কালো-ফর্সা নয় মানুষ হিসেবে হোক পরিচয়
বনশ্রী হালদার
কথা বলবো দেশে সদ্য আলোচিত সাদা কালোর বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে। নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্যে বলতে চাই, কোন গণমাধ্যম বা বিশেষ কোন প্রতিবেদন আমার আলোচনার বিষয় নয়। কারণ এই সাদা কালোর অশ্লীলতা প্রতিদিন আমাদের গণমাধ্যমে নানা আকারে প্রচার হচ্ছে। খবরে নাটকে বিজ্ঞাপনে কোথায় নেই বর্ণবাদ। যেমন ধরুন বর্ণবাদ বিরোধী শ্লোগানে বলা হচ্ছে "বর্ণবাদের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও" আমি আসলে সমাজে স্থায়ী হয়ে বসে যাওয়া বর্ণবাদী চিন্তার বিপক্ষে বলছি।
বর্ণবাদের অপচর্চা আমাদের ছিলই। গত সপ্তাহের একটি ঘটনায় বিষয়টি সামনে এসেছে। ওই ঘটনাটি আসলে উপলক্ষ্য। যা হোক আলোচনায় আসি। পত্রিকার বিশেষ আয়েজনগুলো আমার সব সময় প্রিয়। সারাক্ষণ খুন, ধর্ষণ, দুর্ঘটনারমত মন খারাপ করা খবরের মধ্যে এই বিশেষ আয়োজনগুলো অনেকটাই স্বস্তি দেয়। কিন্তু গত সপ্তাহের একটি পত্রিকার বিশেষ আয়োজন ছিল অস্বস্তির। বিশেষ করে এই অস্বস্তিটা নারীদের মধ্যে বেশি সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত আমি নিজেও। আমার হতাশা একজন মানুষ হিসাবে। মানুষ হিসাবে, আমি মনে করছি ওই আয়োজন আমাদের সভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেমনটা বরাবরই করে।
সেখানে ছিলো কৃষ্ণবর্ণের দুই নারী। সাথে শিরোনাম ‘কালো…তবু সুন্দর”। ভেতরে বিষয়বস্তু কী সেটা পরের আলোচনার বিষয়। এই খবরের প্রথম আপত্তিকর শব্দ হচ্ছে তবু। সাধারণত বিপরীত অর্থ বোঝাতে ‘তবু'র ব্যবহার। এখানে সেটাই করা হয়েছে। তাহলে আমাদের নিশ্চয়ই বুঝতে হবে যার শরীরের রং কালো তিনি সমসময় অসুন্দর। গায়ের রং সাদা হলেই তিনি নিজেকে সুন্দর বলার দাবি রাখে। এসব প্রশ্নের জবাব আসলে কোথায় পাবো জানা নেই। যদিও সমালোচনার শুরুর পর পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাদের অনলাইন ভার্সনে শিরোনামটা পরিবর্তন করেছে। দুঃখ প্রকাশও করেছে। কিন্তু ছাপার কাগজে লেখাটাতো রয়েই গেলো।
এবার আসি ছবির মূল প্রতিবেদনে। অনেক বড় প্রতিবেদনের একটু ছোট অংশ। সেখানে প্রতিবেদক বলতে চেয়েছেন, গায়ে রং চাপা অর্থাৎ কালো হলেও আকাশছোঁয়া উচ্চতায় পৌঁছেছেন অনেক নারী এবং প্রশংসিত হচ্ছেন। কেনো ভাই কালো মানুষরা সফল্য পেতে পারে না? না কী গায়ের রঙই সফল হবার মূলমন্ত্র। মানুষ বিচারের সাদা কালোর ফারাক তো পৃথিবীজুড়েই নিন্দিত। মুক্তচিন্তার মানুষতো সেই পথেই হাঁটছে বহুদিন। তাহলে সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় পত্রিকার কেন এই পেছনে হাঁটা?
আমি প্রতিবেদকের এমন প্রতিবেদনের জন্য তাকে দোষারোপ করতে চাই না। তার চিন্তা আমাদের সমাজ ব্যবস্থারই ধারাবাহিকতা। আমরা এখনো দেখি, বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথমে ছেলে বা মেয়ের যোগ্যতা হিসাবে দেখা হয় তার গায়ের রঙ। এই কারণে ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করে, তাদের ক্রিম ব্যবহার করলে ত্বকের রং তিন থেকে চার গুণ উজ্জ্বল হবে। ফর্সা হতে ভিড় বাড়ে প্রসাধনীর দোকানে। যদিও তারা সম্প্রতি এই বর্ণবাদী নাম বদল করে রেখেছে, ‘গ্লো এন্ড লাভলি।’
করোনা মহামারির কারণে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে অনলাইনে কেনাকাটায়। জামা, শাড়ি থেকে শুরু করে সব কিছুই এখন আপনি পেয়ে যাবে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজের মাধ্যমে। কসমেটিক্সের পেজও আছে। সেখানে মেকআপ করা শেখানো থেকে শুরু করে ত্বকচর্চার সব পণ্যের প্রচার হচ্ছে। কিছুক্ষণ থাকলে বোঝা যায় ফর্সা হওয়ার বাসনা মানুষের কতটা। ছোটবেলা থেকেই একটা শিশু বড় হয় ফর্সা আর কালোর তকমা পেয়ে।
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, আমার বড় বোনের ছেলে অভ্র, বয়স এখন দশ। যখন তার বয়স চার বছর , সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বার্ষিক স্পোর্টসের আগের দিন তাদের ক্লাস টিচার বলে দেয় সবাইকে সুন্দর পরিপাটি হয়ে আসতে বলে। পরদিন স্কুলে যাওয়ার আগে সে তার মাকে বলে তার মুখে যেনো বেশি করে পাউডার দিয়ে দেয়া হয়। কেনো জিজ্ঞাসা করায় উত্তর আসে, মিস সুন্দর হয়ে আসতে বলেছেন। বাড়িতে কিন্তু তার সামনে কালো ফর্সা নিয়ে কখনই চর্চা হয় নি। হয়তো এই সমাজ ব্যবস্থা তাকে জানিয়ে দিয়েছে সে শ্যামবর্ণের। সুন্দর হতে হলে পাউডার মেখে হলেও ফর্সা হতে হবে।
এসবের শেষ কোথায়, কিভাবে জানা নেই। উন্নত দেশ আমেরিকা, সেখানেও এখনও কালো-সাদার বিভেদ চরমে। তাহলে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ যেখানে এখনও বহু মানুষ শিক্ষার আলো বঞ্চিত। তাদের কাছ থেকে এই অন্ধকার দূর হতে আরো দেরি। তারপরও প্রত্যাশা একদিন বর্ণের সব বিভেদ ভুলে আমরা হব শুধুই মানুষ।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/জেআইএম