পুরুষের বেশে মেয়েকে যুদ্ধে পাঠান সেলিনা বানু
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে কিছু সংখ্যক নারী মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং বিশেষ ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব শিরীন বানু মিতিল। বাম আদর্শে বিশ্বাসী শিরীন বানু সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১—শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সেদিন নারীরা ঘর ছেড়ে উঠোন, উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল আকাশ-শামিয়ানায় নিচে, খোলা প্রান্তরে।
“এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের অন্যতম স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘এ শাই গার্ল উইথ এ গান’ শিরোনামের প্রতিবেদন। এ খবর শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।” পরে আকাশবাণী কেন্দ্র থেকেও দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেগঘন কণ্ঠে প্রচারিত হয় বিশেষ প্রতিবেদনটি। যারা পাকিস্তানি দখলদারদের তাড়াতে লড়ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে—সবার জন্য এ খবর ছিল অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল তখন তাঁর ২১। তাঁর ছোট বোন ডা. সারা বানু শুচিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
৬ জানুয়ারি, ২০১১ সালে ইন্দিরা রোডের বাসায় শিরীন বানু মিতিল একাত্তরের স্মৃতিচারণ করেন, “সংগ্রামী বিপ্লবীদের মতো তাঁরও মানসিকতা ছিল ‘মেরে, মরো।’ রাজনীতিবিদ মা ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানষু। তিনি কখনও সন্তানকে সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি—নারী-পুরুষের পার্থক্য বুঝতে দেননি। মায়ের অনুপ্রেরণা ও মুক্তিযোদ্ধা শিরীন বানু মিতিল আদর্শের কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় এ সিদ্ধান্ত নিতে সাহসী হয়েছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সহযোদ্ধা এবং ফুফাতো ভাই জিঞ্জিরের কাছে মাত্র ৩০ মিনিটে থ্রি নট থ্রি চালনা শিখে ফেলেন। কিন্তু নারী হিসেবে সে সময়কার সমাজে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। মিতিলের দুই ফুফাতো ভাই জিন্দান ও জিঞ্জির যুদ্ধের ময়দানে রওনা হয় তাদের মায়ের নির্দেশে। এই মা—শিরীন বানুর ফুফু যিনি সম্পর্কে মামি সেই মায়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। রাকিবা বেগম ছিলেন পাবনা মহিলা পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সভানেত্রী। তিনি তাঁর ছেলেদের বলতেন, “তোমাদের কি মানুষ করেছি ঘরে থেকে অসহায়ভাবে মরার জন্য? মরতে হলে যুদ্ধ করতে করতে মরো। আরো বলতেন, আরেকটি কথা মনে রেখ কখনও পিঠে গুলি খেয়ো না।”
এমন পরিস্থিতিতে মিতিলও ঘরে বসে থাকেননি। তাই তিনি ফুফাতো ভাইদের পোশাক পরে, শার্ট-প্যান্ট পরে কিশোর যোদ্ধারবেশে, ছেলে সেজে যুদ্ধে অংশ নেন ৷ সেদিন শিরীন বানু আরো বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নারীরা কল্পনাতীত সাহসের সাথে পুরুষের পাশে থেকে সমানতালে লড়াই করেছেন, কিন্তু বীরাঙ্গনা শব্দ দিয়ে নারীদের যোদ্ধার চাইতে নির্যাতিত হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লড়াই এখনও চলছে এবং নারীদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই পাবনায় শত শত ছাত্রছাত্রীর সামরিক মহড়া শুরু হয়। সর্বস্তরের জনগণকে সংগঠিত করার জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সক্রিয় ছিল। ২৫ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিরোধ আন্দোলনের কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয় পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সে কেন্দ্রে একজন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যুক্ত হন শিরীন বানু মিতিল। তিনি যুদ্ধ করছিলেন স্টেটসম্যান পত্রিকা ও আকাশবাণীতে তাঁকে নিয়ে পুরুষের বেশে। তাঁকে এভাবে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য আমিনুল ইসলাম বাদশা। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পাবনা জেলাও পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জারি হয় সান্ধ্য আইন।
২৬ মার্চ তারা রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে। সাধারণ মানুষের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। পাবনায় প্রাথমিক প্রতিরোধ পর্ব হয় একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকেই। চলে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ২৭ মার্চ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইন্সে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয় সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। সেই যুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে। ঘরে ঘরে মেয়েরাও যুদ্ধে নামার কথা ভাবতে শুরু করে। তাদের অস্ত্র ছিল গরম পানি, এসিড, বাল্ব, বঁটি আর দা।
পাবনায় ২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া ৩১ মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। ৯ এপ্রিল যমুনা নদীর তীরে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারখ্যাত নগরবাড়ী ঘাটে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী এবং একমাত্র নারী ছিলেন তিনি। ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ মিতিলের ছবিসহ তাঁর পুরুষ সেজে যুদ্ধ করার খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করলে তাঁর পক্ষে আর পুরুষবেশে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁর যুদ্ধ থেমে থাকেনি। পরবর্তীতে একাত্তরের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে পাবনা দখল করে নিলে শিরীন বানু অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ২০ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে কুষ্টিয়া চুয়াডাঙ্গা হয়ে ভারত চলে যান। সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে গোবরা ক্যাম্পে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথমে নার্সিং ও পরে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
পরবর্তীতে মেজর জলিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯নং সেক্টরে যোগ দেন। তাঁর মতো যে সব দেশপ্রেমিক মহান নারী দেশকে ভালোবেসে পুরুষের পাশাপাশি নিজের জীবনকে বিপন্ন করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। শিরীন বানু মিতিল আমাদের কাছে একটি সাহসের নাম, যিনি প্রথা ও প্রতিরোধ ভেঙে মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী ভূমিকা রেখে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেন। তিনিই সেই অকুতোভয় একমাত্র নারী, যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। “এ শাই গার্ল উইথ এ গান” প্রতিবেদনটি শিরীন বানু মিতিলকে বীরের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। পরের মাসগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্যই বেশি সক্রিয় থেকেছেন। স্টেটসম্যান পত্রিকা ও আকাশবাণীতে প্রতিবেদন প্রচারের পর তাঁকেই অনেকে শুনিয়েছেন সে ঘটনা এভাবে—“জানেন পাবনার একটি মেয়ে ছেলেদের মতো পোশাক পরে যুদ্ধ করেছে...”। শিরীন বানু একথা শুনে মনে মনে মুচকি হেসেছেন। তবে এ খবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাবা-মা ও নিকটজনের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে।
শিরীন বানু ছিলেন রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোয় আলোকিত ছিল তাঁর পর্বূবর্তী দুই প্রজন্ম। নানা খানবাহাদুর ওয়াসীম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাবনার প্রথিতযশা আইনজীবী, সমাজসেবী এবং পাবনা পৌরসভার প্রথম সভাপতি ও জেলা বোর্ডের আজীবন সভাপতি। তাঁর কন্যা সেলিনা বানু রাজনীতিতে আসেন ১৯৩৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। আরেক সন্তান সেই সময়ে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পিতার প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা সেলিনা বানুর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তাই তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে পাবনার নানামুখী সমাজকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় সেলিনা বানু মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ১৯৪৬ থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাবনা জেলা ছাত্র ফেডারেশন সভাপতি হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৪৯ সালে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সাথী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শিরীন বানু মিতিলের মা সেলিনা বানু ছিলেন পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী, বাবা ছাত্রজীবন থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সেলিনা বানু এমএলএও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের পার্লামেন্টের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির হুইপ মনোনীত হন। আইন পরিষদে তিনি ইলা মিত্রের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন এবং বিনা বিচারে আটক বন্দিদের মুক্তি দাবি করেন।
সেলিনা বানু ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৬৭ সালে মস্কোপন্থী ন্যাপে যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে ড. শামসুজ্জোহা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কুমিল্লার শিক্ষক সমাজ আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ত্রিপুরার আগরতলা ক্রাফটস ক্যাম্প ও কলকাতার সল্টলেক শরণার্থী ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন।
সেলিনা বানু কুমিল্লা মধুমিতা কচি-কাঁচা মেলার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাবনায় কলেরা মহামারি আকারে দেখা দিলে তিনি স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে চিকিৎসাসেবায় সহায়তা করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে মহিলা পরিষদ গঠিত হলে এ সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত পটুয়াখালী জেলায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
সেলিনা বানু লেখালেখি করতেন- ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। ১৯৮৩ সালের ২৬ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ার ফলে শিশু বয়স থেকেই নিজেও ছিলেন রাজনীতিসচেতন। এমন একটি পরিবারেরই মেয়ে শিরীন বানু মিতিল বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন বলে তিনি ছিলেন পুরোপুরি কুসংস্কারমুক্ত। দেশের প্রতি অঙ্গীকার, দেশমাতৃকার ভালোবাসা উৎসারিত হয়েছিল তাঁর মায়ের অনুপ্রেরণা থেকে, পরিবারের রাজনৈতিক চেতনা থেকে। একাত্তরের ২৬ মার্চ কুমিল্লায় সেলিনা বানুদের পুরাতন বাড়িতে মিলিটারিরা আক্রমণ করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে এর কিছুদিন আগে পুরাতন বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে চলে যান তাঁরা।
ফলে সে সময়ে তাঁদের পুরো পরিবার বেঁচে যায়। তার পরই মা-বাবা, শিরীন বানু মিতিল ও অন্য দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়ে নরসিংদীর এক গ্রামে আশ্রয় নেন। ওই গ্রাম থেকেই তখন মায়ের প্রেরণায় পাবনার প্রতিরোধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সে খবর সংবাদপত্র ও রেডিওতে প্রচারের পর মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য নরসিংদী থেকে আগরতলায় চলে আসেন। কিছুদিন পর আগরতলা থেকে কলকাতায় আসেন এবং বাবা একটি চাকরিতে যোগ দেন আর মা সেলিনা বানু রাজনৈতিক দল ন্যাপের সাথে কাজ শুরু করেন পশ্চিম সীমান্ত এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধের কারণে পুরো পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মা সেলিনা বানু যোগ দেন ফরিদা বিদ্যালয়ে। বিশিষ্ট নারীনেত্রী পাবনা শহরের দিলালপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরীন বানু মিতিল ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৬ সালের ২১ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
শিরীন বানু মিতিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৭০-৭৩ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী এবং কিছু সময়ের জন্য পাবনা জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তাঁর ছোট বোন ডা. সারা বানু শুচি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধ করার সুযোগ কম থাকায় অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের বাসায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে কিছুদিন। প্রথমে কয়েকজন নারী বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। অবশেষে ৩৬ জন নারী নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে সদস্য ছিল ২৪০-এর ওপর। সেখানে প্রশিক্ষণ নেন সারা বানু শুচি। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতে থাকেন। অস্ত্রের স্বল্পতার কারণে মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রথম দলের একটি অংশ আগরতলায় যায় মেডিকেল কোরের সদস্য হিসেবে। বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন।
শিরীন বানু ছিলেন মাতৃভূমির সুযোগ্য সন্তান। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী তাঁকে অনন্য সাহসী কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের এক মহা ইতিহাস। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক বলিষ্ঠ অধ্যায়। সেই বলিষ্ঠতাকে প্রবল প্রাচুর্য ও সাহসের ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিয়েছিল পূর্ব বাংলার বিপুল তরুণ দল। সেই প্রদীপ্ত তারুণ্যের অত্যাশ্চর্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন শিরীন বানু মিতিল। পাবনার মেয়ে। দখলদার হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে এক দুরন্ত যৌবনের লড়াকু প্রতীক হয়ে আছেন।” মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান অনেক। মুক্তিযুদ্ধকালীন নারী কখনো গেরিলা যুদ্ধে, কখনো সম্মুখযুদ্ধে, কখনো সেবিকা, কখনো বার্তাবাহক হিসেবে অনেক অবদান রেখেছেন। অনেক নারী শহীদ হয়েছেন, অনেকেই তাঁদের স্বামী-সন্তান-বাবা-ভাই হারিয়েছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। অথচ নারীদের অবদান স্বীকার করতেই আমাদের যত কৃপণতা। অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদার লড়াইয়ের অসীম সাহসী এই বীর নারীকে আজ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। সারা জীবন দেশকে ভালোবেসে দেশের জয়গান গেয়েছেন, জীবনকে উৎসর্গ করার সাহস দেখিয়েছেন। তাই তিনি আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। শিরীন বানু মিতিলের মতো দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ও তাঁকে অনুসরণের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের আলোকিত করবো। বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরীন বানু মিতিল আজীবন মুক্তিযোদ্ধাই থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য আমরা তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ।
মুক্তিযোদ্ধা শিরীন বানু মিতিল ছিলেন দেশপ্রেম ও সাহসিকতার মূর্তপ্রতীক। দেশকে তিনি ভালো বেসেছিলেন হৃদয় দিয়ে। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে আমৃত্যু নিয়োজিত রেখেছিলেন। পাবনা জেলার প্রীতিলতাখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরীন বানু ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, বামপন্থী নেতা ৭ নম্বর সেক্টরে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিলেও যুদ্ধের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধার সাটির্ফিকেট বা সনদের জন্য কোনো আবেদন করেননি।
পরিচয় : মুক্তিযোদ্ধা শিরীন বানু মিতিল (উন্নয়নকর্মী ছিলেন, ২০১৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন) ও সারা বানু শুচি (চিকিৎসক) মুক্তিযোদ্ধা : সেক্টর ৭ ও ৯ সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জানুয়ারি ৬, ২০১১ ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা।
তথ্যসূত্র: “একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা, মার্জিয়া লিপি, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ৪৬/১ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম