অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তির বিকাশে প্রয়োজন সচেতনতা
মোহাম্মদ জাকির হোসেন
অটিজম স্পেকট্রাম স্নায়ুবিকাশজনিত বৈচিত্র্য যার প্রকৃত কারণ আজও চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে অজানা। অটিজম স্পেকট্রামের ফলে একটি শিশুর জন্মের ১৮-২৪ মাস পর থেকে নানা ধরনের বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশগত সমস্যা দেখা যায়। কখনো কখনো অটিজম সম্পন্ন ব্যক্তির মধ্যে একাধিক স্নায়ুবিক বিকাশগত সমস্যা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় কুসংস্কারের কারণে অধিকাংশ অটিজম স্পেকট্রাম বৈকল্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তি সমাজের মূলস্রোতের বাইরে রয়ে গেছে। অটিজম স্পেকট্রাম সম্পন্ন ব্যক্তির যথাযথ যত্ন, শিক্ষা প্রদান ও চিকিৎসা করলে তারাও একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো দেশের উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে।
মূলত অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ, ভাববিনিময় ও আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। এসব কারণে অভিভাবকরা তাদের সুস্থ শিশু থেকে আলাদা করে ফেলে এবং অজ্ঞতার কারণে এ সমস্যাকে প্রাকৃতিক অভিশাপ বলে শিশুকে সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতাও দেখা যায়।
অটিজম শণাক্তকরণের প্রাথমিক লক্ষণসমূহের মধ্যে রয়েছে- শিশু জন্মের ৬ মাসের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে না হাসা; ৯ মাসের মধ্যে তার যত্নকারীদের কথা, শব্দ, হাসি এবং মুখের ভাবভঙ্গির সাথে প্রতিক্রিয়ামূলক আচরণ না করা; ১২ মাসের মধ্যে মুখে কোনো শব্দ না করা, আঙুল দিয়ে কোনো কিছু না দেখানো; ১৬ মাসের মধ্যে কোনো শব্দ না করা, ২৪ মাসের মধ্যে দুটি শব্দের সংমিশ্রণে বাক্য না বলা, শিশুর অর্জিত যোগাযোগ ও দক্ষতা হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া। এসব লক্ষণ দেখা গেলে শিশুকে অটিজম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যত দ্রুত অটিজম শণাক্ত করা যায় ততই ভালো।
সরকারি জরিপ মতে দেশে প্রায় সোয়া তিন লাখ অটিজমসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে। দেশের অটিজমসহ নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানোন্নয়নে সরকার নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এ আইনের বলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট পরিচালিত হচ্ছে। এ ট্রাস্ট আইনের ধারা ৪ অনুযায়ী যে ব্যক্তির মধ্যে
ক. মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগে (Verbal and Non-Verbal Communication) সীমাবদ্ধতা; খ. সামাজিক ও পারস্পরিক আচার-আচরণ, ভাববিনিময় কল্পনাযুক্ত কাজ করার সীমাবদ্ধতা; গ. একই ধরনের বা সীমাবদ্ধ কিছু কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি; এই তিনটি বৈশিষ্ট্য উপস্থিত এবং ঘ. শ্রবণ, দর্শন, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, ব্যথা, ভারসাম্য ও চলনে অন্যদের তুলনায় বেশি বা কম সংবেদনশীলতা; ঙ. বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধিতা বা খিচুনি; চ. এক বা একাধিক বা নির্দিষ্ট বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা এবং একই ব্যক্তির মধ্যে বিকাশের অসমতা; ছ. অন্যের সাথে সরাসরি চোখে চোখ (eye contact) না রাখা বা কম রাখা; জ. অতিরিক্ত চঞ্চলতা, উত্তেজনা বা অসঙ্গতিপূর্ণ হাসি-কান্না; ঝ. অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গি; ঞ. একই রুটিনে চলার প্রচণ্ড প্রবণতা; এসব লক্ষণের এক বা একাধিক লক্ষণ পরিলক্ষিত হলে তারা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন।
সরকার এনডিডি ট্রাস্টের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এ শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করতে দক্ষ শিক্ষক তৈরির জন্য বিশেষ শিক্ষা স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এনডিডি শিশুর সমন্বিত/বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা, ২০১৯ মোতাবেক স্থাপিত বিদ্যালয়সমূহে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের পাঠদান নিশ্চিত করছে। এনডিডি ব্যক্তিদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মেধা অনুযায়ী তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে এবং জব ফেয়ারের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হচ্ছে। অভিভাবক প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা প্রণয়নপূর্বক অভিভাবক ও কেয়ার গিভার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
২
সরকারি উদ্যোগে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (IPNA) ও শিশু ও মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে শিশু বিকাশ কেন্দ্র এবং জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল এ সংক্রান্ত চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করা হচ্ছে। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এনডিডি ট্রাস্ট কর্তৃক ২০০০-২০২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৫০০ জন এনডিডি ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা করে এককালীন চিকিৎসা অনুদান প্রদান করা হচ্ছে।
অটিজম বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে এনডিডি ব্যক্তিরা পরিবার ও সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে। এ বিষয়ে অভিভাবক বিশেষ করে মায়েদের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে শিশুর বেড়ে উঠার সময়ে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষণীয় হলে সাথে সাথে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করলে জটিলতা অনকেটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। এ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যথাযথ বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাদের বিকাশ ও স্বাভাবিক মানুষের মতো হয়। অটিজম কোনো অভিশাপ নয়, এটি সৃষ্টিরই রহস্য একে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রদানকৃত চিকিৎসা, পরামর্শ, সেবা গ্রহণ করে গাইডলাইন অনুযায়ী যত্ন নিলে তারা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় দিন বিশ্ব অটিজম সজেতনতা দিবস পালিত হয়। অটিজম বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা তৈরিতে বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়। করোনা মহামারিকালীন ও করোনা-উত্তর সময় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ বছর ‘মহামারি-্উত্তর বিশ্বে ঝুঁকি প্রশমন কর্মক্ষেত্রে সুযোগ হবে প্রসারণ’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ১৪তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে।
অটিজম বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে অংশীজনদেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতাদের অটিজম বিষয়ে আলোচনা, সামাজিক ও শারীরিক হয়রানি বন্ধে সচেতনতা তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা প্রদান, শ্রেণিকক্ষে বিশেষ মনোযোগ দেয়া ও সহ-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা তৈরির জন্য ইতিবাচক মানসিকতার চর্চা করতে হবে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেও অটিজম বিষয় বিবেচনা করে স্থানীয় পর্যায়ে বাজেট প্রণয়ন ও প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে। সর্বোপরি স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিটি পরিবারের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি ও সরকারি সেবা প্রাপ্তির বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে অটিজম স্পেকট্রাম বৈকল্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের মেধা বিকাশের পরিবেশ ও একটি বাসযোগ্য সমাজ নিশ্চিত করা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।
লেখক : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
এইচআর/ফারুক/এমএস