বিমান চালানোর সময় মনে করি না আমি নারী

মাকসুদা আখতার প্রিয়তী
মাকসুদা আখতার প্রিয়তী মাকসুদা আখতার প্রিয়তী , বৈমানিক, মডেল
প্রকাশিত: ০৯:১০ এএম, ০৮ মার্চ ২০২১

আমি বলি আমার পুনর্জন্ম হয়েছে ২০১১ সালে, যে বছর আমি পাইলট হবো সেটার সিদ্ধান্ত নিই এবং তার প্রস্তুতি নিতে পরিকল্পনা করতে শুরু করি। কোলের দুই শিশুকে নিয়ে আমার এ সিদ্ধান্ত যে আমার জীবনে এক ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে, তা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিল।

সেই ভূমিকম্পের আভাস আমাকে বহুবার থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমার ভিতরে একটা বিশ্বাস ছিল, আমার মা আমার জীবন পরিবর্তন করতে বিদেশের মাটিতে পাঠিয়েছিলেন। এই জীবন পরিবর্তনের সব শক্তি ও সামর্থ্য আমার ভিতরেই আছে। আমরা যখন সেই শক্তি প্রয়োগ করি তখন তার মিষ্টি ফল পিছন পিছন অনুসরণ করে আপনা আপনি আসতে থাকে।

জীবনের ভূমিকম্পে কতটা উলটপালট হবে, সেদিকে নজর না দিয়ে আমি ফোকাস করি আমার লক্ষ্যের দিকে। জীবনের ভূমিকম্পগুলো মাত্র একবার এসে তছনছ করার পরে আসলে থেমে যায় না। এই ভূমিকম্প বারবার আসে, কখন কীভাবে কবে আসবে আপনার তা জানা নেই, কিন্তু আসে এবং প্রতিবারই আপনার শক্তির পরীক্ষা নেয়। আপনি ঠিক থাকলেই সে যুদ্ধে আপনি জয়ী হন।

আমি যখন ব্যক্তিগত মানসিক যুদ্ধগুলো এক বক্সে ঢুকিয়ে, আর সন্তানদের মা হওয়ার দায়িত্ব আরেক বক্সে ঢুকিয়ে, দুই অদৃশ্য বক্সের আজানা ওজন কাঁধে নিয়ে ফ্লাইট ট্রেনিং শুরু করি, তখন শুরু হয় আমার একাডেমিক যুদ্ধ। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি যে শুধু কঠিন, প্রত্যয়ী, দৃঢ় মানুষের বসবাস, তা আসতে আসতে সময় ব্যয় হওয়ার সাথে সাথে উপলব্ধি করি। ইংলিশে বললে টাফ মানুষের আনাগোনা বললে ভুল হবে না। আত্মবিশ্বাস থাকা বা মনোবল দৃঢ় থাকা আর ‘টাফ’ হাওয়ার মধ্যে এক ধরনের পার্থক্য আছে, যা আসলে শব্দের অর্থগত পার্থক্য থেকে ব্যক্তিত্বের পার্থক্য।

আমি যদি একটু ভেঙে বলি, ফ্লাইট ট্রেনিংয়ে যদি আমার জীবনও চলে যায় সেটির সাহস আমার ছিল ( যদিও এখানে ট্রেইনি পাইলটদের দুর্ঘটনা হয় না, তার পরেও মানুষ উচ্চতা কে ভয় পায়, হালকা এয়ারক্রাফট কে ভয় পায়) কিন্তু ত্রিশ/ চল্লিশ জন পুরুষের মাঝে টানটান করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে একমাত্র নারী হিসেবে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া পুরুষদের কথা বলার বিষয়ের মধ্যে নিজেকে অংশীদার করা , কোন মনোশক্তি ও ব্যক্তিত্বের যে প্রভাব দরকার সেটি তখনো আমার মাঝে গড়ে ওঠেনি, তাও আবার ভিনদেশের, ভিন সংস্কৃতি ও মানুষের মাঝে । কারণ এর আগ পর্যন্ত আমি আমার দেশীয় সংস্কৃতি ও কমিউনিটির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি নারী কিংবা পুরুষ লিঙ্গ চিনেনা, এই ইন্ডাস্ট্রি শুধু চিনে কাজের দক্ষতা, পরিপক্কতা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও নিরাপত্তা।

এবার আসি অ্যাকাডেমিক পরিবেশের দ্বিতীয়ভাগে। লাইট ট্রেনিং এবং পাঠ্যপুস্তকে যে ইংলিশ শব্দ ব্যবহার করা হয় তা অধিকাংশ আমার জন্য নতুন ছিল। এ যেনো আরেক নতুন ভাষা শিখছিলাম আমি। ট্রেনিং এর সময় অন্যান্য স্টুডেন্ট পাইলটরা ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টরের লেকচার ও ট্রেনিং সংক্রান্ত কথা যতটা সহজে বুঝতে পাচ্ছিল, আমার যেন সেগুলোর ধরতে দ্বিগুণ বেগে দৌড়াতে হচ্ছে কাঁধে ঐ অদৃশ্য দুই বাক্স নিয়েই। ইংলিশে কথা বলা আর বৈমানিক হওয়ার একাডেমিক ইংলিশের যে বিস্তর পার্থক্য তা ডে-ওয়ান থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। তবে ভয় পাইনি। আমার মনে ছোটবেলা থেকে একটা বিশ্বাস ছিল, আমার আগে পৃথিবীর একজন মানুষ যদি এই কাজটি করে থাকে, তাহলে আমি পারবো না কেন?

আমার আত্মবিশ্বাস এর শেকড় যদি আমি খুঁজতে যাই, আমি দেখি আমার আত্মবিশ্বাস এর বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, আমার মরহুম বাবা-মা। আমার বাবা আমার বয়স আট বছর হওয়ার আগেই সেই বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। আর মা, বাবা মারা যাওয়ার পর সেটাতে পানি ঢেলে যত্ন নিয়েছেন ।

আমি জীবনে পাইলট হব তার ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন দেখিনি। তাই বাবা মা কোনজনই আমার এই স্বপ্নের কথা জেনে যেতে পারেননি। আসলে স্বপ্ন দেখতে বা বুনতে কোন নির্দিষ্ট সময় লাগে না। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার বাবা মা যদি বেঁচে থাকতেন, তাঁরাও হয়তো স্বপ্নে কখনো ভাবতেন না, তাদের কন্যা কখনো পাইলট হওয়ার সাহস ও ক্ষমতা রাখে। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে প্রথম বৈমানিক হওয়া বলে কথা, তাও আবার নারী।

আমার এই ক্ষমতা ও শক্তি আমি নিজেই আবিষ্কার করেছি, সাথে আবিষ্কার করেছে ধৈর্য ও সহনশীলতার শক্তি এবং আমার বিশ্বাস এই অসীম ক্ষমতা ও শক্তি সবার মাঝেই আছে। আমরা শুধু আবিষ্কার করতে জানিনা, কিংবা যাইনা। আমি এখনো পেছন ফিরে তাকালে নিজেই বিস্মিত হয়ে যাই, আমি দুধ খাওয়া শিশুদের নিয়ে কিভাবে এই ফ্লাইট ট্রেনিং সম্পন্ন করেছিলাম। কিভাবে রাত জেগে জেগে বাচ্চাদের দুধ খাইয়ে, দিনের বেলায় ফ্লাইট ট্রেনিং ও ক্লাস করেছিলাম। কিভাবে মানসিক যন্ত্রণা ও আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে নিজের লক্ষ্যের দিকে কেন্দ্রীভূত ছিলাম। আমি বিস্মিত হয়ে যাই।

একজন নারী আনলিমিটেড মাল্টিটাস্ক করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, তার মস্তিষ্ক ডিজাইন করা বিভিন্ন ডাইরেকশনে কাজ করতে এবং তার জন্যে মস্তিষ্ক সর্বক্ষণ সক্ষম ও প্রস্তুত। সেজন্য নারীদের দূরদর্শিতা ও শক্তিশালী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নারীদের এই শক্তিকে অবমাননা করা হয়, স্বীকৃতি দেয়া হয় না , অ্যাপ্রিশিয়েট করা হয় না। নারীর স্বয়ং যখন নারীর ক্ষমতা কে চিনে উঠেন তখনই হয়ে ওঠেন একেকটা স্ফুলিঙ্গ, যার আলো ঝলকিয়ে ওঠে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে । হয়ে উঠেন একেকজন জ্বলন্ত উদাহরণ।

লেখক : পাইলট, মডেল, লেখক। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাবেক মিস আর্থ ও মিস আয়ারল্যান্ড।

এইচআর/জেআইএম

আমি যখন ব্যক্তিগত মানসিক যুদ্ধগুলো এক বক্সে ঢুকিয়ে, আর সন্তানদের মা হওয়ার দায়িত্ব আরেক বক্সে ঢুকিয়ে, দুই অদৃশ্য বক্সের আজানা ওজন কাঁধে নিয়ে ফ্লাইট ট্রেনিং শুরু করি, তখন শুরু হয় আমার একাডেমিক যুদ্ধ। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি যে শুধু কঠিন, প্রত্যয়ী, দৃঢ় মানুষের বসবাস, তা আসতে আসতে সময় ব্যয় হওয়ার সাথে সাথে উপলব্ধি করি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।