তাই বলে ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট!

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:১৬ এএম, ২২ মার্চ ২০২১

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

জাতিসংঘের মহাসচিব এ্যান্তনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ক্ষুধার কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে বিশ্বের লাখো মানুষ। বর্তমানে ৩৬টি দেশের তিন কোটি মানুষ মৃত্যু থেকে মাত্র একগজ দূরে অবস্থান করছে। আমাদের দেশে তিন কোটি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছে। করোনার প্রভাবে চাকুরিহারা হয়ে অনেকের আয় বন্ধ। অনেকের মজুরি কমে গেছে। বাজারে মাংসসহ নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত অনেক পরিবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগ্রহণের মাত্রা কমে গেছে।

অপরদিকে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, “সারাবিশ্বে বেশিরভাগ বাড়িতে একজন ব্যক্তির বছরে খাবার অপচয়ের পরিমাণ গড়ে ৭৪ কেজি। যুক্তরাজ্যের প্রতিটি বাড়িতে অপচয় করা হয় প্রতি সপ্তাহে একটি পরিবারের আট বেলার খাবার। মোট খাবার অপচয়ের ১৭ শতাংশ হয় রেস্তোরাঁ ও দোকানে। কিছু খাবার নষ্ট হয় কারখানা ও সাপ্লাই চেইনে।” এর অর্থ হলো, মোট খাবারের এক-তৃতীয়াংশ কখনও খাওয়াই হয় না (আমাদের সময়.কম ৬.৩.২০২১)।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে। করোনার জন্য শ্রমিকসংকট ও খাদ্য সংরক্ষনে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘদিন দেশে দেশে পরিবহন বন্ধ থাকায় এবং মালামাল পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ও সুষ্ঠ বণ্টনের অভাবে খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ফলে অনেক দেশে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তৈরি খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়া বর্তমানে একটি সাধারণ ঘটনা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধারণার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খাবার অপচয় হচ্ছে বলে জাতিসংঘ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “খাবারের অপচয় বেশি হচ্ছো ধনী দেশগুলোতে। উল্টোদিকে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে দরিদ্র দেশগুলোর ধনীদের অবস্থা আতঙ্কজনক। তারা প্রতিদিনই যেটুকু খাবার কিনেন সেটার সদ্বব্যহার করেন না। খাবার অপচয় করেন।”

উন্নত দেশগুলো দৈনিক যে পরিমাণ খাবার অপচয় করে সেটা যদি না করতো তাহলে দরিদ্র মানুষরা সে খাবার খেতে পারতো। খাবার অপচয়ের ফলে কয়েকশ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে আয় এবং সামাজিক যত্ন কমে যাওয়ায় অনেকে ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খেতে চেষ্টা করেছে। এত আরো বেশি স্বাস্থ্যহীনতা দেখা দিচ্ছে।

ঘন ঘন লকডাউন ও ঘরের বাইরে যাবার ভীতি থাকায় নষ্ট খাবার থেকে তৈরি বর্জ্য একদিকে বাসার ভিতরের পরিবেশ নষ্ট করেছে অন্যদিকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অভাবে সময়মত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর অভাবে পচে-গলে বাতাস গন্ধময় করাসহ সার্বিক কার্বন নির্গমন করে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করেছে। বর্তমানে দ্বিতীয় ও কোথাও কোথাও তৃতীয় ঢেউয়ের অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে। মালিকদের শ্রমচুরি ও কম মজুরি প্রদানের ফলে ২০২০ সালে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। এজন্য সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা বেড়েছে ২০%।

বর্তমানে করোনার নতুন প্রজাতি বের হওয়ায় যুবক ও শিশু কিশোরদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা বেড়েছে। পাশাপাশি করোনা সম্পর্কে মানুষের উদাসীনতা ও অবহেলা বেড়েছে বহুগুণ। ফলে একটি পরিবারের সব সদস্য আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একটি পরিবারের মা-শিশু সহ সবাই আক্রান্ত হলে পারিবারিক সেবা যত্ন নেয়ার কেই অবশিষ্ট থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

অপরদিকে হাসপাতাল সেবার সাথে জড়িত ফ্রন্টলানার হিসেবে পরিচিত চিকিৎসক, নার্স তারাও চিন্তিত। কারণ, আগাম টিকা গ্রহণ করার পরও টিকার মান ও অকার্যকারীতা নিয়ে নানা সন্দেহমূলক সংবাদ ছড়ানোর পর অপরকে সেবাপ্রদান করার পাশাপাশি তাঁদের নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে অনেকের মাঝে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। ফলে করোনা চিকিৎসা সেবায় আরো সংকট তৈরি হতে পারে।

এদিকে বিশ্বব্যাপী টিকা নিয়ে ব্যবসায়িক ও মনোবৃত্তি ও টিকারাজনীতি শুরু হয়েছে। টিকার মান ও কার্যকারিতা নিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে সংকট ও সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায়, টিকার ২য় ডোজ নেবার পরও পুনরায় করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় এবং সেগুলো ইন্টারনেটে দ্রুত সবাই জেনে ফেলায় সারাবিশ্বে সাধারণ মানুষের মাঝে টিকাগ্রহণ নিয়ে একধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে।

অপরদিকে অর্থাভাবে গরীব দেশগুলো এখনও টিকা সংগ্রহ করতে পরেনি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে এখনও কোন কার্যকর টিকা সহায়তার ঘোষণা না আসায় দরিদ্র মানুষের করোনা মোকাবেলা করা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। উপরন্তু, ধনী দেশগুলো জাতিসংঘের প্রতি তাদের নিয়মিত ক্ষুধা মোকাবেলার বাজেট কমিয়ে দিয়েছে অথবা বন্ধ করেছে। এজন্য ২০২১ সালে আফ্রিকা মহাদেশসহ অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলোতে ক্ষুধার তীব্র সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করে ৫৫০ কোটি ডলারের জরুরি সাহায্য চেয়েছেন।

আলোঝলমল প্রাসাদের পাশের বস্তিবাসী কিংবা কর্মহীন মানুষের খবর প্রতিদিন আমরা ক’জন-ই বা নিতে পারি? অসহায়, ভিক্ষুক, দরিদ্র রোগী, বেদনার্ত প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর নেয়ার সময় আমাদের নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বেশি উথলানো শুরু হলে এবং আবারো ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলে সার্বিক পরিস্থিকি কি হবে তা সবার কাছে নিশ্চয়ই অনুমেয়! এর সাথে খাদ্যসংকট শুরু হলে সেটার ভয়াবহ পরিণতি কি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।

আমি নিরাশ হই না। শুধু ভাবি ২০২০ সালের মত ভয়ংকর দিন আবার ফিরে না আসুক। এখন বিশ্বে বছরে ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়ে যায়। সেটা কি আমরা রক্ষা করতে পারি না? অন্তত সেসব ভূখা-নাঙ্গা মানুষদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করার জন্য একটি বিশেষ তহবিলে সেই অর্থ জমা দিয়ে নিজেদের ভোগ-বিলাস কিছুটা কমিয়ে মানবতার সেবা করার তাগিদ নিয়ে? শুধু ক্ষুধার কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে লক্ষ মানুষ- এই কথাটি আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারী বিলাসী মানুষদেরকে কি কোন নির্মম পরিহাসের বার্তা শোনায় না?

নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা কোন মানুষের ভাই হতে পারে না- সেকথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। তবুও কেন জেনেশুনে অপরের অধিকার কেড়ে নিই ও শান্তি নষ্ট করি আর প্রতিদিন আবারো অপচয় করি?

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এইচআর/জেআইএম

উন্নত দেশগুলো দৈনিক যে পরিমাণ খাবার অপচয় করে সেটা যদি না করতো তাহলে দরিদ্র মানুষরা সে খাবার খেতে পারতো। খাবার অপচয়ের ফলে কয়েকশ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে আয় এবং সামাজিক যত্ন কমে যাওয়ায় অনেকে ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খেতে চেষ্টা করেছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।