঁর শত্রুরা হত্যা করে। কিন্তু, যিশু পুনরুত্থিত হয়েছিলেন আর এটা প্রমাণ দিয়েছিল, তাঁর সমস্ত শিক্ষা সত্য। পড়ুন, ১ করিন্থীয় ১৫:১৪, ১৫, ২০.
যিশু বলেছিলেন: “আমিই পুনরুত্থান ও জীবন; যে আমাতে বিশ্বাস করে, সে মরিলেও জীবিত থাকিবে।” (যোহন ১১:২৫) যিশুর এই প্রতিজ্ঞা নিশ্চিতভাবেই পরিপূর্ণ হবে। যিহোবা যিশুকে ক্ষমতা দিয়েছেন, যেন তিনি স্বর্গে শাসন করবে এমন ব্যক্তিদের ও সেইসঙ্গে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে এমন কোটি কোটি ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করেন। যিশুর বলিদান এবং পুনরুত্থান এই নিশ্চয়তা দেয়, পৃথিবীতে আর মৃত্যু হবে না। তাই, আমরা যেকোনো পরীক্ষা সহ্য করার আর এমনকি সাহসের সঙ্গে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার শক্তি লাভ করতে পারি!
৩. যিশুর পুনরুত্থান আমাদের এই নিশ্চয়তা দেয়, যিহোবার প্রেমপূর্ণ মানদণ্ড অনুসারে লোকেদের বিচার করা হবে। পৌল আথীনীতে একদল নারী-পুরুষের কাছে বলেছিলেন, ঈশ্বর “আপনার নিরূপিত ব্যক্তি দ্বারা ন্যায়ে জগৎসংসারের বিচার করিবেন; এই বিষয়ে সকলের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিয়াছেন, ফলতঃ মৃতগণের মধ্য হইতে তাঁহাকে উঠাইয়াছেন।” (প্রেরিত ১৭:৩১) ঈশ্বর যিশুকে আমাদের বিচারক হওয়ার জন্য নিযুক্ত করেছেন আর তাঁর বিচার যে ন্যায্য ও প্রেমপূর্ণ হবে, সেই বিষয়ে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি।—পড়ুন, যিশাইয় ১১:২-৪.
৪. যিশুর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি বলেই আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করতে চাই। যিশুকে যদি তাঁর জীবন ফিরিয়ে দিয়ে পুনরুত্থিত করা না হতো, তাহলে আমরা পাপ ও মৃত্যুর অধীনেই থেকে যেতাম। (রোমীয় ৫:১২; ৬:২৩) আমাদের কোনো আশাই থাকত না আর আমরা হয়তো এভাবে বলতাম: “আইস, আমরা ভোজন পান করি, কেননা কল্য মরিব।” (১ করি. ১৫:৩২) কিন্তু, আমরা জীবনের আনন্দফুর্তির ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি না। এর পরিবর্তে, আমরা পুনরুত্থানের আশাকে মূল্যবান বলে গণ্য করি এবং সবসময় ঈশ্বরের বাধ্য হওয়ার জন্য ইচ্ছুক থাকি।
৫. যিশুর পুনরুত্থান হচ্ছে ঈশ্বরের মহত্ত্বের প্রমাণ, যিনি ‘তাহাদের পুরস্কারদাতা, যাহারা তাঁহার অন্বেষণ করে।’ (ইব্রীয় ১১:৬) যিশুকে স্বর্গে অমর জীবনে পুনরুত্থিত করার জন্য ঈশ্বর অসীম ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা ব্যবহার করেছিলেন। এ ছাড়া, ঈশ্বর দেখিয়েছিলেন, তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলো পরিপূর্ণ করার সামর্থ্য তাঁর রয়েছে। যিহোবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এক বিশেষ ‘বংশ’ নিখিলবিশ্বের শাসন সংক্রান্ত বিচার্য বিষয় মীমাংসা করবে। তাঁর প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করার জন্য, সেই বংশ অর্থাৎ যিশুকে মারা যেতে ও পুনরুত্থিত হতে হয়েছিল। -আদি. ৩:১৫.
৬. আমাদের কাছে এই প্রমাণ রয়েছে, যিশু এখন রাজা হিসেবে শাসন করছেন এবং খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর মস্তক হিসেবে কাজ করছেন। সত্য খ্রিস্ট ধর্ম ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। যিশু যদি মৃত্যু থেকে উত্থিত না হতেন, তাহলে কি সেটা ঘটত? আসলে, যিশু যদি পুনরুত্থিত না হতেন, তাহলে আমরা হয়তো কখনো তাঁর সম্বন্ধে শুনতে পেতাম না। কিন্তু, আমাদের কাছে এটা বিশ্বাস করার জোরালো কারণ রয়েছে, যিশু জীবিত আছেন এবং বিশ্বব্যাপী প্রচার কাজের তত্ত্বাবধান করছেন।
৭. ঈশ্বর আমাদের পুনরুত্থানের আশা দিয়েছেন বলে আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। বাইবেল প্রতিজ্ঞা করেন: “দেখ, মনুষ্যদের সহিত ঈশ্বরের আবাস; তিনি তাহাদের সহিত বাস করিবেন, এবং তাহারা তাঁহার প্রজা হইবে; এবং ঈশ্বর আপনি তাহাদের সঙ্গে থাকিবেন, ও তাহাদের ঈশ্বর হইবেন। আর তিনি তাহাদের সমস্ত নেত্রজল মুছাইয়া দিবেন; এবং মৃত্যু আর হইবে না; শোক বা আর্ত্তনাদ বা ব্যথাও আর হইবে না; কারণ প্রথম বিষয় সকল লুপ্ত হইল।” এই প্রতিজ্ঞা প্রেরিত যোহনের কাছে করা হয়েছিল আর তাকে এই কথা বলা হয়েছিল: লিখ, কেননা এ সকল কথা বিশ্বসনীয় ও সত্য।” কে যোহনকে সেই প্রকাশিত বাক্য দিয়েছেন? পুনরুত্থিত যিশু খ্রিস্ট! -প্রকা. ১:১; ২১:৩-৫
যিশু খ্রিস্ট পুনরুত্থিত হবার পর চল্লিশ দিন এই পৃথিবীতে অবস্থান করেছিলেন। তখন তিনি হাজার হাজার মানুষকে দেখা দিয়েছিলেন। পরে শেষ দিন যিশু খ্রিস্ট একটি পাহাড়ের পাদদেশে হাজার হাজার মানুষের সামনে তাদের বললেন, “তোমরা সমুদয় জগতে যাও, আমার কথা বল, সুসমাচার প্রচার কর, যেন মানুষ পরিত্রাণ পায়। কারণ এখন আমি স্বর্গে পিতা ঈশ্বরের কাছে যাচ্ছি, আর শেষ দিনে মানব জাতির বিচার ও পরিত্রাণ কার্য সাধন করতে পুনরায় ফিরে আসব”। এই কথা বলে প্রভু যীশু ঊর্ধ্বে, স্বর্গে পিতা ঈশ্বরের কাছে নীত হলেন। পবিত্র রক্তে অর্জিত সুসমাচারের বীজ রোপিত ও পরিচর্যিত হোক এই রক্তাক্ত বাংলায়। এটাই ঈশ্বরের আকাঙক্ষা। আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, স্বর্গ সমান এই পৃথিবী আবার হবে মুখর, পূর্ণ হবে খুশির মেলায় বিশ্ব চরাচর। আমেন।
লেখক : পায়রা ট্রাস্ট এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ধর্মতত্ত্ব কলেজের শিক্ষক। গবেষক।
এইচআর/এমএস