১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ : ফার্মগেটে প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ২৫ মার্চ ২০২১

অডিও শুনুন

আসাদুজ্জামান খান এমপি

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছিল; তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৫২-র অধিকারের আন্দোলন থেকে ’৬৬-র স্বাধিকারের আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি ধাপে ধাপে আন্দোলন করে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও যখন পাকিস্তানিরা জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে, তখনই বাঙালিদের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়।

বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন যে, স্বাধীনতার বিকল্প আর কিছু নেই। তখনই চূড়ান্ত হয়ে যায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপথ। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে পরিচালিত করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অজুহাত খুঁজতে থাকে সামরিক সরকার। এরই মধ্যে ১ মার্চ, হঠাৎ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঢাকায়। উত্তাল মার্চে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ফার্মগেট এলাকা।

বঙ্গবন্ধু আলোচনা চালিয়ে গেলেও জানতেন যে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে হবে এবং সেজন্য তিনি আমাদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলতেন। তৎকালীন ফার্মগেট ছিল প্রতিবাদের মোক্ষম জায়গা। ফার্মগেটে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। আমরা ফার্মগেট এলাকায় প্রতিদিন মিটিং-মিছিল করতাম। ছাত্রলীগের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আপামর জনতা আন্দোলনে যোগদান করতেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমরা নিজেদের প্রস্তুত রাখতে শুরু করি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশপথের এক কিলোমিটারের মধ্যে ফার্মগেট এলাকায় তখন প্রতিদিনই ব্যারিকেড দেওয়া হতো। মিছিলে মিছিলে উত্তাল থাকত রাজপথ।

আমাদের জমায়েত হওয়ার স্থান ছিল তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক ও হাবিব ব্যাংকের সামনে (এখনকার জনতা ব্যাংক ও কনকর্ড টাওয়ার)। স্বাধীনতার জন্য আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মধ্যেই দেখতাম উন্মাদনা। সবার দাবি তখন ছিল একটাই—স্বাধীনতা। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের কাছে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বের হতে পারে। কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা ২৫ মার্চ ফার্মগেটে একটি পরিখা খননের জন্য পরামর্শ দেন। পরিখা খনন অসম্ভব ছিল; কারণ ফার্মগেটের পাশে আর্মিদের অবস্থান ছিল। পরিখার বদলে আমরা ফার্মগেটে করাত দিয়ে বড় দুটি কড়ইগাছ কেটে গাছের গুঁড়ি ও লোহালক্কড় দিয়ে ব্যারিকেড দিই। আমাদের সহযোগিতা করেন তৎকালীন তেজগাঁও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়াসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও আপামর জনসাধারণ। তেজগাঁও এলাকার শ্রমিকরাও এতে যোগ দেন।

২৫ মার্চ দিনভর মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল ফার্মগেট এলাকা। পরিখা খননের বদলে আমরা কড়ইগাছের গুঁড়ি, পুরোনো গাড়ি, লোহার স্তূপ জমিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করি। রাত ১০টার দিকে ধীরে ধীরৈ কমতে থাকে ফার্মগেটের জনসমাগম। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি কতটা ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। ভয়াল সেই কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করতেই অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সাঁজোয়া যান প্রস্তুত থাকে; যাদের গন্তব্য ছিল রাজারবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানা। আমরাও রাতে ফার্মগেটের কৃষি বিভাগের বাগানের ভেতরে প্রস্তুত ছিলাম। আর অপেক্ষা করছিলাম কখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সাঁজোয়া যান বের হবে। এই দিন দুপুরে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন তেজগাঁও থানার দুই পুলিশ সদস্য। তারা আমাদের কথামতো রাতে তৎকালীন হাবিব ব্যাংকের ছাদে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে পজিশন নেয়। সারাদিন মিছিল-মিটিংয়ের পর সন্ধ্যায় ফার্মগেট এলাকায় জনসমাগম কমে আসে।

রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে থাকে ঘাতক সেনাদের কনভয়। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর কনভয় এগিয়ে আসতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মগেটের সামনে এসে আমাদের বাধার মুখে এবং ব্যারিকেডের সম্মুখে এসে কনভয়ের গতি থেমে যায়। আমাদের কাছে যা ছিল তাই আমরা কনভয়ের ওপর ছুড়ে ফেলতে থাকি এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করি ফার্মগেট এলাকা। তখন হাবিব ব্যাংকের ওপর অবস্থান নেওয়া দুই পুলিশ সদস্যও ফায়ার ওপেন করেন। কনভয় এসে রাস্তা পরিষ্কার করতে থাকে এবং আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; প্রথমে গুলি, পরে ব্রাশফায়ার করে। গুলির কারণে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে বাধ্য হই। আমরা যতক্ষণ ওখানে ছিলাম ততক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিলাম এবং তারা মেশিনগানের গুলি দিয়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ফার্মগেট এলাকায় প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাতকরা। গোলাগুলির কারণে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে আত্মরক্ষা করি।

পাকিস্তানি ঘাতকরা ফার্মগেট এলাকায় প্রতিরোধের মুখে পড়ে আরো সতর্ক হয়ে যায়। ফার্মগেটের প্রতিরোধের ইতিহাস জানা যায় পাকিস্তানি ঘাতক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ঘনিষ্ঠ মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে। বইটির ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে ২৫ মার্চ রাতে ফার্মগেটে মুক্তিকামী বাঙালির প্রতিরোধের কথা, যার বাংলা সারমর্ম হলো, ‘ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া প্রথম সেনা দলটি বাধার মুখে পড়ে ফার্মগেটে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে যার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। সদ্য কাটা বড় বড় গাছের গুঁড়ি রাস্তায় আড়াআড়িভাবে ফেলে প্রথম দলটিকে থামিয়ে দেওয়া হলো। পুরোনো গাড়ির খোল ও অকেজো স্টিমরোলার টেনে এনে রাস্তার পাশের ফাঁকা অংশও আটকে দেওয়া হয়।

ব্যারিকেডের ওপাশ থেকে আওয়ামী লীগের অন্তত কয়েকশ কর্মী দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকেন। জেনারেল টিক্কা খানের সদর দপ্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তাদের তেজোদীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হলো, মুহূর্তেই সেনাদের রাইফেলের গুলির শব্দ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে মিশে যেন একাকার হয়ে গেল। একটু পরেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিস্ফোরণ বাতাসে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল। এরপর কিছুক্ষণ ধরে গগনবিদারি স্লোগান ও গুলির শব্দের সঙ্গে হালকা মেশিনগানের গুঞ্জন বাতাসে ভেসে আসতে থাকল। প্রায় ১৫ মিনিট পরে গোলমালের শব্দ কমে এলো এবং স্লোগানের আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় থেমেই গেল। স্পষ্টতই অস্ত্রের জয় ঘটল। সেনা দল এগিয়ে গেল শহরের ভেতরের দিকে।

ফার্মগেটে প্রতিরোধের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যায় ঘাতক দল। বাংলামোটর এলাকায় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে হত্যা করে তারা। এরপর রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর পিলখানা এলাকায় ছুটে যায় সেনা কনভয়। রাজারবাগে বাঙালি পুলিশ ভাইদের প্রথম সশস্ত্র বাধার সম্মুখীন হয় কনভয়। প্রতিরোধ গড়ে ইতিহাস রচনা করেন বাঙালি বীর পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদস্যরা হতাহত হন এবং তারা পাকিস্তানি আধুনিক সমরাস্ত্রের সামনে টিকতে পারেননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাতকরা রাজারবাগ দখলে নেয়। পুলিশ সদস্যের আত্মত্যাগের বিনিময়ে রক্তাক্ত রাজারবাগে রচিত হয় সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস।

ফার্মগেটে প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। কারণ আমরা ট্রেনিং নিয়ে ছাত্রজনতা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিজয় অর্জন করি। এই স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছেন। দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এই স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : ২৫ মার্চ ফার্মগেটে প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেডের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতা ও মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এইচআর/এমএস

তৎকালীন ফার্মগেট ছিল প্রতিবাদের মোক্ষম জায়গা। ফার্মগেটে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। আমরা ফার্মগেট এলাকায় প্রতিদিন মিটিং-মিছিল করতাম। ছাত্রলীগের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আপামর জনতা আন্দোলনে যোগদান করতেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমরা নিজেদের প্রস্তুত রাখতে শুরু করি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশপথের এক কিলোমিটারের মধ্যে র্ফামগেট এলাকায় তখন প্রতিদিনই ব্যারিকেড দেওয়া হতো। মিছিলে মিছিলে উত্তাল থাকত রাজপথ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।