মোদির সফর, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
‘A special visit begins with a special gesture’ – গতকাল ঢাকায় নেমে ব্যস্ততার মাঝেই এমন এক টুইট করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর দিল্লী থেকে রওয়ানা দেবার আগের টুইটে লেখা হয়, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে বিস্তারিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, যার লক্ষ্য ভারতের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা আরও এগিয়ে নেওয়া।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবার বাংলাদেশ সফরে এলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে। দু’দিনের সফরের প্রথম দিনটায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াসহ ছিল বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা। দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ আজকের দিনের কর্মসূচির রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে মোদির দিক থেকে, তথা ভারতীয় রাজনীতির নিরীখে।
বলা হচ্ছে, এটি তার নির্বাচনী সফর। পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার বলছে, বাংলাদেশে মতুয়ামন জয়ের চেষ্টা করবেন মোদি যা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কাজে লাগবে। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে যাবেন। ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটিতে পূজা দিয়ে আবার যাচ্ছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে গিয়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যাবেন ওড়াকান্দিতে। সেখানে ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূজা দেবেন। মোদির সঙ্গে এই সফরে আছেন পশ্চিমবঙ্গের মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির সদস্য বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর।
রাজনীতিক হিসেবে মোদি তার দলের বিজয়ের জন্য এটা করতেই পারেন। কিন্তু ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের জায়গাটি এই রাজনীতি থেকে অনেক বড়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে আমাদের উপর যে কী দুর্নিয়তি নেমে এসেছিল, কেমন ঘৃণ্য, নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছিল সে ইতিহাস বারবার বলেও শেষ হবে না। সে রাতেই বন্দি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের মুক্তির যুদ্ধে ভারতবাসী ও তাদের সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ, ত্যাগ বাংলাদেশের বাঙালিরা ভুলবে না কখনও।
বাংলাদেশের কিছু মৌলবাদী সংগঠন, কিছু বাম সংগঠন নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করছে। তারা বলছে, মোদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে গুজরাট, কাশ্মির ও দিল্লিসহ অনেক রাজ্যের মুসলমানদের খুন করা হয়েছে। চরম নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসবেন এটাই স্বাভাবিক। দুই দেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত সরকারের অবদানকে ভুলে যাইনি, ভুলে যাই নি ভারতের সাধারণ মানুষের ত্যাগ ও সহযোগিতার কথাও। এটা তার নিদর্শন। মোদির জায়গায় অন্য যে কেউ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেও আসতেন ভারতের জনগণের প্রতিনিধি হয়ে।
এ বছর দুটি দেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পালন করছে। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নতুন এক সড়কে উঠেছে এখন। দেখতে হবে আগামী ৫০ বছর কতটা হৃদ্যতাপূর্ণ হয় এই সম্পর্ক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য যতই ঐতিহাসিক হোক, একটি বিশেষ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছে না তা বাংলাদেশের মানুষ জেনে গেছে। তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে এই সফরে কোন আলোচনা নেই, সেটা আগেই বলে দেওয়া হয়েছে। গত দশ বছর ধরে দুদেশের সম্পর্কে অস্বস্তির কাঁটা হয়ে বিঁধে রয়েছে এই সমস্যা।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক বিরোধিতায় এই চুক্তি হতে পারছে না। ২০১১ সালে চুক্তির খসড়ায় দুই দেশ রাজি হয়েছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধায় যা সম্পাদিত হতে পারেনি। তবে চার দশক আগে এই তিস্তা নিয়েই দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল। ১৯৮৩ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় দুদেশের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের পর ভারত ও বাংলাদেশ একটা অস্থায়ী পানি ভাগাভাগির এক ফর্মুলা বের করেছিল। সেই ফর্মুলায় বলা হয়েছিল, তিস্তার পানি প্রবাহের ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ আর ৩৯ শতাংশ ভারত পাবে। বাকি ২৫ শতাংশ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বয়ে যেতে দেওয়া হবে, যাতে নদী বেঁচে থাকে। এই অস্থায়ী সমঝোতা টিকেছিল ১৯৮৫ সালের শেষ পর্যন্ত- অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর।
তখন সম্ভব হলে এখন কেন হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন সবার। কিন্তু উত্তর সহজ। এইচ এম এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সম্ভব হয়েছিল, কারণ তখন মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শাসক ছিলেন না। ছিলেন জ্যোতি বসু। বড় রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেক উদার ছিলেন।
ভারত মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করে নিতে দেরি করেনি। বিনিময়ে বাংলাদেশও তার প্রতিদান দিতে কখনও কার্পণ্য দেখায়নি। একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কাঠামোকে অবলম্বন করে বাংলাদেশ জাতি হিসেবে তার যাত্রা শুরু করে। ভারত গণতান্ত্রিক ও বন্ধুভাবাপন্ন বাংলাদেশকে তার আঞ্চলিক স্বার্থের সহচর বলে মনে করে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আসেন বাংলাদেশ সফরে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে এবার দ্বিতীয়বারের মত ঢাকায় এলেন মোদি।
আমাদের স্বাধীনতার সূচনা লগ্ন থেকে ভারতের সাথে যে সম্পর্ক রচিত হয় তা ৫০ বছর পর এসে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নানা কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যেসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। দুই দেশের মূল্যবোধ ও স্বার্থের মিল খুঁজতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নতুন সম্পর্কের ভিত গড়ে দিতে পারে, যদি তা ভবিষ্যতমুখী হয়, যদি উভয়ের আত্মমর্যাদা নিশ্চিতের জন্য নীতি ও কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
লেখক: সাংবাদিক
এইচআর/এএসএম