ওদের মুজিব শতবর্ষ উদযাপন!

১৭ মার্চ বাঙালির ক্যালেন্ডারে অন্যতম তাৎপর্যবহ একটি তারিখ। আর এবারের ১৭-র তাৎপর্য অন্য যে কোন ১৭ মার্চের তুলনায় শতগুণ বেশি। কারণ এবারের ১৭-তেই বঙ্গবন্ধুর শতক। তার ওপর এ বছর বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী। এই ১৭-কে কেন্দ্র করে এবার তাই আয়োজন বছরব্যাপী উদযাপনের। সকল সময়ের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্ম শতবার্ষিকী আর সাথে বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীকে স্মরণীয় করে রাখায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উৎসবের আয়োজন তাই অন্তহীন।

এত সব আয়োজনের ভীড়েও আলোচনায় এসেছিল এদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের মূল পৃষ্টপোষক রাজনৈতিক শক্তিটির স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপনের খবর। জাতীয় প্রেসক্লাবে স্বল্প পরিসরে, তাদের ভাষায় যারা এত বড়, তাদের এত ছোট উদযাপন এত সব উদযাপনের ভীড়ে আলোচনার দাবি রাখেনা নিশ্চয়ই। তারপরেও তা শিরোনামে ছিল, কারণ মানুষ ভেবেছিলো ভেঙেছে বোধহয় অবশেষে কুম্ভকর্ণের ঘুম, হয়েছে বোধকরি বোধোদয়। বিশেষ করে তারা যখন ৭ মার্চ উদযাপনের ঘোষণা দিল তখন সত্যি সত্যি নড়ে-চড়ে বসেছিলেন অনেকেই। অবশ্য পাশাপাশি এ নিয়ে সংশয়ও ছিল অনেকেরই। সম্প্রীতি বাংলাদেশের আয়োজনে ৭ মার্চের ভার্চুয়াল সম্প্রীতি সংলাপে ঘুরে ফিরেই এসেছে এ নিয়ে সংশয় আর সন্দেহ। শেষ-মেষ সন্দেহেরই জিত হয়েছে। ৭ পেরিয়ে ১৭-তে দাঁড়িয়ে এখন আর কারো বুঝতে বাকি নেই কেন তাদের এই তথাকথিত উদযাপন।

আমরা যখন কথায় কথায় বলি বঙ্গবন্ধুই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তখন তা অনেকের কাছে অনেক রকম তাৎপর্য বহন করে। এমনকি যারা চেতনায় ধারণ করেন বাংলাদেশ, তাদের কারো কারো কাছেও এটি কথার কথা, কেউ বা ভাবেন এটি সরকারি প্রচারণাতো কারো কারো কাছে তা বিবিসির জরিপের ফলাফল। আমরা ভুলে যাই কিংবা জানিনা যে বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের কনসেপ্টটিই যে শুধু বঙ্গবন্ধুর দেয়া তাই নয়, তিনি-ই একটি অপ্রস্তুত জাতিকে দুই যুগের সাধনায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। তাও এমন একটি জাতিকে যাদের হাজার বছরের ইতিহাসে স্বাধীনতা শব্দটি ছিল ‘বিজাতীয়’। যারা কখনো স্বাধীন হওয়াতো দূরে থাক, স্বাধীন হওয়ার স্বপ্নও দুঃস্বপ্নেও দেখেনি। শুধু তাই নয় এই স্বাধীন রাষ্ট্রটির খুটিনাটি প্রতিটি বিষয়- এর নাম থেকে শুরু করে সংবিধান আর জাতীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে জাতীয় শ্লোগান, এ সবই তারই নির্ধারণ করে দেয়া। সে জন্যই তিনি বাঙালির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম আর ঠিক সে কারণেই ‘বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ’।

বাংলাদেশে যাদের অবিশ্বাস, এখনও যারা যাদের দমে দমে ‘পিয়ারে পাকিস্তান’, সেই সব ‘বাংলাস্তানীদের’ সর্বোচ্চ অনাস্থাও তাই বঙ্গবন্ধুতেই। এরা জানে এ জাতি রাষ্ট্রটির প্রাণ ভ্রমরা বঙ্গবন্ধুই। তার শারীরিক অনুপুস্থিতিতেও তাতে যায় আসে সামান্যই। তাই তাদের সব আক্রমণের লক্ষ্য সব সময় বঙ্গবন্ধু। তারা জানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি একজন বাঙালির আস্থা আর বিশ্বাসেও যদি চিড় ধরানো যায়, তাতেই তাদের শক্তি বাড়ে আরো একজন। সে কারণেই তারা ৭ মার্চকে বিতর্কিত করতে চায়, ঠিক যেমনটি তারা বিতর্কিত করতে চায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে শুরু করে জয় বাংলা কিংবা জাতীয় চার মূল নীতি থেকে শুরু করে হালের কোভিশিল্ড সব কিছুকেই। তাদের মূল লক্ষ্য বাঙালির আজকের এই গৌরব আয়োজন, মুজিব বর্ষ উদযাপন থেকে আমাদের দৃষ্টি একটু হলেও অন্য দিকে সরিয়ে আনা আর ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক না কেন এই উদযাপনে একটুখানি হলেও চাঁদের কলংক লেপে দেয়া। আর এজন্য তাদের তৎপরতাও বহুমাত্রিক।

তারা যে শুধু ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যস্ত কিংবা তৎপর স্থিতিশীল রাজনীতির প্রেক্ষাপটটাকে আন্দোলিত করায় তাই নয়, তারা সক্রিয় সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য প্রতিটি জায়গাতেই। গত কদিন ধরেই সোস্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে একটি ক্ষুদে বার্তা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বরাতে ছড়ানো হচ্ছে আতংক। বিষয়টা প্রথম দিকে তেমন একটা গা করিনি। ভদ্রলোক ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত। এই করোনাকালে তার সাথে একটি গবেষণা প্রকল্পের সম্পৃক্ত হবার সুযোগও আমার হয়েছে। বারবার এই ক্ষুদে বার্তাটির সূত্র ধরে চেনা-অচেনা অসংখ্য ব্যক্তির প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে সত্যানুসন্ধানে তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানতে পারলাম তিনি এমন কোন কিছুই বলেননি। অথচ তাকে উদ্ধৃত করে এমন গুজব ইথারে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যটা কিন্তু পরিষ্কার। মুজিব বর্ষে যে পাঁচজন রাষ্ট্র আর সরকার প্রধান বাংলাদেশের প্রতি আস্থা জানিয়ে এই করোনাকালেও এ দেশে আসছেন, তাদের একজনের আস্থার জায়গাটিতেও যদি একটুখানি চিড় ধরানো যায় তো মন্দ কি?

গুজব আর মিথ্যার বেসাতির সাম্প্রতিক সময়ে যে ঊর্ধ্বমুখি ট্রেন্ড তা বোধ করি কোভিডের এদেশে যে সাম্প্রতিক আস্ফালন তাকেও হার মানায়। শুরুটা কদিন আগে, ভাস্কর্য বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। তারপর যেন কোন থামা-থামি নেই! কখনো কোভিশিল্ড বনাম মুরগির টিকা, তো কখনো ৭ মার্চের ভাষণ আর কখনো বা স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক, সঙ্গে আছে আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কিংবা নির্বাচন কমিশন ভেঙ্গে দেয়ার অযৌক্তিক যত মামা বাড়ির আহ্লাদ- মিথ্যাচার আর আবদারের যেন কোন শেষ নেই! এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যে তাতে একদিকে যেমন বেঁচে থাকলে লজ্জা পেতেন ‘গুজব রাজ’ গোয়েবলস, তেমনি অন্যদিকে আবদার পূরণ করতে যেয়ে নাভিশ্বাস উঠবে যে কোন ‘মামারই’।

প্রেক্ষাপটটা যখন এমনই, তখন প্রস্তুতিটাও থাকা উচিৎ ঠিক সেরকম। এই উৎসবকালে আমাদের শুধু উৎসবে মেতে থাকলেই চলবে না। পাশাপাশি সামনে তুলে আনতে হবে ঐতিহাসিক বাস্তবতাগুলোকেও আমাদের লেখায় আর বলায়। একাত্তর আমাদের অমূল্য অর্জন। এ বছর আমরা যেমন একাত্তরে আমাদের গৌরব গাথা তুলে ধরবো, তেমনি আমাদের তুলে আনতে হবে একাত্তরের পাকিস্তানীদের আর সেই সাথে তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতার কথাও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করেছে যেসব জিয়া-মোশতাক তাদের কথাও থাকতে হবে আমাদের উচ্চারণে। ইতিহাসকে ইতিহাসের সঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ায় আমাদের সর্বোচ্চ প্রয়াস রাখতে হবে এ বছরটাতে। অন্যথায় ওরা বার বার আমাদের সোনালী অর্জনগুলোকে কলঙ্কিত করার দুঃসাহস দেখাতেই থাকবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/এমএস

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করেছে যেসব জিয়া-মোশতাক তাদের কথাও থাকতে হবে আমাদের উচ্চারণে। ইতিহাসকে ইতিহাসের সঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ায় আমাদের সর্বোচ্চ প্রয়াস রাখতে হবে এ বছরটাতে। অন্যথায় ওরা বার বার আমাদের সোনালী অর্জনগুলোকে কলঙ্কিত করার দুঃসাহস দেখাতেই থাকবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।