আসছেন অনেকেই, আগ্রহ বেশি মোদিতেই

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:০১ এএম, ১৬ মার্চ ২০২১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি। উপলক্ষ একাধিক। উদযাপন আয়োজনেও ঘাটতি নেই। কোভিড-১৯ একটু ছন্দপতন ঘটিয়েছে ঠিকই কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের জন্য দশদিন ব্যাপী যে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে তাতে সরাসরি উপস্থিত থাকবেন ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান এবং মালদ্বীপের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা। সরাসরি উপস্থিত না থাকলেও বাণী দিয়ে যুক্ত হবেন চীনের প্রেসিডেন্ট, কানাডার প্রধানমন্ত্রীসহ আরো কয়েকজন। বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর অতিথিদের উপস্থিতি এবং সংযুক্তি আমাদের আয়োজন ও উদযাপনকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ এবং অর্থবহ করে তুলবে।

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ –বাংলাদেশ এই নীতি নিয়ে চললেও কোনো কোনো দেশের সঙ্গে নানা কারণে মৈত্রীর বন্ধন যে বেশি গুরুত্ববহ সেটা ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে এখন একটি মর্যাদার আসন অর্জনে সক্ষম হয়েছে। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছি আমরা। আগামী দুই দশকের মধ্যে আমরা উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রযসর হচ্ছি। আমাদের এই যাত্রাপথে বিভিন্ন দেশকে আমরা বন্ধু হিসেবে, উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পেয়েছি। আবার আমাদের অর্জন ও সাফল্যের ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, ব্যাহত হোক, আমরা আত্মনির্ভর না হয়ে পরনির্ভর থাকি – সেরকম চাওয়ার মতো দেশ নেই তা-ও নয়।

ভারতের ব্যাপারে অনেকের একটি সমালোচনা হলো, ভারত তার প্রতিবেশীদের কাছে চায় বেশি, দেয় কম। এই সমালোচনা একেবারে অমূলক নয়। ভারতকে এটা বুঝতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদানের কারণে আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার জন্য আমরা নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে যাবো মনে করলে ভুল হবে। বাংলাদেশ বিব্রত হয় এমন কোনো কিছু ভারতের দিক থেকে হবে না – এটাই আমাদের দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালে আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানকে ৯ মাসের যুদ্ধেপরাজিত করেই আমরা বিজয় অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের ভেতরে ব্যাপক জনগণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আবার কিছু মানুষ বিরুদ্ধেও ছিল। তেমনি দেশের বাইরেও আমাদের যেমন মিত্র ছিল, তেমনি পাকিস্তানও বন্ধুহীন ছিল না। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শত্রু – মিত্র ছিল। তবে শত্রুদের আমরা পরাজিত করেছি বন্ধুদের সমর্থন-সহযোগিতায়। আমরা বিজয় অর্জন করেছি ৩০ লক্ষ শহীদের জীবনের বিনিময়ে। একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান আছে : দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়।

শত্রু-মিত্রের দ্বন্দ্ব একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা নয়। তবে একাত্তরের অবস্থা বা চিত্র এখন অনেকটাই বদলছে। যারা তখন আমাদের বিজয় ব্যাহত করতে তৎপর ছিল তাদের কেউ কেউ এখন আমাদের অগ্রযাত্রার সহযোগী। আসলে সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায়। ভুল করে সেটা আঁকড়ে না থেকে সংশোধনের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াই উত্তম। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক একটু ভিন্নমাত্রযার হওয়াই স্বাভাবিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ছিল আমাদের অন্যন্ত নির্ভরযোগ্য মিত্র। এক কোটি মানুষকে ভারতের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া, তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের যোগান দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অক্লান্ত চেষ্টা এবং সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে এসে কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্যের জীবন দান – এসবের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে একটি আত্মীক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বলা হয়ে থাকে এই সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে রক্ত দিয়েই।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে এই দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও টানাপড়েন দেখা দিয়েছিল। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো সাধারণভাবে ভারতবিরোধিতার নীতি নিয়ে চলায় সম্পর্কের মধ্যে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। ভারতের মতো একটি বড় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সদ্ভাব না থাকলে তার বিরূপ প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি। দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে না, তা নয়। তবে উদ্দশ্যপূর্ণ ভুল একেবারেই আলাদা বিষয়। আবার এটাও ঠিক যে আমরা ছোট দেশ বলেই আমাদের প্রতি ভারত যদি বড়ভাই সুলভ আচরণ করতে চায়, সেটাও একেবারেই অগ্রহণযোগ। পারস্পরিক আস্থা ও মর্যাদাই হতে হয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি।

গত কয়েক বছরে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্ব দুই দেশের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসের যে আবহাওয়া তৈরি করেছে তার সুফল দুই দেশের সাধারণ মানুষই ভোগ করছে। ছিটমহল বিনিময়, সীমান্তসীমাসহ বড় বড় বেশ কিছু সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। এখনও কিছু সমস্যা দুই দেশের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে তিস্তার পানি বন্টন, সীমান্ত হত্যা এবং বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর।

২৬ মার্চ দুদিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন। ঢাকার বাইরেও তিনি তিনটি জায়গায় যাবেন। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে গিয়ে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। আগেই বলেছি, আরো কয়েকজন অতিথি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু সবাইকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সমান নয়। নরেন্দ্র মোদি তার এবারের সফরে কি বিশেষ কোনো কথা বলবেন, বা কোনো বিশেষ উপহার কি তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য আনবেন, যার জন্য তার সফর ব্যতিক্রম হিসেবে আমাদের মনে থাকবে?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তিস্তা নিয়ে কোনো সুখবর তিনি দেবেন না এটা মোটামুটি বোঝা যায়। কারণ তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে মোদি একতরফা কিছু করতে চান না। সামনেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। ভোটের আগে মোদি এমন কিছু নিশ্চয়ই বলবেন না যাতে তার দলের ক্ষতি হয়। তবে বাংলাদেশের উদ্বেগ ও অস্বস্তির বিষয়গুলো ভারতকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশ কিন্তু ভারতকে উদারভাবেই সহযোগিতা করে চলেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও ব্যবসাবাণিজ্যের সুযোগ সম্প্রসারিত করার জন্য বাংলাদেশ একের পর এক সুবিধা দিয়ে চলেছে। গত ৯ মার্চ ফেনী নদীতে মৈত্রী সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ভারতের অর্থায়নে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরকে সংযুক্ত করবে এই মৈত্রী সেতু। এই প্রথম কোনো নদীতে সেতু নির্মাণ করে দুই দেশের মধ্যে সংযেগ স্থাপিত হলো।

নরেন্দ্র মোদি এটাকে দুই দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্য করিডোর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই সেতু আমাদের দুই দেশের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনই রচনা করবে না বরং ব্যবসাবাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখবে। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও ত্রিপুরাবাসী ব্যবহার করতে পারবে।

ভারতের ব্যাপারে অনেকের একটি সমালোচনা হলো, ভারত তার প্রতিবেশীদের কাছে চায় বেশি, দেয় কম। এই সমালোচনা একেবারে অমূলক নয়। ভারতকে এটা বুঝতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদানের কারণে আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার জন্য আমরা নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে যাবো মনে করলে ভুল হবে। বাংলাদেশ বিব্রত হয় এমন কোনো কিছু ভারতের দিক থেকে হবে না – এটাই আমাদের দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

বিজ্ঞাপন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের উৎসবের সম্মানিত অতিথি। তার এবারের সফর শুধু উদযাপনের। দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো এবার আমরা তুলতে চাই না। বাংলাদেশ না তুললেও ইস্যুগুলো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। তাই আমরা চাইবো, বাংলাদেশ না বললেও তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন কিছু ঘোষণা দেবেন যাতে বাংলাদেশের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে পারে, সত্যি, ভারত হলো বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু।

নরেন্দ্র মোদি গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দির পরিদর্শন করবেন ২৭ মার্চ। পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটব্যাংক ক্ষমতার রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। ২৯৪ আসনের মধ্যে কমবেশি ৫০ আসনের ভোটে মতুয়ারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে মনে করা হয়। নরেন্দ্র মোদির মতুয়া মন্দিরে যাওয়া শুধু ভক্তিবশত বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন না।

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ একটি বড় বিপদে আছে। এই সংকট সমাধানে ভারতের আরও সক্রিয়তা আশা করা মোটেই বাহুল্য চিন্তা নয়। বিপদেই তো বন্ধুর পরিচয়।

বিজ্ঞাপন

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।